আমেরিকানদের মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলছেন ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও ৬০ হাজারের বেশি মৃত নিয়ে করোনাভাইরাস মহামারিতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দেশ এখন আমেরিকা। নানা ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এ অবস্থাতেও অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি চালুর কথা ভাবছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরেরা। তাঁরা যেকোনো মূল্যে এটি করতে চান, যা নিশ্চিতভাবেই অগণিত মানুষকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে ফেলবে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা ও মেয়ে-জামাই জ্যারেড কুশনার ‌‌‌দ্রুত‌ অর্থনীতি চালুর বিষয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি এতে কোনো ঝুঁকি দেখছেন না। তিনি দেখছেন সম্ভাবনা। আর এই সম্ভাবনা তাঁর শ্বশুর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের। এ কারণে তিনি সাফল্যের সূত্র হিসেবে মানুষের জীবন বাঁচানোকে নয়, অর্থনীতিকে বাঁচানোকেই বুঝছেন। কারণ, তাঁকে বাস চালাতে হয় না বা এতে চড়ে তাঁর কর্মস্থলে যেতে হয় না। গণপরিবহনে যারা চড়ে, যারা হোটেল বা রেস্তোরাঁয় কাজ করে, যারা কারখানার চাকা ঘোরায়, যারা পণ্য উৎপাদন থেকে বিপণন—এই ধাপগুলোয় সরাসরি যুক্ত, তাঁদের কারও জীবন জ্যারেড কুশনারের মতো নয়। অর্থনীতি চালু মানে, এই লোকগুলোকে পথে নামতে হবে। এই লোকগুলোকে নিজেদের নিয়মিত কাজে লেগে পড়তে হবে আগের মতো। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের মতো বা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মতো তাঁরা সুরক্ষা বলয়ে থেকে কাজ করতে পারবেন না।

জ্যারেড কুশনার সামনের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই হাওয়ায় কথা ছুড়ে দিয়েছেন, আগামী জুনেই আমেরিকার অর্থনীতি একেবারে ঘুরে দাঁড়াবে। উদ্দেশ্য, লোকেদের ট্রাম্পের সাফল্যের গল্পে আগে থাকতেই মশগুল করে ফেলা। এটি তিনি করছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্টের ইশারাতেই। ইশারাই বা কেন। ট্রাম্প তো সরাসরিই একাধিকবার অর্থনীতি চালুর কথা বলেছেন। বিশেষজ্ঞরা যত নিষেধই করুন না কেন, ট্রাম্প তো শুনতে নারাজ। অথচ এখনো প্রতিদিন আমেরিকায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সারা বিশ্বে নতুন করোনাভাইরাসে নিশ্চিত সংক্রমণের সংখ্যা ৩২ লাখ ছাড়িয়েছে। আর মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ২৮ হাজার ছাড়িয়েছে আগেই। এর মধ্যে আমেরিকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখ ৪০ হাজারের বেশি। মনে রাখা জরুরি, এই আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু যে ৬০ লাখ ২৬ হাজার লোকের পরীক্ষা হয়েছে, তার ভিত্তিতে। আমেরিকার মোট জনসংখ্যার অনুপাতে এই পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অনেক কম। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬১ হাজার ছাড়িয়েছে, যা একক দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

এখনো সংক্রমণের গতি কমে আসা বা বিপর্যয় দূর হওয়ার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেখা যায়নি। অথচ ট্রাম্প মনে করছেন, অর্থনীতি এখনই চালু করা যায়। কারণ, মূল ধাক্কা নাকি আমেরিকা পেরিয়ে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি কোন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এমন বলছেন, তা নিশ্চিত নয়। তিনি শুধু এটুকুই বলছেন না। লকডাউনের কারণে কাজ হারিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের আবেগ নিয়েও তিনি খেলছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের লকডাউন প্রত্যাহার ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালুর জন্য যে দাবি ও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তার পেছনেও তাঁর ইন্ধন রয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট যেকোনো মূল্যে অর্থনীতি চালু করতে চান। এ জন্য যদি আরও মানুষের প্রাণ যায় তো যাক-এই তাঁর মনোভাব। এমনকি আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি যখন লকডাউন প্রত্যাহার করতে হলে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন, তখন তিনি তাঁকেও একচোট নিতে ভোলেননি। ট্রাম্পের বক্তব্য, আমেরিকায় নাকি যথেষ্ট পরিমাণে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি করার প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞ মতকে কোনো বাছবিচার ছাড়াই তিনি খারিজ করে দিচ্ছেন। অথচ ফাউসি কিন্তু এই পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধির কথা অর্থনীতি ফের চালুর প্রেক্ষাপট তৈরির জন্যই বলেছিলেন। এখানে দুজনের পার্থক্য হচ্ছে, ফাউসি চান তুলনামূলক একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে, অর্থাৎ তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ লোকদের কাজে ফিরিয়ে ধাপে ধাপে অর্থনীতি চালু করতে। আর ট্রাম্প কোনো নিরাপত্তা বলয়ের ধার ধারেন না। তিনি একটি চালু অর্থনীতি চান নিজের স্বার্থেই। আর এ জন্য কতজন মরল, তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না।

