জীবন নয়, ট্রাম্পের কাছে রাজনীতিই গুরুত্বপূর্ণ

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

নতুন করোনাভাইরাস মহামারি কতটা প্রাণসংহারী তার প্রমাণ আমেরিকা এরই মধ্যে পেয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালের নথির আওতায় আসা ব্যক্তিদের হিসেবেই কোভিড-১৯-এ দেশটির প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নথির বাইরে গেলে এই হিসাব যে লাখ ছাড়ানোর কথা, সে বিষয়ে এরই মধ্যে আলোচনা হচ্ছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোতে। এদিকে অর্থনীতির অবস্থাও সঙিন। এ অবস্থায় অর্থনীতি ও ভাইরাসের বিস্তার এ দুইয়ের মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য বিধান করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে এসেছে। কিন্তু এই প্রয়োজনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজের গা-জোয়ারি ভাব নিয়েই অর্থনীতি যেনতেনভাবে চালু করতে চান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর এই চাওয়ার পেছনে নিঃসন্দেহে রাজনীতিই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার একই কথা বলছেন যে, তিনি খুব দৃঢ়তার সঙ্গে এই যুদ্ধে লড়তে চান। তাঁর কাছে এটি যুদ্ধই। তবে জীবন বাঁচানোর নয়, নিজের পিঠ বাঁচানোর। সামনেই নির্বাচন। ট্রাম্প অপেক্ষা করছেন দ্বিতীয় মেয়াদে মসনদে বসার জন্য। আর এ জন্য এত দিন ধরে যে অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প তিনি বলে আসছেন, তাকে তিনি অক্ষুণ্ন দেখতে চান যেকোনো মূল্যে।

ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় বেকারত্বের হার হ্রাসের তথ্যকে বারবার করে তুলে ধরেছেন নিজের প্রশাসনের অর্থনৈতিক সাফল্যের সাক্ষ্য হিসেবে। কিন্তু করোনাভাইরাস এই পুরো হিসাবটি ওলট-পালট করে দিয়েছে। বেকারত্বের হার রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে লাফিয়ে রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। লাখ লাখ মানুষ হঠাৎ কাজ হারিয়ে বেকারভাতা পাওয়ার আবেদন জমা দিয়েছে। ১৯৩০-এর দশকের পর এতটা বাজে অবস্থায় কখনো পড়েনি মার্কিন অর্থনীতি।

অর্থনীতির যখন এই বাজে দশা, তখন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বড় কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি ট্রাম্প প্রশাসন। বরং কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাকে বারবার করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় প্রশাসন। এই যখন অবস্থা, তখন ট্রাম্প নিজে কী করছেন? তিনি বরাবরের মতোই ভুলভাল বক্তব্য দিয়ে চমক তৈরি করেছেন। এই চমক মানুষকে আর হাসাতে পারেনি, বেদনার্ত করেছে। মানুষ যখন দেখেছে যে, তাঁদের প্রেসিডেন্ট তাঁদের জীবনের কোনো মূল্যই দিচ্ছেন না, তখন বেদনায় নীল হয়েছেন তাঁরা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জীবাণুনাশক খাওয়ার দাওয়াই দেওয়া ট্রাম্প বারবার করে মানুষের জীবনের সঙ্গে তামাশা করেছেন, যে তামাশা বড় বেদনাদায়ক।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভুলভাল কথা ও অবৈজ্ঞানিক অবস্থান এতটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গিয়েছিল যে, হোয়াইট হাউস তাঁর নিয়মিত ব্রিফিংয়ে আসাটা বন্ধ করা যায় কিনা, সে পথ পর্যন্ত খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই কোনো কিছুই তাঁকে থামাতে পারছে না। তিনি এখন যেকোনো মূল্যে অর্থনীতি চালু করতে চান। নির্বাচনের আগে তিনি প্রদর্শনযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য চান। আর এটি চান তিনি মহামারি মোকাবিলায় নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই।

অর্থনীতি চালুর জন্য, যাকে তিনি বলছেন দেশ খুলে দেওয়া, তার জন্য তিনি যা কিছু করতে প্রস্তুত; তবে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও পরামর্শ না মেনেই। এরই মধ্যে তিনি মিশিগানের মতো যেসব অঙ্গরাজ্য অর্থনীতি চালু করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তাদের প্রশাসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন। আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসিকে সর্বশেষ ১৩ মে তিনি যে এক হাত নিলেন, তাও এই একই জায়গা থেকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সুস্পষ্টভাবেই এই মুহূর্তে নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য সবকিছুকে অগ্রাহ্য করছেন। এমনকি লকডাউন ভাঙতে আর্থিকভাবে ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত জনতাকে উসকাতেও তিনি কিছুমাত্র কার্পণ্য করছেন না, যা রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে একেবারে সাংঘর্ষিক।

