আমরা সঠিক পথে হাঁটছি তো?

করোনায় আক্রান্ত পৃথিবী ক্রমে সেরে উঠছে। সেই সঙ্গে লুকিয়ে থাকা স্নিগ্ধতা উঁকি দিচ্ছে। আর আমরা বীরের জাতি বাংলাদেশের মানুষ সেই স্নিগ্ধতার বুক চিরে দূরের জানালায় তাকিয়ে আছি, বিষণ্ন জোয়ারে নিজেদের ভাসিয়ে দিতে কিংবা বলা চলে মুকুটশোভিত মৃত্যুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কোভিড ১৯-এর করাল গ্রাসে সমগ্র বিশ্ব যখন দুঃখের খাঁচা খুলে শীতল মৃত্যুর ফানুস উড়িয়েছে মহাকাশে, ঠিক তখন দক্ষিণ এশিয়ার স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশের বর্তমান নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনাবিহীন অথচ জটিলতম পদক্ষেপ আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।
দেশে লকডাউন কার্যকর, কোভিড ১৯-এর টেস্ট, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা, কোয়ারেন্টিন, গার্মেন্টস বা বিভিন্ন কারখানা, শপিংমল, রেস্তোরাঁ খোলা বা বন্ধ রাখাসহ অনেক বিষয়ে পরিকল্পনার ঘাটতি সুস্পষ্ট এখন। এর ফল ভোগ করছে সাধারণ জনগণ; বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। প্রতিনিয়ত আমাদের ভাবনায় কড়া নাড়ছে কেবল একটিই প্রশ্ন— -আমরা সঠিক পথে হাঁটছি তো!
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার সতেরো দিন পর সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর পর ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এভাবে কয়েক ধাপে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে ছুটি ঘোষণা করা হয়, সেই উদ্দেশ্য মাঠেই মারা যায়। সাধারণ ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে প্রথমেই জনমনে উৎসবের আমেজ যোগ হয়ে যায়। আর তাই গণ পরিবহন, অফিস, স্কুল, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডাসহ জনসমাগমের সব স্থান বন্ধের মধ্য দিয়ে মানুষের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হলেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলার অলিগলি, রাস্তাঘাট, বাজার, পার্ক ও চায়ের দোকান, পাড়া-মহল্লা পূর্ণ হয়ে ওঠে উৎসবের রঙিন আমেজে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও পণ্য পরিবহনের গাড়িতে যাত্রী চলাচল হয়। নানা বাহানায় রিকশা, অটোরিকশাসহ ছোট যানবাহন, প্রাইভেট কার ইত্যাদি চলাচল করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই। এ ছাড়া ফেরি চালু থাকায় ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে চড়ে যাতায়াত করছে অনেকেই।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক, গ্লাভ্স ব্যবহারে নেই গণতৎপরতা। সর্বস্তরে লকডাউন কার্যকর করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে নামে। এতে করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের জমে ওঠে লুকোচুরি খেলা। করোনার ভয়ার্ত অবস্থানকে দূরে ঠেলে সাধারণ মানুষ পুলিশের উপস্থিতিতে মুখে মাস্ক পরে কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; পরক্ষণে আবার যা ছিল তাই! এই লুকোচুরিতে বাংলাদেশ পুলিশের পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও দুর্বল উপস্থিতি জনগণের সামনে ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের কাছে সেনাবাহিনীর অবস্থান যতটা না ভয়ের তার চেয়ে বহুগুণ দৃঢ়তার। অথচ লকডাউন কার্যকরে তাদের কঠোর অবস্থানকে ঢেকে রেখে এতটা দুর্বলভাবে মাঠে আনার কি বিশেষ কোনো কারণ বা প্রয়োজন ছিল!