সবাই বুঝছে যে, অর্থনীতি এভাবে দীর্ঘ দিন বন্ধ হয়ে থাকলে মানুষ অভাবেই মারা পড়তে পারে। দিনকে দিন পরিস্থিতি বাজে দিকে যাচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের অনুমান সত্য হলে, আমেরিকা তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ধসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর এর মাত্রা যত বেশি হবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার মসনদে বসা তত কঠিন হবে। ট্রাম্পও এ কথা বেশ ভালোভাবেই জানেন। আর এ কারণেই তিনি লকডাউনের পক্ষে বা অর্থনীতি চালু করার বিপক্ষে কোনো কথাই শুনতে নারাজ। এতটাই যে সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, গত শুক্রবার রাতে নিজের প্রচার ব্যবস্থাপককেও একচোট নিতে ছাড়েননি ট্রাম্প। কারণ আর কিছুই নয়, ব্র্যাড পার্সক্যাল এভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও প্রচার শুরু নিয়ে দ্বিধা প্রকাশ করেছেন।

ট্রাম্পের মতো তাঁর উপদেষ্টা মেয়েজামাই কুশনারও অর্থনীতি চালুর ব্যাপারে মরিয়া। কারণ কুশনারের চেয়ে নির্বাচনের কৌশল আর কে ভালো জানেন। ২৯ এপ্রিল ফক্স নিউজকে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষকে আবার কাজে ফিরিয়ে নেওয়া।’ কিন্তু কুশনার অনেক বড় একটি জুয়ার কথা বলছেন। হতে পারে, তাঁর এই কাজে ফেরার উদ্যোগটি কাজে লাগল। হতাশ হয়ে পড়া, কাজ হারানো মানুষেরা আবার প্রাণ ফিরে পেল। কিন্তু এই প্রাণ ফিরে পাওয়াই যদি সত্যিকার অর্থে প্রাণসংহারী হয়ে ওঠে, তবে তার জন্য আমেরিকাকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। এমনকি তখন মৃতের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশিও হতে পারে।

মনে রাখা জরুরি, ট্রাম্প প্রশাসন, বিশেষত এর শীর্ষ ব্যক্তি কিন্তু শুরুতেই বলেছিলেন, আমেরিকায় অন্য দেশের মতো লকডাউন করতে হবে না। এখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বের মোট আক্রান্তের এক-তৃতীয়াংশের বাস আমেরিকায়। আর সবচেয়ে বেশি মারাও গেছে আমেরিকায়। তাই প্রশাসনের বক্তব্যের ওপর মানুষ কী করে আস্থা রাখবে?

ঘরবন্দী থাকতে থাকতে মানুষ জেরবার, কাজ হারিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত-এ সত্য। কিন্তু এও তো সত্য, এ ধরনের মহামারি পরিস্থিতিতে মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নেওয়ার দায় প্রশাসনের ওপর বর্তায়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে বিশেষজ্ঞদের কথায় গুরুত্ব দিতে হয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তা করছে না। তারা যেভাবে লকডাউন তুলে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কথা বলছে, তাতে এরই মধ্যে আমেরিকার অর্ধেকের বেশি অঙ্গরাজ্য লকডাউন প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, এমন পদক্ষেপে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কোনো সিইও বা শত কোটিপতির জীবন ঝুঁকিতে পড়বে না।

সিঙ্গাপুর, জার্মানির মতো দেশ, যেখানে পরিস্থিতি অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেখানে মৃতের সংখ্যা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম, তারাও এমনকি এখনই সব স্বাভাবিক করার সাহস পাচ্ছে না। এমন পদক্ষেপের আগে তারা অন্তত একটি তুলনামূলক কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি হাতে পেতে চান।

 ২৯ এপ্রিল অ্যান্থনি ফাউসি অবশ্য রেমডিসিভির সম্পর্কে একটি সুসংবাদ দিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন যে, ওষুধটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কিছুটা ভালো ফল দিয়েছে। দেখা গেছে ওষুধটির প্রয়োগে শরীরের ভেতরে ভাইরাসটির সক্রিয় থাকার সময়কাল কমে আসে এবং এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি কমে। এটি সুসংবাদ। এমন আরও কিছু সুসংবাদ প্রয়োজন। একই সঙ্গে কারা এরই মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় পৌঁছে গেছে তাদের শনাক্তে পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানো জরুরি। তবেই অর্থনীতির ক্ষত শুকাতে কাজে নামার সুযোগ হবে। ওই জায়গাগুলোকে বাদ রেখে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা যেভাবে যেকোনো মূল্যে অর্থনীতি চালু করতে তৎপর হয়েছেন, তা বিপুলসংখ্যক মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার শামিল।