রবীন্দ্রনাথ ও করোনা ভাবনা

যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।

১৯৪১ সালের ১৮ জানুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর একান্ত প্রত্যাশার কথাটি বললেন। রবীন্দ্র-অনুরাগীরা ওই কবিতার অন্য কটি পঙ্ক্তির প্রতিও কিন্তু সমান মনোযোগী ‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তা যত উঠে ধ্বনি/আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।’
পৃথিবীর ধ্বনি তো কেবল পাখির কাকলি নয় বা নদীর কল্লোল বা পুষ্প বিকাশের সুর কি বনের মর্মর ধ্বনিই নয়, উৎপীড়িতে ক্রন্দন রোল, দাম্ভিকের মূঢ় আস্ফালন, অস্ত্রের ঝনঝনা, বঞ্চিতের নিত্যচিত্ত ক্ষোভ, আর্তের বেদনাও পৃথিবীরই ধ্বনি। তাই বিপন্ন মানবতা তাঁকে বারে বারে উদ্বেলিত করেছে।

মাত্র ২১ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই বছরের শেষ দিকে বাঁকুড়া-বর্ধমান ও বীরভূম জেলায় দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে আসে। তরুণ সম্পাদক সেদিন বীরভূমের দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের ত্রাণের জন্য ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনা সভায় প্রবন্ধ আকারে একটি প্রস্তাব পেশ করেন, যার অংশ বিশেষ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অল্প কয়েকটি লাইনেই কবির আন্তরিকতা যেকোনো মানুষকে স্পর্শ করে গভীরভাবে—

‘তোমার যদি ভাই থাকে, তবে যাহার ভাই আজ অনাহারে মরিতেছে, তাহার প্রতি একবার মুখ তুলিয়া চাও-তোমার যদি আপনার মা থাকে তবে অন্নাভাবে মরণাপন্ন মায়ের মুখের দিকে তাকাও যে হতাশ হইয়া তাকাইয়া আছে, তাহাকে কিছু সাহায্য কর-তোমার যদি নিজের সন্তান থাকে তবে কোলের ওপর বসাইয়া তাহার শিশুসন্তান প্রতি মুহূর্তে জীর্ণ হইয়া মরিতেছে, তোমার উদ্বৃত্ত অন্নের কিছু অংশ তাহাকে দাও।’

শুধু প্রবন্ধটি পাঠ করলেন না, ত্রাণের কাজে নেমে পড়লেন এবং অন্যকেও দানে ও কাজে উৎসাহিত করলেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র সুদর্শন রবিবাবু কল্পজগতে থেকে কাব্য সাধনার ফাঁকে ফাঁকে, দুঃখ-বিলাসী হয়েছেন, এমন সমালোচনার জবাব, তাঁর উত্তরকালের বিস্তৃত কর্মসাধনা।

মানুষের স্মৃতিতে মননে শতবর্ম-নকশি কারুকার্যে জড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কবির মানবপ্রেম ক্ষণিকের আবেগ ও উত্তেজনা নয়। জমিদারি দেখাশোনা করতে করতে, পদ্মা বেয়ে চলতে চলতে দুপারের নিরন্ন অসহায়দের দেখতে দেখতে তাঁর যে মনে হতো-‘এরা বিধাতার শিশু সন্তানের মতো-নিরুপায়-তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই।’ সেই অন্তহীন মায়া তাকে কর্মবীরে পরিণত করেছে। নিচের তলার ক্ষুধিত বঞ্চিত মানুষের জন্য ভেবেছেন, তাদের উন্নতির জন্য পথের সন্ধান করে, লক্ষ্যে পৌঁছাতে নিজেই কঠিন কাজে নেমে পড়েছেন তিনি, যাঁর মাথায় বিশ্বকবির শিরোপা। রবীন্দ্রনাথ এই দরিদ্র সহায়হীন মানুষের বিধাতা হতে চাননি, চেয়েছেন মানবজমিন চাষ করে শস্য-শ্যামলে পরিণত করতে। তিনি তাঁর সাধ্যমতো সে কাজে এগিয়েছেন সেই পরাধীন ভারতবর্ষেও, কিন্তু তাঁর উত্তরকালে স্বাধীন ভারতে সেই মানবজমিনকে রাখল পতিত করেই। তাই আজও মহামারি ও মড়ক-মন্বন্তরে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল ভারতবর্ষ।

