এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে মা

পিপিইতে পরমা
পিপিইতে পরমা

আজ প্রায় এক মাসের বেশি হলো পরমার সঙ্গে আমাদের দেখা নেই। আমরা ওকে খুব খুব মিস করছি, সেও আমাদের মিস করছে। আমাদের একমাত্র আদরের কন্যা। কখনো দিনের কাজের শেষে অথবা রাতের শিফটে কাজে যাওয়ার আগে ফেসটাইমে আমাদের সঙ্গে কথা হয়। আমরা দুরুদুরু বুকে ওর কলের অপেক্ষায় থাকি।

পরমা পেশায় ডাক্তার। হাসপাতালের সঙ্গেই বরাদ্দকৃত অ্যাপার্টমেন্টে তার বাস। শেষ যেদিন বাসায় এল, সেদিন ১ মার্চ ছিল। নিউইয়র্ক নগরে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মেয়র বিশেষ সব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। বাসায় এসে বেশিক্ষণ থাকল না। আমাদের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে খেতে বললও, আমি সাইকিয়াট্রি থেকে মেডিসিনে কাজ করার অপশন দিয়েছি। কারণ এখন মেডিসিনে অনেক ডাক্তার দরকার, হাসপাতালে দলে দলে রোগী আসছে। সেই তুলনায় ডাক্তার অনেক কম। ডাক্তাররা হিমশিম খাচ্ছে। আমিতো সাইড লাইনে বসে থাকতে পারি না।

আমরা ভেবেছিলাম সে যেহেতু সাইকিয়াট্রিষ্ট, তাই তাকে হয়তো সরাসরি করোনা রোগীদের সঙ্গে কাজ করতে হবে না। আমি আর আমার বউ অনেকটাই স্তম্ভিত হলাম। বলতে পারতাম যাওয়ার কি দরকার? কিন্তু তার মুখে যুদ্ধে যাওয়ার যে দীপ্তি দেখলাম, আমাদের সাহস হল না। মনে হলো মুক্তিযুদ্ধের কথা, তখন কত মা নিজ হাতে সন্তানকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বিদায় দিয়েছে। মেয়ের সততা আর সাহস দেখে গর্বিত হলাম। মনে মনে একটি স্যালুটও করলাম।

প্রতি সপ্তাহের মত আজও তার মা তার জন্য  নানা রকম খাবার তৈরি করেছে, এগুলো বিভিন্ন  রকম বক্সে ভরে আমরা ওকে দিয়ে দিই। সারা সপ্তাহ ফ্রিজে রেখে খায়। আজও সে রকমই করা হল। যাওয়ার আগে আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল সে, আমি কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত   বাসায় আসব না—‘আই নো আই উইল মিস উই গাইস’। কিন্তু বাসায় এসে তোমাদের তো ‘সিক’ করতে পারি না।

আমরা প্রতিদিন আল্লার কাছে দোয়া করি, ও যেন সুস্থ থেকে আরও মানুষকে সেবা করতে পারে। প্রথম দিকে ওকে টাকা পাঁচ দিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত কাজ করতে হল। প্রতিদিনই কাজে যাওয়ার আগে ফেসটাইমে আমাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সাক্ষাতে বলে কীভাবে ডাক্তাররা    রোগীদের বাঁচাতে চেষ্টা করছে। তার কাছেই     শুনেছি হাসপাতালে তারা নিশ্বাস নেওয়ার সময় পাচ্ছে না। ইমারজেন্সি রুমে একজন রোগীর             জন্য ব্লু কোড দেওয়া হয়েছে, সেটা শেষ না হতেই আরেকটা ব্লু কোড। মনিটরে বিপ বিপ শব্দ করে জানান দিচ্ছে, ব্লাডপ্রেসার দ্রুত নিচে নামছে।  একজন ডাক্তার চেঁচিয়ে বলছে, ভেন্টিলেটর চাই, আরকজন রোগীকে নার্সরা সাদা পর্দা দিয়ে ঘিরে  হার্টে ইলেকট্রিক শক দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করছে। কখনো মরণাপন্ন মানুষকে তাদের পরিবারের সঙ্গে ফেসটাইমে শেষবারের মত দেখা করিয়ে দিচ্ছে।

পরমার মুখে এসব শুনতে শুনতে মনে হয় যেন কোন সায়েন্স ফিকশন মুভির দৃশ্য বর্ণনা করছে। আহা তাই যদি হতো? কিন্তু না, এর সবই বাস্তব। ওর হাসপাতালে (নিউইয়র্ক ব্রঙ্কসের মন্টিফিউর হাসপাতাল) বাঙালি রোগী এলে ওর ডাক পড়ে। টেলিফোনে আমাকে বলেছে, ‘বাবা এত মানুষ    মারা যাচ্ছে, আমরা কারও জন্য একটু দুঃখও  করতেও পারছি না। একজনকে শেষ করে আরেকজনের কাছে ছুটছি। সব বয়সের মানুষ মারা যাচ্ছে। ডাক্তাররা মানসিকভাবেও ভীষণ চাপে   আছে। এত মৃত্যু একসঙ্গে কেউ দেখেনি। সবচেয়ে কষ্টের হচ্ছে মৃত্যুর সময় পাশে ডাক্তার ছাড়া কোন প্রিয়জন নেই।’

আমরা প্রথম দিকে ওকে নিয়ে ভয় পেলেও এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। তবে একটি মাত্র মেয়ে বারবার ওকে দেখতে ইচ্ছে করে। আমাদের চাপাচাপিতে একদিন বাসায় আসবে বলল ও-একটা শর্তে আমাদের বাসার গ্লাস ডোরের বাইরে ও   দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা ওর খাবার আর প্রিয়    ভিডিও গেম কনসোলটা বাইরে রেখে দেব,   আমাদের দেখবে আর খাবারগুলো নিয়ে বাইরে থেকেই চলে যাবে।

চায়নার ‘উহানে’ যখন করোনাভাইরাস বিস্তার করছে। তখন বাংলাদেশের টিভির খবরে একটি দৃশ্য দেখেছিলাম। মায়ের করোনা, মেয়ে মাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছে। কিন্তু দূর থেকে দেখছে, মা আর মেয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছে, অদৃশ্য এক আলিঙ্গন। সেদিন কি আমি ভাবতেও পরেছিলাম, আমরাও একদিন এ রকম পরিস্থিতিতে পড়ব? আমাদের প্রেসিডেন্ট আশ্বাস দিচ্ছিলেন সবকিছুই ‘আন্ডার কন্ট্রোল’।

আমার প্রিয় কন্যাকে এত কাছে এলেও আমরা ছুতে পারব না। ভাবতেই আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। ওর মা সেই দিন থেকেই কাঁদছে আর ওর প্রিয় খাবারগুলো রান্না করছে। আমি কেমন করে সেই দৃশ্য সহ্য করব ভেবে পাচ্ছি না। শুধু হেলাল হাফিজের কবিতার দুটি চরণ থেকে সান্ত্বনা খুঁজলাম—

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’

লেখক: আবদুল্লাহ জাহিদ, গল্পকার ও কুইন্স লাইব্রেরি হলিস শাখা ম্যানেজার।

ইমেইল: [email protected]