বাংলা কমরেড

মার্চের মাঝামাঝি লকডাউনের কথা শুনে আমার মার্কিন সহকর্মী জর্জ বিরক্তই হয়েছিলেন। স্বাধীন দেশে থাকেন। আমেরিকার সংবিধানের ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট নিয়ে তাঁদের কত উচ্ছ্বাস। নিজ দেশের পতাকা পোড়ানো থেকে শুরু করে হেন ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, যা তাঁরা ভোগ করেন না। সময়ে-অসময়ে বলেনও বেশ অহংকার করে। জর্জ দ্রুতই বুঝতে পারলেন কোভিড-১৯ নামের মহামারির ভয়াবহতার কথা। অন্য সবার মতোই গৃহবন্দিত্ব মেনে নিলেন। অন্যবারের মতো ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট নিয়ে আর বেশি উচ্চবাচ্য করলেন না।

বেশ কিছুদিন পর ফোন করলেন। মে মাসের প্রথম দিন। জুতসই অভিনন্দনটা জানালাম।
হ্যাপি মে ডে জর্জ!
হ্যাপি মে ডে ইব্বি! বুঝলে, এ দিনটা আমাদের অনেক অহংকারের। ১৯৩১ সালের এ দিনটাতে তখনকার প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হুবার ওয়াশিংটন থেকে বোতাম টিপে নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের বাতি প্রজ্বালন করেছিলেন। তখনকার সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং। একজন নিউইয়র্কার হিসেবে এ অহংকার নিয়ে বড় হয়েছি। পৃথিবী এখন কত বদলে গেছে। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংটিরও আগের সেই অহংকার আর নেই!
জর্জ, আমি মে দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি! সারা বিশ্বে এ দিনটা পালন হয় তোমাদের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের বাতি প্রজ্বালনের দিবস হিসেবে নয়! আজ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন জর্জ। তোমাদের আমেরিকা থেকেই এ দিবসটার উৎপত্তি হয়েছিল। শিকাগোর হে মার্কেটে এখনো আত্মাহুতি দেওয়া আমেরিকান শ্রমিকদের সমাধিস্তম্ভ আছে। এ দিনটা নিয়ে তোমাদের কোনো উচ্ছ্বাস দেখি না কখনো। মেহনতি মানুষের ঘাম আর রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমেরিকার আজকের সাম্রাজ্য। আমাকে নিরাশ করলে জর্জ !
উত্তেজিত হয়ে পড়ছ কেন ইব্বি! আমেরিকা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছে বলেই বিশ্বের সব মানুষের স্বপ্নের গন্তব্য এ দেশ। অস্বীকার করবে? তুমি যে কমিউনিস্টদের মে দিবস নিয়ে পড়ে আছ, বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
মেজাজ একটু বিগড়ে গেছে টের পেলাম। নিরুত্তর থাকলাম।
হ্যাঁ ইব্বি, আমেরিকার নানা জায়গায় কমিউনিস্টরা এখনো দিনটা পালন করে বলে জানি। নিজে কোনো দিন যোগ দিইনি। টিভিতে দেখেছি কমিউনিস্ট দেশগুলোতে বড় বড় সমাবেশ হয়। আতশবাজি পোড়ে। লোকজন উৎসবে মেতে ওঠে। আমরা আমেরিকানরা সেপ্টেম্বরে লেবার ডে পালন করি। সারা বছরের মধ্যে সেরা শপিংয়ের দিন। দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বের এ দিনটি।
জর্জ, সবকিছু নিয়ে তোমরা বাণিজ্য করো। মানবিকতা বলে কিছু নেই তোমাদের। পুঁজিবাদের অভিশাপে দাঁড়িয়ে মহান মে দিবসের মাহাত্ম্য তুমি কীভাবে বুঝবে জর্জ?
ঠিক নয়! পুঁজিবাদকে বোঝার জন্য হলেও মে দিবসের মাহাত্ম্য বোঝার চেষ্টা করেছি আমরা আমদের মতো করে!