এই মুহূর্তে, মুহূর্তে গোটা পৃথিবী অদৃশ্য বিশ্বের ত্রাস করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। জীবপালিনী আজ এক প্রকাণ্ড মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। পরিত্রাণের পথ খুঁজছে সবাই। আর এই ভয়ংকর বিশ্ব মহামারির সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না, আপাত অপরাজেয় শক্তি, গগনচুম্বী দম্ভ; অপার বৈভব। পৃথিবীর সিংহভাগ সম্পদ যে লুণ্ঠন করে স্তুপিকৃত করে রেখেছে, সেই আমেরিকায় করোনার থাবা সব থেকে বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আমেরিকার রাষ্ট্র নায়েকেরা এখন গরিব মানুষ যেমন শূন্য জঠরে প্রহর গুনে, তেমনি হাজারে হাজারে লাশ গুনতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই একই মৃত্যুর মিছিল চলছে ইতালি থেকে স্পেন, ফ্রান্স থেকে ব্রিটেন, জার্মান, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের দেশে দেশে। একটি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে জীবলোকের শ্রেষ্ঠ মানুষের এই আপাত পরাজয় বেআব্রু করে দিচ্ছে একটা নিত্যকালের সত্যকে, যার ভাষ্যকার রবীন্দ্রনাথ—

যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।

ডলারের সুখ-সাগরে ভেসে বেড়ায় যে আমেরিকা, কোটি কোটি ডলার মূল্যের সমরাস্ত্রে সজ্জিত আমেরিকার যে আধিপত্যে ক্ষতবিক্ষত পৃথিবী, সেই স্বঘোষিত বিশ্বপতি আজ অসহায়, একটা সুক্ষ ভাইরাসের কাছে। তার ঐশ্চর্য, তার সমরসম্ভার, তার মহাকাশে অভিযান নানান ঠিকানা সংগ্রহ, তার প্রযুক্তি, তার চরম আধুনিকতা কোনো কিছুই বাধা দিতে পারছে না এই মরণের খরস্রোতকে। আমেরিকার চোখ ধাঁধানো সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের তলাটা যে একেবারে ফাঁকা, তার প্রমাণ করছে শব-সংখ্যার এই ব্যাপকতা। এই জাতীয় বিপর্যয় রোধ করতে পারছে না, কারণ পুঁজিবাদের যে মুনাফা বঞ্চনার ওপর ভর করে তার ইমারত গড়ে তোলে, সেই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যই সে এ ধরনের কাজে ব্যর্থ হয়।

প্রথমত, সম্পদের সমবণ্টন অসম্ভবের অসম্ভব। সম্পদ কুক্ষিগত করাই পুঁজিবাদের ধর্ম। দ্বিতীয়ত, সম্পদের কেন্দ্রীভবন হয় বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট এই বঞ্চিতের দল, মানুষের অধিকার থেকেও বঞ্চিত। তাদের অশিক্ষা, দুর্বিষহ অস্বাস্থ্য, অন্নচিন্তা, জাতিকে দুর্বল করে রাখা ধনবৈষম্যের ইতরতায় ভরা জাতিগুলো শক্তিহীন হয়ে বিপর্যয়ের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালে সমাজে পুঁজির এই দৌরাত্ম্য দেখেই হয়তো তাদের দুর্গতিটাও আরও অনুমান করতে পেরেছিলেন, তাই তাঁর কলমের অমোঘ ঘোষণা—

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।

শতবর্ষ আগেও যখন এক ভয়ংকর প্রাণঘাতী জ্বর আমেরিকা নিজের দেশের সংবাদমাধ্যমের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে, স্প্যানিশ ফ্লুতে রূপান্তরিত করল স্পেনের একটিমাত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ায়, সেদিনও ইউরোপ-আমেরিকা তাদের অর্থ-পরাক্রম দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। সারা পৃথিবীতে প্রায় দশ কোটি মানুষকে এই স্প্যানিশ ফ্লুতে জীবন দিতে হয়েছিল। অথচ তারই পাশাপাশি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্যোজাত সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, জারের শোষণে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া-ভেঙে পড়া অর্থনীতি নিয়েও মানুষের সম্মিলিত শক্তিতে ভর দিয়ে সামান্য ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে এই মরণব্যাধি থেকে দেশকে রক্ষা করতে পেরেছিল।

পুঁজিবাদে চলে নিরন্তর এই শক্তির নির্বাসন। রক্তকরবীর এই নাট্যকার, বিশ্বকবি দেখিয়েছেন মানুষের কি নিদারুণ অপচয়! তীব্র শোষণ, ক্ষুধা-তৃষ্ণার চাবুক দিয়ে মানুষকে মনুষ্যত্ব শূন্য করে দেয়। পুঁজিবাদে আছে এই পশুবৃত্তি, যার কাছে মানুষ আর তার মনুষ্যত্বের দাম নেই কানাকড়িও। ফলে, পৃথিবীর সব থেকে উন্নত অর্থনীতির দেশ বলে যার দম্ভ, সেই আমেরিকার উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বের কাছে গাল-গল্পের আখ্যা লাভ করেছে। জনসাধারণ, যাদের হোয়াইট হাউস কোনো দিন মানুষ বলে জ্ঞানই করেনি, তাদের প্রতি সীমাহীন শোষণ–বঞ্চনা আজ সামান্য করোনায় মৃত্যু হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে দুনিয়ার সামনে।

রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্র ও সমাজ চরিত্র যেমন নানা লেখায় বিশ্লেষণ করেছেন, তেমনি শেষ জীবনে রাশিয়া পরিভ্রমণে তাঁর তীর্থ দর্শনের পূর্ণতার কথাও অকপটে বলেছেন, তেমনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পদানত স্বদেশের ব্যথা-বেদনা। শক্তি ও দুর্বলতাকে তিনি সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু তিনি সেখানে থেমে থাকলেন না। তিনি নেমে পড়লেন গ্রাম-সংস্কারে, ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রায় সর্বস্ব নিয়ে পল্লি-উন্নয়নে। নিজের দেশের ঔপনিবেশিক অর্থনীতি, উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা—এই তিন ধরনের অর্থনীতি ও তার সমাজ উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করেছেন। রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন এবং মনে মনে আশস্ত হয়েছেন, মনুষ্যত্বের মহিমায় আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীর দিন আগত ওই।

রবীন্দ্রনাথ খুব কাছে থেকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন শোষিত-নিপীড়িত-রোগজীর্ণ ন্যুব্জ দেহ-দুর্বল অপমানিত ভারতবর্ষকে। মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও তিনি তাঁর বিশ্বাসে অনড় ছিলেন যে, ‘ইংরেজও হন সেই সভ্য শিকারির দল পোষমানা শাপদের মতো। দেশ-বিদেশের মাংস করছে বিক্ষত।’ ফলে তাদের ‘সিংহাসন তলচ্ছায়ে ভারতবর্ষ দৈন্যজীর্ন প্রাণ।’ কবির অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য উপলব্ধি-

রুদ্ধ আরোগ্যের পথে রোগের অবাধ অভিঘাত,
সেথা মুমূর্ষু দল রাজত্বের হয় না সহায়, হয় মহাদায়।

যে পাখির একটাই পাখা শীর্ণ, ঝড়ের সংকটে সে ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। সেই অনেক জানা-অনেক বোঝা থেকেই রবীন্দ্রনাথ মানুষের উন্নয়নে হাত লাগান তার সব সাধ্য নিয়ে। যেমন–ধনী ইউরোপ ধনী শ্রেষ্ঠ আমেরিকার, ঠিক তাদেরই ফাঁপা অর্থনীতির পথ ধরে চলার কসরতে থাকছে ভারত-বাংলাদেশ। দেশের উন্নয়ন মানে যে কেবল ঝকঝকে রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভারের সংখ্যাবৃদ্ধি, করপোরেট প্রভুদের হাত শক্ত করা আর গরিবকে কিছু ত্রাণ, রুটি ছুড়ে দেওয়া নয়—ভারত-বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কেরা সেদিকে মনোযোগ দেননি। আত্মপ্রচার আর দান-খয়রাতির ঢক্কা-নিনাদে গরিবের উন্নয়ন কোথায় তলিয়ে যায়। দারিদ্র্য-অশিক্ষা-পরনির্ভরতার গভীর অসুখ থেকে বাংলার মানুষ স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও পায়নি মুক্তি করোনার আগ্রাসনে, তা দগদগে ঘা হয়ে দেশকে ছেয়ে ফেলছে।

১৯৩০ সালে রাশিয়া ভ্রমণেও তাই প্রত্যক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘দেখছি রাশিয়ার মস্কো নগরীতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের আরোগ্য বিস্তারের কী অসামান্য অকৃপণ অধ্যবসায়।’ কবিও সেই অধ্যবসায়ের সংকল্পকে রূপ দিয়েছেন আজীবন—

আমারে যে নামাতে হবে ঘাটে ঘাটে,
বারে বারে এই ভুবনের প্রাণের হাটে।

তেমন করে মানুষের প্রাণের হাটে আর কেউই নামেননি। তাই উন্নয়ন আজও ব্যবসা-বিজ্ঞাপন আর স্বার্থের জঠরে আটকে আছে দেশে দেশে। কবির আনাগোনা হয়েছে ওই প্রাণের হাটেই। যোগ করেছিলেন জীবনে–জীবন। রবীন্দ্রনাথ হয়তো একজনই, যিনি ‘আরাম হতে ছিন্ন করে’ নিজেকে নিয়ে গেছেন সেই গভীরে, ‘অশান্তির অন্তরে যেথায় শান্তি সুমহান।’ সুমহান তিনিও তাই মানুষের স্মৃতির অর্ঘ্যে শুধু নয়-আছেন চেতনার আদ্যান্ত বুননে।

মানুষ দুর্জয়।
এই দুর্জয় মানুষ কি তাঁর সৃষ্টি নয়, যিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোকে পাপ মনে করে, মানুষকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ সম্মান, ঘটিয়েছেন তার আত্ম-উদ্বোধন? রবীন্দ্রনাথের চিন্তার আলো নতুন নতুন প্রাণ গড়েছে। অপমানে পরিক্লান্ত বিশীর্ণ মলিনকে কবি দিয়েছেন সাহস, কণ্ঠে দিয়েছেন বিদ্রোহের ভাষা। আর তাই, তারই জন্য—

সকল কথার বাহিরেতে ভুবন আছে হৃদয় পেতে।