বেকারভাতা দিলেও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

নিউইয়র্কে কর্মহীন মানুষ এখনো চোখে অন্ধকার দেখছেন। নাগরিক সহযোগিতা, বেকারভাতা, বিনা মূল্যে খাবার, কমিউনিটির সহযোগিতার পরও সামনের দিনগুলো নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশি আমেরিকানরা। একদিকে চলমান সংকট, আরেকদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় ভালো নেই তারা। কেউ আবেদন করেও বেকার ভাতা পাননি এখনো। নিউইয়র্ক খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। করোনার করাল গ্রাসে বদলে যাওয়া জনপদে কর্মসংস্থান আর ব্যবসা-বাণিজ্য কেমন হবে, এটি নিশ্চিত নন কেউ। এখনো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তাড়া করছে। এমন বাস্তবতায় নিজেদের ভাগ্যের হাতে যেন শপে দিয়েছেন অনেকেই।

গত দুই মাস আগে বেকারভাতার জন্য আবেদন করেন কুইন্সে বসবাসরত বাংলাদেশি আমেরিকান ক্যাবচালক সাঈদ আহমদ। তিনি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে বলেন, ‘করোনায় নিউইয়র্ক নগর যখন লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তখনই কাজ বন্ধ করে দিই। তার কয়েক দিন পর বেকারভাতার জন্য আবেদন করি। দিনের পর দিন কাস্টমার সার্ভিসে কল করি। একপর্যায়ে লেবার ডিপার্টমেন্ট থেকেও কল আসে এবং তাঁরা বলছে, সব ফাইল প্রক্রিয়াধীন। আজ দীর্ঘ দুই মাসের বেশি হয়ে গেছে কিন্তু ফাইল আগের জায়গাই আছে। 

সাঈদ বলেন, ১২ এপ্রিল একটি মেইল এসেছে এবং তিনি আবার সব ফাইল লেবার ডিপার্টমেন্টের ঠিকানায় পাঠিয়েছেন। তবে কবে বেকারভাতার চেক আসবে, সেটা বলা মুশকিল। আর এভাবে অর্থ সংকট, বাসা ভাড়া, গাড়ির ভাড়া, ইন্স্যুরেন্স ও পরিবার নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশি আমেরিকান।

মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্বেই বেকারত্ব বাড়ছে। আমেরিকায় বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। করোনা শুরুর পর তিন কোটির বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছে দেশটিতে। ১৯৩০ সালে বিশ্ব মহামন্দার পর এতটা খারাপ সময় পার করেনি দেশটি। সব মিলিয়ে বেকার ভাতার আবেদন জানিয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখের বেশি মানুষ। অথচ মাত্র এক মাস আগেও দেশটির বেকারত্বের হার ছিল মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ; যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বেকারত্বের দিক দিয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের এখন একটাই চিন্তা, কবে নিউইয়র্ক সেই চেনা রূপে ফিরবে। বেকারভাতার জন্য যাঁরা আবেদন করেছেন তাঁদেরও ঘুম নেই। হঠাৎ করে কাজ হারিয়ে এসব কর্মহীন মানুষ বেকারভাতা পাননি। কেউ কেউ না পাওয়ার আশঙ্কায় দুই থেকে তিনবার বেকারভাতার জন্য আবেদন করেছেন। যার কারণে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে।

বেকারভাতার অপেক্ষার সঙ্গে যোগ হচ্ছে স্বরূপে নিউইয়র্ক ফেরার নতুন আতঙ্ক। কারণ একজন কর্মহীন নাগরিক ৩৯ সপ্তাহ বেকারভাতা পাবেন। তারপর কী হবে, সেই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন নগরের নাগরিকেরা। একদিকে করোনার মৃত্যু ও আক্রান্তের আতঙ্ক। অন্যদিকে বেকারভাতার অনিশ্চয়তা!

নিউইয়র্কে এমন কঠিন সময় গত ২০ বছরে দেখেননি বাংলাদেশি আরেক ক্যাবচালক রাজু আহমেদ। তিনি বলেন, কাজ হারিয়ে ঘরবন্দী প্রায় তিন মাস। কর্মহীন হয়ে পড়া রাজুর বাবা-মা করোনার আগে দেশে গিয়েছিলেন। একদিকে বাংলাদেশে আটকে পড়া পরিবারের টেনশন, অন্যদিকে গতিশীল জীবন হঠাৎ থমকে যাওয়ায় বেঁচে থাকাটাও যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ, সেটাও বললেন তিনি।

কথা হয় আরেক বাংলাদেশি কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, লকডাউনের পর থেকে পরিবার ও ছোট দুই সন্তানের কথা চিন্তা করে এখনো ঘর থেকে বের হননি। বন্দী জীবনে আরও কঠিন সময় পার করছেন। বেকারভাতার জন্য আবেদন করেও এখনো হয়নি কোন অগ্রগতি। পরিবারের অন্য সদস্যরা গ্রোসারি বা বাজার করে দিচ্ছেন বলে এখনো বেঁচে আছেন।

আমেরিকায় মৃত্যুর মিছিল এক সপ্তাহ ধরে যদিও নিম্নগতির, তবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই।

মার্কিন শ্রম পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান এরিকা গ্রোশ্যেন বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই এটা (বেকারত্ব হার) নজিরবিহীন। মহামারি থেকে রক্ষা পেতে আমরা অর্থনীতিকে ইচ্ছে করে কোমায় পাঠিয়েছি। এর প্রভাবে বিগত কয়েক যুগের তথ্যাবলিতে লক্ষ্য করা যায়নি, এমন গতিতে চাকরি হারানোর ঘটনা দেখা যাচ্ছে।

মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে অর্থনীতির সব খাতে নিম্নগতির চিত্র তুলে ধরা হয়।

চাকরির বাজার সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে আতিথেয়তা এবং অবসরকেন্দ্রিক বিনোদন সেবা খাতে। এ খাতে বেতনভোগী কর্মীর সংখ্যা কমেছে ৭৭ লাখ, যা মোট কর্মশক্তির ৪৭ শতাংশ।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত খাত আছে এর পরেই। এ দুটিতে মোট ২৫ লাখ পদ খালি করেছে নিয়োগদাতারা। অন্যদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা ছাঁটাই করেছেন ২১ লাখ কর্মী।

মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয় জানায়, চাকরি হারানোদের তিন-চতুর্থাংশ সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। অর্থনীতি পুনরায় সচল হলে এসব কর্মী পুনরায় চাকরি ফিরে পাওয়ার আশা করছেন। তবে এই আশায় যে গুড়েবালি, সেটা স্পষ্ট হচ্ছে নিউইয়র্কের রাজ্য গভর্নরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে দেওয়া বক্তব্যে।