জর্জ আমি তর্কে যেতে চাই না। মনটা খারাপ এমনিতেই।
আই এম সরি ইব্বি। আল দ্য বেস্ট। নিরাপদ থাকো। কথা হবে আবার সপ্তাহান্তে।
কথা যে অন্য দিনের মতো এগোচ্ছে না, এমনটা টের পেয়ে জর্জ ক্ষান্ত দিলেন। নির্ঘাত জানি, জর্জ নিজেও অস্বস্তিতে থাকবেন। নেহাত সৌজন্যের ফোনকলটি রাজনৈতিক হয়ে ওঠায় জর্জ নিজেও বিব্রত হয়েছেন। সপ্তাহান্তে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করে কোনো আদি রসাত্মক কৌতুক শুনিয়ে আবার হাসাবার চেষ্টা করবেন।
মে দিবসের চেতনা আমকে তাড়া করে। নিজের ঘরের দুজন খাঁটি আমেরিকানের পিছু নিই। একজন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ এক বহুজাতিক রক্তচোষা প্রতিষ্ঠানের তরুণ নির্বাহী। সারা বিশ্ব লকডাউন। নির্বাহীটি ভিডিও গেম খেলছেন। চেয়ারে শরীর এলিয়ে হাতের জয়স্টিক দিয়ে খেলার উত্তেজনা দেখে মেজাজটা আরও বিগড়ে যায়।
মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় শ্রমিক আন্দোলনের দিনগুলোর কথা। জীবনের বহু মে দিবস পালনের স্মৃতি। টেক্সটাইল-শ্রমিক, চা-শ্রমিক, রিকশাশ্রমিকদের নিয়ে নগর প্রদক্ষিণ করে 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' স্লোগান দেওয়ার দিনগুলো! পশমি চাদরটার কথা মনে পড়ে!
তরুণ নির্বাহীকে জিজ্ঞেস করি, মে দিবসের মাহাত্ম্যের কথা জানেন কি না। আশ্চর্য করে দিয়ে তিনি ঠিকই বলতে পেরেছেন, দিনটা শ্রমিক আন্দোলনের।
শ্রমিক শোষণের আধুনিক কলাকৌশল জানা না থাকলে আমাজনের স্থাপনাটি কীভাবে চালাবেন সাম্রাজ্যবাদের তরুণ তুর্কি লাঠিয়ালেরা!
এবারে ঘরের দ্বিতীয়জনের দ্বারস্থ হই। এক ঘরে থাকলেও আমাদের প্রত্যেকের জীবন ভিন্ন ভিন্ন। কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই গত মাস দুয়েক। ফোনে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়! প্রত্যেকে নিজের বিনোদনে ব্যস্ত। কেউ ছবি আঁকছেন। কেউ ভিডিও গেম খেলছেন। কেউ করুণ সুরে ধর্মগ্রন্থ পাঠে মগ্ন থাকছেন দিনরাত।
এর মধ্যেই আমি কলেজে যাওয়া এ প্রজন্মের আমেরিকানের কাছে মে দিবসের মাহাত্ম্য জানতে চাই। তিনি ঠোঁট-মুখ যতটা সম্ভব বাঁকা করে একটা আমেরিকান মেকি হাসি ধরে রেখে জানালেন, দিনটিতে তাঁর কলেজের সব বন্ধুর এক হওয়ার কথা ছিল। লকডাউনে সব পাল্টে গেল!
কোথায় হে মার্কেট আর কোথায় কাস্তে হাতুড়ির ব্যানার। এসব নিয়ে এদের সঙ্গে কথা বলার আর কোনো মানে অবশিষ্ট আছে বলেই আর মনে করি না। মনটা বিমর্ষ হয়!