সাধারণ ছুটিতে কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান ও জরুরি পরিষেবার পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা চালু রাখার কথা বলা হয়। সে সময় অধিকাংশ গার্মেন্টস বন্ধ থাকলেও সেগুলো বর্ধিত ছুটির আওতায় থাকবে কি না, সে বিষয়টি অস্পষ্ট থাকে। তখন পোশাক শ্রমিকদের একদফা ডেকে এনে ফিরিয়ে দেয় মালিকপক্ষ। শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসে আপন কর্মক্ষেত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। তখন এর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসলে আমাদের মন্ত্রিপরিষদের প্রতিটি কাজেই প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি বিভিন্ন পদে আসীন ব্যক্তিবর্গ কেবল আপদ হিসেবেই সামনে আসেন।
যা হোক, এরপর আবারও গার্মেন্টস শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। মালিকপক্ষ যদিও বলছে, ঢাকার বাইরের কোনো শ্রমিক তারা এই মুহূর্তে কাজে নিয়োগ দিচ্ছেন না। কিন্তু সত্য হচ্ছে প্রায় প্রতিটি গার্মেন্টস মালিক তাদের ইচ্ছামতো সারা দেশ থেকে শ্রমিক এনে কারখানা চালাচ্ছেন, আর লে-অফের কথা না-ই বা বললাম। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়নি।
শ্রমিকেরা তো আর গার্মেন্টসে থাকেন না। তাঁরা রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে কিংবা ভিন্ন কোনো মাধ্যমে কর্মস্থলে পৌঁছান। কর্মস্থলে প্রবেশ এবং ঘরে ফেরার সময় কতটা সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মেনে চলা সম্ভব হয় তাঁদের? বিষয়টি এমন যখন, তখন তা কতটা ভয়ানক হতে পারে, আমরা কী একটিবারের জন্যও ভেবেছি? মালিকদের কথা হচ্ছে, শ্রমিক মরে যাবে যাক, কিন্তু মরার আগে আমাকে দুটো ফোঁড় দিয়ে যাক। সরকার গার্মেন্টস মালিকদের এই হঠকারিতায় ডুবে গিয়ে মালিকের মুনাফার স্বার্থে শ্রমিকদের মৃত্যুকূপে ঠেলে দেওয়ায় নীরব শরিক হচ্ছে বৈ ভিন্ন কিছু নয়। অথচ কৃষকের ধান কাটার এই মৌসুমে দেশের অনেক জায়গাতেই শ্রমিক প্রবেশ করতে না পারায় সোনার ফসল অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।
আর হ্যাঁ লকডাউনের আগের কিংবা পরের নয়, অর্থাৎ লকডাউনের এই সময়ে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণে তৈরি করা পোশাক গ্রহণের ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতামত নিয়েও কি আমরা ভেবেছি! নাকি শিপমেন্ট বাতিলের নামে আরও একবার প্রণোদনা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। লকডাউন চলাকালে দেশবাসী যখন চরম আতঙ্কে, তখন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় এভাবে গার্মেন্টস খুলে দেওয়াটা ওপরমহলের কোনো চাপ, নাকি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত, বিষয়টি ভাববার তো বটেই!
ইতিমধ্যে ডিএমপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রমজান পালনের লক্ষ্যে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাঁচাবাজারসহ নিত্যপণ্যের দোকানপাট খোলা রাখা হচ্ছে , আগে যা ছিল দুপুর ২টা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, ইফতার বিক্রির জন্য কিছু রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে এবং কিছু শপিংমলও উন্মুক্ত থাকছে। এখানেও রাজমহলের অধিবাসীদের জন্য রাজকীয় ব্যবস্থা। অর্থাৎ, লকডাউন সফলতার শতভাগ উপভোগ করে উচ্চবিত্ত আরও উচ্চে আসীন হয়ে আয়েশি জীবনযাপনে এগিয়ে গিয়ে শোষণের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। আর ক্ষুধার তাড়নায় ক্ষয়িষ্ণু দেহে ব্যর্থতার সহস্রগুণ বেশি, ভার বহন করে যেতে হবে খেটে-খাওয়া ছা-পোষা মানুষগুলোকে। যা হোক, এখানেও ভাববার বিষয় হলো—প্রথমত, বাংলাদেশের করোনাভাইরাস কি দিন কানা, নাকি সে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘুমায়! দ্বিতীয়, রমজান মাসে কাঁচাবাজার, রেস্টুরেন্ট কিংবা শপিংমলে করোনা প্রবেশ করবে না?
নীতিনির্ধারকদের গার্মেন্টস, শপিংমল কিংবা রেস্টুরেন্টে করোনা প্রবেশের আগে হয়তো অনুমতি নেবে, কিন্তু যারা ইতিমধ্যে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছে, তাদের কী হবে? এখন পর্যন্ত চীনসহ বিশ্বের যেসব দেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সফলতা দেখিয়েছে, তারা নির্ভর করেছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং লকডাউনের মতো পদক্ষেপের ওপর। নিয়মের প্রতি অনিয়ম কখনো টিকে থাকেনি। মানুষ যেখানেই নিয়ম ভঙ্গ করে ঘর থেকে বের হয়েছে, সেখানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অর্থের চাকা তো মানুষই ঘোরায়। মানুষ বাঁচলে অর্থনৈতিক ক্ষতি, কিছুটা কষ্ট কিংবা দেরিতে হলেও পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু মানুষই যদি না বাঁচে, তাহলে অর্থনীতি দিয়ে কী হবে?