মাস্কের একাল-সেকাল

করোনা মহামারি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে হাত ধোয়া, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা এবং জীবাণুনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি মাস্কের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। প্রতিষেধক আবিষ্কারের নেশায় বিশেষজ্ঞদের খাটুনি অব্যাহত আছে দিন–রাত। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য এখনো আসেনি। এদিকে করোনাভাইরাসও সদম্ভে পুরো বিশ্বকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। করায়ত্ত করছে একের পর এক মানবজীবন! এই যাত্রায় পৃথিবীর পরাক্রমশালী দেশগুলোও যে কত অসহায়, কত দুর্বল ও অক্ষম—তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক কথায় করোনা নামক একটি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে মানবজাতি আজ বড্ড অসহায়!
এশিয়াজুড়ে করোনা দ্রুত বিস্তার লাভ করলে পরে তাইওয়ান, ফিলিপাইনের মতো দেশে পরিস্থিতি বিবেচনায় মাস্ক ব্যবহার আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এই মুহূর্তে করোনা মহামারির কোনো প্রতিষেধক না থাকায় বিশেষজ্ঞদের মতে নিরাপদ দূরত্ব (ছয় ফুট/দুই মিটার দূরত্ব) বজায় রাখা, জনসমাগম এড়িয়ে চলাসহ গৃহবাসই হলো করোনা প্রতিরোধের মহৌষধ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে উপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধিকতর সচেতনতা দেখাতে গিয়ে আমরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুকূপে পা বাড়াচ্ছি। বিশেষ করে বাংলাদেশের অলিগলিতে মাস্কের পসরা বসিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদেরও দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। তারা ভাইরাস প্রতিরোধে নিরাপদ দূরত্ব অমান্য করে নিজেদের তো বটে পুরো দেশটাকে সংক্রমণের ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছেন।
হুজুগে বাঙালিদের মাস্কপ্রীতি দেখে যদি ভাবেন মাস্ক এশিয়ানদের প্রচলিত ঝোঁক, তাহলে নেহাতই ভুল করবেন। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে এশীয়দের মতো এতটা মাস্কপ্রীতি নেই, তবুও এই মাস্কের আদি ব্যবহার পশ্চিমা দেশেই প্রোথিত। মাস্কের ব্যবহার স্মরণকালের ভয়াবহ মহামারি স্প্যানিশ ফ্লুর (১৯১৮ সাল) আগে থেকেই চলে আসছে। যদিও বিশেষজ্ঞগণ ফ্লু প্রতিরোধে মাস্কের কার্যকারিতা বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন।
কুইন্স ইউনিভার্সিটি অব বেলফাস্টের ওয়েলকাম উলফসন ইন্সটিটিউট ফর এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের ড. কনর বামফোর্ড বলেছেন, ‘সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেই ছোঁয়াচে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কার্যকরভাবে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব’। ১৯১০-১৯১১-এর মানচুরিয়ান প্লেগের (চীনের উত্তর পূর্ব) সময় চীন, জাপান, রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়ান বিজ্ঞানীরা মাস্ক ব্যবহার করে প্লেগের বিস্তাররোধে কার্যকর ফলাফল পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানবিষয়ক সাংবাদিক লোরা স্পিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯১১ সালের মানচুরিয়ান প্লেগ প্রতিরোধে মাস্কের কার্যকারিতার পর জাপানিরা ১৯১৮ সাল থেকে জনসমক্ষে মাস্ক পরতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের শুরুতে প্যারিসের একাডেমি ডি মেডিসিনের কমিটি ফরাসি বন্দরে মাস্ক পরার সুপারিশ করেছিল। ম্যানচেস্টারের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার নিভেনও উত্তর ইংল্যান্ডে একই সুপারিশ করেন।
মাস্কের ব্যবহারের আদি কথা নিয়ে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক থাকলেও বলা যায়, আমেরিকাই মাস্ক পরাকে বিশ্বময় জনপ্রিয় করে তুলতে নেতৃত্বের আসনে ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের মাধ্যমে স্প্যানিশ ফ্লু সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারি এতই মারাত্মক আকার ধারণ করে, যা বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষকে সংক্রমিত করে। এতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ মারা যান। ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে সানফ্রান্সিসকোতে এই মহামারির ব্যাপকতা বিবেচনায় জনসমক্ষে মাস্ক পরা মার্কিন মুলুকেই প্রথম বাধ্যতামূলক করা হয়। মাস্কবিহীন কাউকে রাস্তাঘাটে দেখা গেলে জরিমানা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কারাবন্দীও করার হতো। ক্যালিফোর্নিয়ার অন্যান্য শহরসহ আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য জনসমক্ষে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা অনুসরণ করেছে। সানফ্রান্সিসকো নগর কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য বোর্ডের সদস্যগণ এবং রেডক্রস সমর্থিত সচেতনতামূলক প্রচারণায় বলা হয়, ‘একটি মাস্ক পরুন এবং আপনার জীবন বাঁচান! মাস্ক ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে নিরানব্বই ভাগ কার্যকর প্রমাণিত’।
মাস্ক পরতে উৎসাহিত করতে সচেতনতামূলক গানও রচিত হয়েছিল। মাস্কের ব্যবহার ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাজুড়ে গতি লাভের ফলে সরবরাহে তীব্র সংকট দেখা দেয়। শিকাগোর প্রোফিল্যাক্টো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির মতো মাস্ক প্রস্তুতকারী বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানও মাস্কের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে আমেরিকার বিভিন্ন গির্জা, কমিউনিটি গ্রুপ এমনকি রেডক্রস মাস্কের বর্ধিত চাহিদা পূরণে একযোগে কাজ করে। চিকিৎসাক্ষেত্রে ডাক্তার ও সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষার মান নিশ্চিত করতে মাস্কের ব্যবহার বিশ্বের সর্বত্র লক্ষণীয় হলেও কালের বাঁকে বাঁকে বিধ্বংসী সব মহামারিই মাস্ক ব্যবহারের সংস্কৃতিকে আমজনতার মধ্যে জিইয়ে রাখছে।