ম্যানচিনিল

১.
শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি একটু অন্য রকম। একটানা বৃষ্টি হয় না। দিনে একবার বৃষ্টি হলে, সারা দিন আর নাও হতে পারে। আকাশ থাকে মেঘাচ্ছন্ন। আজ সকালে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। ফলে ধরা যাচ্ছে যে, আর বৃষ্টি হবে না। রোহান গাড়ি চালাচ্ছে। জিমি হেনড্রিক্স-এর গান বাজছে। বনানী থেকে উত্তরা এখন ফ্লাইওভারের কাজ থাকাতে জ্যাম হয়। গাড়ি চলছে আস্তে। তখনই সানিয়ার ফোন।
-এই তুমি কোথায়?
-আমি র‌্যাডিসনের কাছে।
-তুমি না বললে আধঘণ্টা আগে রওনা দিয়েছ?
-রাস্তায় জ্যাম, কী করব?
-দেরি হলেই জ্যাম... ভালোই ছুতো পেয়েছ...
-তুমি এসে না হয় দেখে যাও...
-হয়েছে আর দেখতে হবে না। তাড়াতাড়ি আস।
-ওকে বেবি...
মোবাইল রেখে দেয় রোহান। রাস্তার ওপর বিরক্ত। আসলেই তো বলা যায় পনেরো মিনিটের পথ। প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগে। ভাবতে ভাবতেই র‌্যাডিসনের পর রাস্তা খালি পেয়ে যায় রোহান; প্রায় একটানে চলে আসে উত্তরায়।
লিফটে চড়ে সোজা রুফটপ। উত্তরায় বেশ কয়েকটি রুফটপ রেস্তোরাঁ হয়েছে এরই মধ্যে। এই রেস্তোরাঁটি রোহানের খুব পছন্দ। রেস্তোরাঁটির বৈশিষ্ট্য হলো এতে বসে এয়ারপোর্ট দেখা যায়। প্লেন উঠছে, নামছে, চমৎকার লাগে দেখতে।
কোনার একটি টেবিলে বসে আছে সানিয়া। প্রায় প্রতি দিন দেখা হয়। আজ এখানে তো কাল সেখানে। এই রেস্তোরাঁতে এলে কোনার টেবিলটাতে বসে দুজন, আজও বসেছে তারা।
-কী খাবে বল?
-অর্ডার দেওয়া আছে।
-তাহলে শুরু কর।
-কী?
-আজ তুমি আমাকে সকাল থেকে এই পর্যন্ত আটবার কল করেছ।
-মোটেও না।
-কললিস্ট বের করব।
-দরকার নেই। তোমাকে আটবার কেন, ষোলোবার ফোন করতে ইচ্ছে করে।
-আমার তো মনে হয় সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলি।
-তেমন লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।
-কী রকম?
-রাইসা বিয়ে করে ফেলল।
-সমস্যা কোথায়?
-মানে! মাত্র ছয় মাসের প্রেমে বিয়ে?
তখনই মোবাইল বেজে ওঠে। নদীর ফোন। রোহান কল রিসিভ না করাতে মোবাইল বাজতে থাকে।
-ফোন ধরছ না কেন?
-বাদ দাও, কী যেন বলছিলে?
-হয় ফোন ধর, না হলে সাইলেন্ট মুডে রাখ।
রোহান কী মনে করে সাইলেন্ট মুডে রাখে।
-রোহান আমার দিকে তাকাও?
রোহান তাকালে সানিয়া বলে—আমাকে আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?
-কেন তুমি না বললে চাকরি করবে।
-ইন্টারভিউ দিতে দিতে ঘেন্না ধরে গেছে?
-কেন?
-ছেলেদের এক রকম প্রশ্ন। মেয়েদের আরেক রকম। চাকরি হবে না বুঝতে পেরেছি? চল বিয়ে করে ফেলি?
-তুমি কি পাগল হলে?
-আমার আর ভাল্লাগছে না। হোস্টেল সুপার কালও বলল আর কত দিন। মা তাড়া দিচ্ছেন বিয়ের জন্য।
-তুমি এত বিয়ে বিয়ে করে কেন?
-বারে অ্যানির ঘটনা জানো, দু বছর আগে বিয়ে করেছে। এখন ডিভোর্স দিয়ে জায়েদকে বিয়ে করেছে।
-তোমারও কি তাই ইচ্ছে নাকি?