নিউজার্সির বসন্তের বিকেলে আকাশে চাঁদ ওঠে। প্রান্তিক এ নগরীর আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্রমিকনেতা শরাফতকে স্মরণ করি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। আমাদের শহরে (সিলেট) তখন বড় শ্রমিকনেতা কমরেড আসদ্দর আলী, কমরেড আশিক চৌধুরী। শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে আজীবন শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি করা কমরেড আসদ্দর আলীর ডেরা। সব শ্রমিক আন্দোলন সেখান থেকেই পরিচালিত হতো। আসতেন কমরেড ফখরুল খান, নেসার আহমেদ, রেজয়ান আহমেদ, কমরেড এখলাসুল মোমেন, ধীরেন সিংহ, এমাদুল্লাহ শাহিন, মোস্তফা কামাল, আফরোজ আলী, আবদুল হাশেম। প্রান্তিক শ্রমিকদের নিয়ে জমজমাট থাকত কমরেড আসদ্দর আলীর আস্তানা। এমনি এক জোনাক রাতে দেখি তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন চীনা আর রুশ কমরেডরা। কে কোন পক্ষের, তা নিয়ে তত্ত্বকথা চলছে তো চলছেই। এসব বিতর্কে বারবার ভেঙেছে শ্রমিক ঐক্য। লাভবান হয়েছে শ্রম শোষকেরা। কে শোনে কার কথা! কে কতটা খাঁটি বিপ্লবী, তা নিয়ে তর্ক হতেই থাকল।

রাত বাড়ে, অবিরাম তর্ক চলে। শ্রমিকনেতা শরাফত আলী আমাকে তাড়া দেন। চলেন ভাইজান, আমরা বাংলা কমরেডের সন্ধানে যাই ! এখানে সব চৈনিক কমরেড, না হয় রুশ কমরেড!
কথাটা আমার পছন্দ হয়। মধ্যরাতে শরাফত আলীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যোগ দেন হরি নারায়ণ দত্ত, যাঁকে আমরা বেণু বলে ডাকতাম। লাল রঙের দুই দরজার পাবলিকা গাড়িতে উঠেই বেণু নির্দেশ দেন, যেন চা-বাগানের দিকে গাড়ি চালাই। মধ্যরাতের নির্জন শহর পেরিয়ে চা-বাগানে ঢুকি। বেশ দূর থেকেই উল্লাস শুনি। চা-শ্রমিকদের উল্লাস।
গাড়ি থেকে নামতে নামতে শরাফত আলী বললেন, এখানে বাংলা তাড়ি বিক্রি হয়! মহান মে দিবস উপলক্ষে আজকের সব আয়োজন ফ্রি! আয়োজনটি বাগানের মালিকই করে দিয়েছেন! এখানকার সব বাংলা কমরেড!
শত শত চা-শ্রমিক তাঁদের মতো আনন্দে ভাসছেন। বলছেন, মে দিবস অমর হোক ! জোনাকির আলোয় চাপা পড়া রাতে আমি বাংলা কমরেডদের উন্মত্ত অবস্থা দেখি। আকাশভরা চাঁদের আলোয় দেখা যৌবনের সেরা মে দিবসে।
এরপর বহু মে দিবস চলে গেছে। রেড স্কয়ারে, তিয়েনআনমেন স্কয়ারে মে দিবসের বহু সমাবেশ হয়ে গেছে! 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' বলে লাখো জনতার স্লোগান উঠেছে বারবার!
শ্রমিক শোষণ বন্ধ হয়নি। শোষণের প্রকার বদলেছে ! আয়োজনটা ভিন্ন থেকে ভিন্নতর হয়েছে। করনাকালের এ শ্রমিক দিবসে শরাফত আলী আর হরি নারায়ণ দত্তকেই বেশি করে মনে পড়ছে! বেশ কবছর আগে দেশে গিয়ে খোঁজ করেছিলাম।
শ্রমিকনেতারা জানালেন, শরাফত আলীর মরদেহ বাগানের খালে ভাসতে দেখা গেছে কোনো এক কড়া রোদের দুপুরে !
পুঁজিবাদের দেশের মিশিগানে থিতু হয়েছিলেন বেণু। হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে গিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাত রেখেছিলাম। কদিন পরেই পেয়েছি মৃত্যুসংবাদ !
শ্রম অধিকারের কতটা অগ্রগতি হলো, এ নিয়ে হিসাব অন্যরা করবেন। দিনটিতে আমি আমার প্রয়াত দুই কমরেডকেই স্মরণ করি!
বিটলসের গানটি তাঁদের জন্যই যেন উৎসর্গ করা ,
You say you want a revolution
Well, you know
We all want to change the world
You tell me that it's evolution
Well, you know
We all want to change the world...।।
ইব্রাহীম চৌধুরী, নিউজার্সি।
[email protected]