করোনা যুদ্ধের শেষ কয়েকটি দিন...

আব্বা আম্মা স্বপ্নের দেশ আমেরিকা পাড়ি জমালেন ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইমিগ্রান্ট হিসেবে। তাঁদের যাওয়ার আগেই আমি তাঁদের শূন্যতা উপলব্ধি করতে পারলাম। মনস্থির করলাম, আমিও পরিবার নিয়ে আমেরিকা যাব। ২০১৯ সালের কোনো এক ঈদ উদ্‌যাপন করব আব্বা আম্মার সঙ্গে। কিন্তু ভিসা পেতে পেতে ১৪ মাসের মতো সময় লেগে গেল কোনো এক অজানা কারণে। যা হোক, এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে টিকিট কাটলাম, সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ যাত্রার ডেট ফিক্সও হলো। আব্বা আম্মা খুব খুশি হলেন—এবার আমরা আবার একসঙ্গে হব, ঘুরে বেড়াব। এরই মধ্যে করোনা আতঙ্ক শুরু হলো। পুরো নিউইয়র্ক শহর লকডাউন হলো।

আসল যুদ্ধটা শুরু হলো এপ্রিল মাসের ৬ তারিখ থেকে। আব্বা হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করলেন। গায়ে জ্বর ছিল। কয়েক দিন পর কাশিটাও বেড়ে গেল। এর মধ্যে বাসায় বসে করোনার ট্রিটমেন্ট শুরু হলো। এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখে আব্বার সঙ্গে কথা বলার সময় বুঝলাম, আব্বার একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আম্মাকে বললাম আর দেরি করা যাবে না। ১৭ তারিখ আব্বা দুপুরে গোসল করে বের হওয়ার পর তীব্র শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে লাগলেন। আমার ডাক্তার খালা আর দেরি না করে ইমার্জেন্সি নম্বর ৯১১-এ কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেন। আব্বা আর নানা দুজনেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। শুরুতে কেবিনেই ছিলেন। আমার সঙ্গে আব্বার শেষ কথা হয় ১৭ তারিখেই। আব্বা জানালেন, তাঁর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ১৮ তারিখ আব্বার অবস্থা খারাপ হওয়াতে, ইন্টিবিউটেড (ভেন্টিলেশন) হয়ে আইসিইউতে শিফট হলেন। সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। এরই মধ্যে অনেক আশার আলো দেখতে পেলাম। মনে স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলাম। এই বুঝি আব্বা করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসছেন। বিগত ২১টি দিন কাটিয়েছি আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষায়। এই বুঝি শুনব আব্বা সুস্থ হয়ে উঠছেন। আমিও ঠিক করলাম, সব ঠিক হয়ে গেলে আব্বা আম্মাকে দেশে নিয়ে আসব। অনেক আজেবাজে চিন্তা মাথায় আসছিল, পাত্তা দিইনি। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেছিলাম, ভাবলাম আল্লাহ হয়তো পরীক্ষা নিচ্ছেন। এভাবে ২১টি দিন চলে গেল অনিশ্চয়তায়।

২০ দিনের মাথায় করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন আমার নানা। ৮ মে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে বিধাতার ডাকে। মনে আশা রেখেছিলাম, আল্লাহ বুঝি এবার নিশ্চয়ই আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেবেন, তাঁকে জয়ী করবেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ব্যতিক্রম। নানা চলে যাওয়ার একদিন পরই ৯ মে আব্বার অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। ব্লাড প্রেসার ফল করছিল ক্রমাগত, সঙ্গে ইউরিন পাস হচ্ছিল না। সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট। ভোর ৪টার দিকে খালার কাছে হাসপাতাল থেকে জরুরি কল এল, তাড়াতাড়ি গিয়ে রোগীকে শেষবারের মতো দেখার জন্য। আব্বার সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছিল।

খালা আর আম্মা অন্তিম মুহূর্তে আব্বাকে দেখে এলেন। আমি আর আমার ছেলে শেষবারের মতো মোবাইলে আব্বাকে ডাকলাম হাজারো মাইল দূর থেকে। সুরা ইয়াসিন পড়ে বাবাকে ফুঁ দিলাম, কোনো রেসপন্স করলেন না। আম্মাও গিয়ে দেখে এলেন, পরম মমতায় আব্বাকে একটু ছুঁয়ে দিলেন। তার ঠিক ঘণ্টাখানেক পর খবর পেলাম, আব্বা নেই, চলে গেছেন বিধাতার ডাকে। এও বুঝি এক পিছুটান, যেন নানা আব্বাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। আব্বা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সময় খুব দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু কাউকে কিছু না বলে চেপে গেছেন। শুধু একাকী লড়ে গেছেন এক অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত।

আজ পরিবারের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটল। আমার মা হারিয়েছেন একাধারে তাঁর বাবাকে ও ৩৯ বছরের সুখ-দুঃখের লাইফ পার্টনারকে। আর কোনো দিন আব্বাকে আর দেখতে পাব না। আমার ছেলেও হারাল তাঁর প্রাণপ্রিয় দাদাকে।
বিদায় বেলায়, আমরা ছেলেমেয়েরা তাঁর পাশে থাকতে পারলাম না। আব্বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও পারলাম না। আব্বার কবরে এক মুঠো মাটিও দেওয়ার সৌভাগ্য হলো না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দূর থেকেই আব্বাকে বিদায় জানাতে হলো।

ছেলে আমার স্কেভেটরের পাগল। আব্বা যখন দেশে ছিলেন, তখন বাবুকে স্কুলে আনা নেওয়ার দায়িত্ব আব্বাই পালন করতেন। নাতি আর দাদার মধ্যে স্কেভেটর নিয়ে নানা রকম গল্প চলত। নাতির আবদার দাদা যাতে একটা স্কেভেটর তাকে কিনে দেয়, তা সে দাদাকে নিয়ে চালাবে। আজ সেই স্কেভেটরে করেই আব্বাকে কবরে রাখা হলো। আর নাতি এক অশ্রুসিক্ত নয়নে দাদাকে বিদায় জানাল হাজার মাইল দূর থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। আব্বা হয়তো বিদায়কালে আমাদের পাশে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিধাতার হুকুম ছিল ভিন্ন।

আব্বা আজ নেই, তবুও আব্বাকে আমি ধারণ করতে চাই আমার প্রতিটা নিশ্বাসে আব্বা থাকবেন আমার কর্মে-ধর্মে। সবাই আমার আব্বার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমার আব্বা আর নানাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

নিজের এই প্রিয়জন হারানোর বেদনা নিয়েই সবার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, এই করোনা ক্রান্তিলগ্নে আপনারা সবাই বাসায় থাকুন, নিরাপদে থাকুন। আমি চাই না, আমাদের মতো আর কারও সাজানো পরিবার এভাবে ধ্বংস হোক একটি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে। কেউ অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ না করে লড়াই চালিয়ে যান। আমাদের তো অনেক পরিবারের কাছেই ২০২০ সালটা প্রিয়জন হারানোর বেদনা নিয়ে এসেছে। এই শোক যেন শক্তিতে পরিণত হয়, সে চেষ্টাই সবার করতে হবে।