-ফাজলামো রাখো। চল বিয়ে করে ফেলি।
-চল বিয়ে করে ফেলি। ভেংচি কাটে রোহান, তারপর বলে—বিয়ে বিয়ে করে পুরো সময়টার নষ্ট করতে চাই না। আমরা নতুন কোন ডিশ নিই, আর মজার কথা বলি।
সানিয়া রোহানের কথা বলার ধরন দেখে হেসে ওঠে। খেতে থাকে। কথা বলতে থাকে দুজন। এরই মধ্যে আরও দুবার ফোন করে নদী। রোহান দেখেও এড়িয়ে যায়।
২.
এদিকে নদী তিনবার ফোন করেছে রোহানকে। ফোন না ধরার কারণ কী? রোহান কি খুব ব্যস্ত? বেশ কিছু দিন ধরেই নদী দেখছে রোহান প্রায়ই ফোন ধরে না। আগে এমন হতো না। বেশ কিছু দিন ধরে এটা ঘটছে। সানিয়া নামের একটি মেয়ের সঙ্গে রোহানের সম্পর্ক চলছে। ব্যাপারটা যে নদী জানে রোহান বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারবে কীভাবে? দুজনের কথা তো খুব একটা হয় না। আর হলেও সেটা একসঙ্গে থাকে বলে। কেন এমনটি হলো? বিয়ের পাঁচ বছর পর এর অর্থ খোঁজাটা অর্থহীন মনে হয়। সবাই বলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য একটা অবলম্বন দরকার। অনেক সময় এই সম্পর্কের অবলম্বন হয় সন্তান। কিন্তু নদী জানে সে মা হতে পারবে না।
প্রায় দু বছর হয়, এটা জেনেছে তারা। তারপর থেকে রোহানের মধ্যে এক ধরনের শৈথিল্য কাজ করতে থাকে। পর্যায়ক্রমে নদীও নিজেকে গুটিয়ে নেয়। রোহান কি ছেলেমেয়ের জন্য বেপরোয়া।?তা নয়। তাহলে? বিয়ের পর জেনেছে ভার্সিটিতে একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল রোহানের। অনেকে বলে মেয়েটি প্রেগন্যান্টও হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা কীভাবে যেন ট্যাকল করেছে রোহান। রোহানের কাছে কয়েকবার জানতে চেয়েছে, রোহান বলেছে এটা অপপ্রচার। অপজিশন পার্টির ছেলেরা তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এ কাজ করেছে।
কিছু যে বলেনি তা নয়, আকার-ইঙ্গিতে সানিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের কথা তুলেছেও নদী। এ ক্ষেত্রে সবাই যা করে রোহান তাই করেছে; স্রেফ অস্বীকার।
আজ কথাটি বলতেই হবে—মনে মনে ঠিক করে নদী।
নদীর খুব গাছপালার শখ। ধানমন্ডি এখন ডেভেলপারদের কারণে আবাসিক এলাকার ঐতিহ্য হারালেও নদীদের বাড়িটি ব্যতিক্রম। এখনো বাড়িটি দোতলা। মূল গেট পেরোলেই সামনে লন। লনের চারদিকে গাছপালা। লনে, বাড়ির ছাদে দেশি-বিদেশি গাছের সমাহার। রোহানের গাছপালা, বাগান কোনোটাতেই ইন্টারেস্ট নেই। রোহানের পছন্দ গাড়ি। প্রায়ই গাড়ি বদল তার স্বভাবে এসে দাঁড়িয়েছে।
রোহানের কী আছে? পরিচয় দেওয়ার মতো না আছে বংশমর্যাদা, না অনেক সম্পত্তির দাপট। পলিটিকস করলেও ছাত্র হিসেবে ছিল অত্যন্ত মেধাবী। এই মেধাকেই পছন্দ ছিল নদীর বাবার। শ্বশুরের পরিচয়ই রোহানের বর্তমান পরিচয়।
৩.
