মরার অধিকারও আজ হাতছাড়া

সামান্য কাশিও প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, এটা কয়জন বিশ্বাস করবেন! অথচ ঠিক এমনটাই ঘটেছে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির উপকণ্ঠে গ্রেটার নয়ডায়। খবরে প্রকাশ, লকডাউনের বাজারে কয়েকজন বন্ধু মিলে লুডো খেলছিল একসঙ্গে। যেকোনো কারণেই হোক, তাদের একজন খুক খুক করে কেশে উঠতেই, সম্ভাব্য করোনা রোগী ভেবে তাকে গুলি করে বসে সঙ্গীদের একজন। করোনা আতঙ্কের শিকড় কতটা গভীরে গেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

করোনার আতঙ্ক মানুষকে এতটাই ত্রস্ত করেছে যে, সমাজের সবাইই একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। ডাক্তার-নার্স থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক, কাউকেই রেয়াত করা হচ্ছে না। এমনকি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত না হওয়া সত্ত্বেও, কেবল সন্দেহের বশেই সামাজিক বর্জনের শিকার হচ্ছেন করোনা আক্রান্ত সন্দেহে। যদিও তা নিয়ে হা–হুতাশ করাটা আজ সর্বার্থেই অর্থহীন। কারণ এই সম্ভাবনার বীজ রোপিত হয়েছিল সেই দিনই, যেদিন শাসকদলগুলো করোনা প্রতিরোধ করার জন্য ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছিল।

ভোগবাদী ভাবনায় জারিত এই শব্দ বন্ধনী ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠী কৌশলগতভাবেই মানুষের যাবতীয় ভাবনাকে এমন একটি ধারায় বইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, যা মানুষের সহজাত মানবিক মূল্যবোধগুলোকে অবলীলায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জন্ম দিয়েছে অসহিষ্ণুতা, যুক্তিহীনতা ও অবিশ্বাসী এক বাতাবরণ। এবং সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। নিজে সুস্থ থাকা এবং অপরকে সুস্থ রাখার যাবতীয় দায় যেন আমাদেরই। ফলস্বরূপ, আমাদের আচরণের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে এমন কিছু লক্ষণ প্রতিভাত হচ্ছে, যেগুলোকে সচরাচর সভ্যসমাজ প্রগভলতা এবং স্বার্থপরতা হিসেবেই চিহ্নিত করে। তথাপি আমাদের ত্রস্ততা কাটেনি এতটুকুও। এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, অজানা শঙ্কায় জীবনকে ত্রস্ত করে রাখার মধ্য দিয়ে শাসক দল খুব সহজেই একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করে যাবতীয় দায় তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদাটুকু সরকারগুলো পূরণ করতে আগ্রহী নয়। এবং পুঁজিবাদের এই নগ্ন চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র।

সম্প্রতি ইতালি সরকার যেমন সরাসরিই জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে তারা আর বয়স্ক মানুষদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে রাজি নয়। অন্যদিকে টেক্সাসের লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডান প্যাট্রিক প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘অর্থনীতিকে বাঁচাতে দেশের বয়স্ক নাগরিকদের মরে যাওয়াই ভালো।’ নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদের এহেন অমানবিক রূপ প্রত্যক্ষ করেই বোধ হয় নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ‘Ventilator shortage Exposes the Cruelty of Neoliberal Capitalism.’

 চমস্কি সাহেব উন্নত দেশের মানুষ, তাই চিকিৎসার প্রয়োজনে ভেন্টিলেটরের কথা ভাবতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের মতো পোড়া দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে সামান্য পরীক্ষার ব্যবস্থাটুকুও অপ্রতুল। সরকার যখন দাবি করছেন, তাদের হাতে পর্যাপ্ত কিট নেই। যদিওবা অল্প–বিস্তর পরীক্ষা হচ্ছে, কিন্তু তার ফলাফল সবটা প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।

তবে অবস্থা যাই হোক, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে করোনাভাইরাস নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছে সরকার এবং মানুষ। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির নিরাপদে মরার সুযোগও নেই। সরকার রোগী ও তাদের পরিজনদের সুরক্ষা দিতে পারুক বা না পারুক, মৃতদের সুরক্ষিত শেষকৃত্য করার ক্ষেত্রে সরকারের কিন্তু কোনো খামতি নেই। পাশাপাশি যোগ-বিয়োগ করে দেখা যাচ্ছে, সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আক্রান্তের চেয়ে সুস্থ হওয়া মানুষের সংখ্যা ঢের বেশি। তবে মৃতের সংখ্যা ঠিক কত, সেটা অবশ্য হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কারণ সংখ্যাটা খতিয়ে দেখছে চাটুকার এবং তাঁবেদার বিশেষজ্ঞ কমিটি।