অ্যান্থনি ফাউসি ছয়জন এই নিয়ে ছয়টি প্রশাসনের অধীনে কাজ করছেন। ১৩ মে তিনি লকডাউন তুলে দেওয়ার বিষয়ে, আরও ধীর গতিতে এগোনোর পরামর্শ দেন। না হলে আরও বহু মৃত্যু দেখতে হতে পারে বলেও সতর্ক করেন তিনি। ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত গতিতে খুলে দেওয়াটা অজস্র মৃত্যুকে অযথাই ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেন ফাউসি। এই সতর্কবার্তাই ভীষণভাবে চটিয়ে দেয় ট্রাম্পকে। তিনি বলেন, ‘এই বক্তব্য তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষত স্কুল খোলার বিষয়টি।’ অল্পবয়সীদের মধ্যে বয়স্কদের মতো ভাইরাসের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।’

অথচ দু দিন আগে নর্থ আয়ারল্যান্ড লকডাউন প্রত্যাহারের জন্য যে কৌশল ঘোষণা করেছে, তাতে পঞ্চম ধাপে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ খুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা মোট পাঁচ ধাপে লকডাউন প্রত্যাহারের কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে অঞ্চলটির প্রশাসকেরা সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞানী, গবেষক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কর্মীদের পরামর্শ মেনে চলতে চায়। তারা এমনকি লকডাউন তুলে দেওয়ার জন্য কোনো বিশেষ ডেটলাইনের কথাও বলছে না। বিপরীতে আমেরিকায় ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থানটির দিকে তাকালে পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক অংশে মানুষের জীবনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনীতিকেও বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকায় ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান হলো—মানুষ মরলে মরুক, অর্থনীতি বাঁচুক।

কথা হলো এই অর্থনীতি বাঁচাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প এতটা তৎপর কেন? তিনি কী সত্যিই মার্কিন অর্থনীতি এত বেশি চিন্তিত? উত্তরটি সহজ এবং তা হচ্ছে—না। ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনীতি চালু করতে চান আদতে নিজের জন্য। নিজের রাজনীতিকে বাঁচানোর জন্য। পরবর্তী মেয়াদে ওভাল অফিসের চেয়ারটি দখল করাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। আজীবন ব্যবসায়ী ট্রাম্পের কাছে এর বাইরে অন্য যেকোনো হিসাব মূল্যহীন। তিনি প্রাপ্তি বোঝেন শুধু। তা না হলে তিনি অ্যান্থনি ফাউসির মতো ব্যক্তিদের কথা শুনতেন।

এইচআইভি, ইবোলা, জিকা, অ্যানথ্রাক্সের মতো স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা মোকাবিলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ফাউসি জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন কয়েক দশক। তিনি ট্রাম্পের পছন্দের বাস্তবতা দৃশ্যমান না করে তথ্য ও যুক্তি দিয়েই কথা বলেন। আর এটিই তাঁর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মূল বিবাদের কারণ। তিনি শুরু থেকেই বলছেন, স্বাভাবিক জীবনে কবে ফেরা যাবে, তার নির্ধারণ একমাত্র ভাইরাসটিই করতে পারে। অথচ ট্রাম্প বারবার চাপ দিচ্ছেন সুরক্ষা চক্রগুলো গুটিয়ে নিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক করে নিতে। তাঁর ভাষ্যমতে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকা জয়ী হয়েছে এবং এখনই সব স্বাভাবিক করে ফেলা উচিত।

প্রতিটি বক্তব্যে ট্রাম্প অবধারিতভাবে বলছেন যে, তিনি এক যুদ্ধ করছেন। এটা সত্য যে, তিনি যুদ্ধ করছেন। কিন্তু তাঁর এই যুদ্ধ কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়। এই যুদ্ধ যাবতীয় বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞ মতকে পাশ কাটিয়ে নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে অন্য সব দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পদানত করার। এ জন্য এমনকি তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের করা মৃত্যুর হিসাবকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। বলছেন, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি হিসাবে যে সংখ্যা আমেরিকায় তার চেয়ে ঢের বেশি মৃত্যু হয়েছে। ট্রাম্প কোনো কৌশলের ধার ধারছেন না। লকডাউন প্রত্যাহারের প্রস্তুতি হিসেবে গণহারে পরীক্ষা করার ব্যাপারটিও তাঁর কাছ থেকে আসেনি। এসেছে অঙ্গরাজ্য ও নগরগুলোর স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে। এমনকি এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে লড়াইও করতে হয়েছে। অথচ হওয়ার কথা ঠিক তার বিপরীত। এই মহাদুর্যোগেও জনগণের কথা না ভেবে প্রেসিডেন্টের এমন স্বার্থপর আচরণের আর কোনো নজির আছে কিনা, তা সত্যিই খুঁজে দেখা প্রয়োজন।