এই পরিচয়টিই রোহানের হীনম্মন্যতার কারণ। নদীও সময়ে-অসময়ে ব্যাপারটি মনে করিয়ে দেয়। রোহান তাই নতুন করে ভাবছে সবকিছু। কেন জানি নদীকে আর ভালো লাগে না রোহানের। সানিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক—এই পদক্ষেপের একটি। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় সানিয়ার সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে দেখা হওয়া, সম্পর্ক তৈরি হওয়া। সানিয়া এখন পর্যন্ত জানে না যে, রোহান বিবাহিত। এই ব্যাপারটি খুবই সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে রোহান। কিন্তু এভাবে কত দিন!
সানিয়ার আকর্ষণ তীব্র। অনেকটা বুনো ধরনের তীব্রতা। সানিয়াকে চাই-ই চাই। তাহলে নদী? নদীকে ডিভোর্স দেওয়া যাচ্ছে না; এত বড় প্রতিষ্ঠা যে শেষ হয়ে যাবে। তাহলে উপায়?
ভাবতে ভাবতে রোহান বাসায় চলে আসে। লনে গাড়ি পার্ক করে বাড়িতে ঢোকে। ডুপ্লেক্স ধরনের বাড়ি। লিভিং স্পেসে ঢুকতেই দেখে নদী সোফাতে হেলান দিয়ে বই পড়ছে। কয়েক দিন আগে কেনা গাছপালার ঔষধি গুণাগুণ বিষয়ক বই। রোহান দোতলায় সিঁড়িতে পা রাখতেই নদী বলে—
-দাঁড়াও...
-কিছু বলবে? অধৈর্যভাবে দাঁড়িয়ে বলে রোহান।
-কেন? তোমাকে কি কিছু বলা যাবে না?
-হেঁয়ালি করছ কেন? যা বলার তাড়াতাড়ি বল।
-আমি কী বলতে চাই, তা তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ।
-মানে?
-তুমি এতক্ষণ কই ছিলে?
-কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
-কোনো চাকরি তো করো না। কাজ এল কোথা থেকে?
-কী বলতে চাও তুমি?
-মিছে কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না। সানিয়া কে?
-ঠিক বুঝলাম না।
-সাধু সাজা হচ্ছে না। তুমি মনে কর সারা দিন ঘরে থাকি বলে কোথায় কী হয় কিছু জানি না। এখানে বসে আমি তোমার সব খবর রাখি। কোথায় যাও কী কর, সব সব খবর পাই।
-তুমি কী আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছ নাকি!
-যদি বলি, হ্যাঁ। বল সানিয়া কে?
-সানিয়া কে এতক্ষণে নিশ্চয় জানা হয়ে গেছে।
-তুমি তোমার বান্ধবীর সঙ্গে ছিলে, সেটা বললেই তো হয়।
-জানোই যখন, ভণিতা করছ কেন?
-তাহলে যা শুনেছি ... ঠিকই শুনেছি। তোমার কি লজ্জা শরম বলে কিছু নেই। ছি... ছি... তুমি এতটা নীচে নেমে গেছ।
-বেশি বাড়াবাড়ি করবে না বলে দিচ্ছি।
-কী করবে তুমি। মারবে?
-দেখো, চুপ করো, নইলে ভালো হবে না।
-কী করবে তুমি? আমার বাড়িতে থেকে আমার বাবার টাকায় বড় হয়ে আমাকে ধমকাচ্ছ? এত সাহস তোমার!
-এভাবে বলবে না। ওই কোম্পানিতে আমার পরিশ্রম আছে। ইনভেস্ট করলেই হয় না।
-তুমি একটা বিশ্বাসঘাতক, লম্পট।
-হ্যাঁ, আমি তাই। কী করবে তুমি... কিছুই করতে পারবে না।
রোহান চলে যায়। নদী দাঁড়িয়ে থাকে। আসলেই কি করা উচিত নদীর? কিছুই কি করা যাবে না? নতুন এক ভাবনায় ডুবে যায় নদী।
৪.
কী করা যায় ভাবনায় পড়ে রোহানও। আর তো সহ্য হচ্ছে না। সম্পর্কহীন ভালোবাসা আর কত দিন। এদিকে সানিয়া অপেক্ষা করতে রাজি নয়। প্রায় প্রতি দিনই তাড়া দিচ্ছে। বেশি দেরি করে ফেললে যদি নদীর কথা জেনে যায়। এদিকে ডিভোর্স দেওয়া যাচ্ছে না নদীকে। কারণ, রোহানের নিজস্ব সম্পত্তি নেই। কিন্তু সানিয়াকে পেতে হলে তো নদীকে সরে যেতে হবে। এই সরে যাওয়াটা কীভাবে সম্ভব। নদীকে মারা গেলে পুরো সম্পত্তি রোহানের হবে। নদীকে কীভাবে মারা যায়, সে ভাবনায় পড়ে রোহান। আর তখনই দার্জিলিংয়ের কথা মনে পড়ে তার। ব্যবসার কারণে অনেকবারই যাওয়া হয়েছে দার্জিলিংয়ে। সেখানে অ্যাকোনিটিং নামক এক ধরনের মিঠা বিষের কথা শুনেছিল। গাছটি দেখতে খুব আকর্ষণীয়, ফুল বেগুনি রঙের। গাছ থেকে বিষটি বেশ জটিল রাসায়নিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয়। বিষটি খুব তাড়াতাড়ি মিশে গিয়ে প্রমাণ রাখে না। আগামী সপ্তাহে দার্জিলিং যাওয়ার কথা তার। খুব গোপনে আনতে হবে ওই বিষ।
এদিকে ভাবনায় পড়ে নদীও। রোহানের মতো চরিত্রহীন, লম্পটের সঙ্গে আর যাই হোক কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর ঘর করা সম্ভব নয়। কিছু একটা করা দরকার-নিজের জন্য যেমন, তেমনি মেয়েটির জন্যও। মেয়েটির সঙ্গে কথা বললে হয়তো একটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু রোহান যে আরেকটি মেয়ের প্রেমে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী? না, রোহানকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। একটা শাস্তি দেওয়া উচিত। শাস্তি কী হতে পারে?
এই ভাবনাগুলো ভাবছিল, আর গাছ পরিচর্যা করছিল নদী। তখনই ম্যানচিনিল গাছের দিকে চোখ পড়ে নদীর। গাছটি রেয়ার। গাছটি মূলত আমেরিকা মহাদেশের হলেও ভারতবর্ষে এসেছে বেশ আগে। বাংলাদেশেও যে পাওয়া যায়, জানা ছিল না। প্রতিবার বৃক্ষমেলায় যায় নদী। এবার সেখানে এক বিদেশি বৃক্ষপ্রেমীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তার কাছেই ম্যানচিনিল নামটি শোনা। কেন জানি যাওয়ার আগে ওই লোক নদীকেই গাছটি দিয়ে গিয়েছিল। যত্ন নিতে পারলে গাছটি বেশ বড় হয়। পাতাটি ঠিক জাম পাতার মতো। ফলটি হয় আপেলের মতো। কাঁচা অবস্থায় সবুজ। পাকলে হলদে সবুজ। খাওয়ার ১০ মিনিট পর মুখ জ্বলতে থাকবে, মাথায় ঝিমুনি আসবে এবং পরক্ষণেই কষ্টদায়ক মৃত্যু। এই বিষ গাছের কথা কেউ জানে না, তাহলে তো সমস্যা নেই। গাছের ফলটি সবুজ। পাকতে কয়েক’দিন লাগবে হিসাব করতে থাকে নদী।
৫.
প্রায় সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা। রোহান ও নদী দুজন একসঙ্গে খেতে বসেছে।
-কত দিন পর একসঙ্গে খাচ্ছি আমরা? হঠাৎই বলে উঠল নদী।
-তুমি আজ না বললে আমিই বলতাম। দার্জিলিং চা এনেছি, দেখলাম তুমি খাওনি। আজ নিজ হাতে তোমার জন্য চা বানাব। কেমন চা বানাতে পারি, দেখাব তোমাকে। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে বলে রোহান।
-খাওয়ার পর একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।
-কী?
-তোমাকে বলা হয়নি। মনে আছে আমার বিদেশি বন্ধুর কথা। ও যাওয়ার আগে ম্যানচিনিল গাছটি দিয়ে গিয়েছিল। এবারই প্রথম ফল ধরছে। ফলটি আপেলের মতো, তোমাকে কিন্তু খেতেই হবে। অনেক দিন পরে অধিকার নিয়ে কথা বলে নদী।
পরদিন কিংবা তার দুদিন পরে রোহান ও নদীর মরদেহ দুটি উদ্ধার করে পুলিশ।