ট্রাম্পের বড় 'প্রতিদ্বন্দ্বী' এখন অর্থনীতি

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

আমেরিকার অর্থনীতি ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বেকারত্বের হার অভাবনীয় গতিতে বাড়ছে। ভোক্তাদের ব্যয় হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) পতনের ধারায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমেরিকার ইতিহাসে এমন ধারার অর্থনৈতিক বিপর্যয় যতবার এসেছে, ততবার তা পুনর্নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকা গদিনশিন প্রেসিডেন্টের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ঠিক একই অবস্থা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের।

আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র ছয় মাস বাকি। এ অবস্থায় পুরো আমেরিকা নির্বাচনী প্রচার ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুখর থাকার কথা। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলের নেতৃবৃন্দের পরস্পরের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লাগার কথা। এই লড়াইয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত কয়েক বছরে আমেরিকার অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক ধারা বিরাজ করছে, তাকেই পুঁজি করার কথা ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু করোনা সব উল্টে দিয়েছে। যে অর্থনীতিকে নিজের সবচেয়ে বড় অস্ত্র করবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন, তা-ই এখন তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

আমেরিকায় গত দশকের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সাবেক বারাক ওবামা প্রশাসন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তারই সুফল আসতে শুরু করেছিল ২০১৪ সালের পর থেকে। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে এই সুফলগুলোকেই নিজের সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করে আসছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেকারত্বের হার রেকর্ড মাত্রায় কমে আসাকে নিজের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে প্রচার করছিলেন তিনি। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকটে এই সাফল্য এক বিশাল ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আমেরিকায় নতুন বেকার হয়েছেন চার কোটিরও বেশি মানুষ। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা বড় অংশ বন্ধ হয়ে গেছে বা যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। চীনের সঙ্গে বিবাদ, ইউরোপের মিত্রদের পিঠ দেখানো এই সবকিছুই দ্রুততম সময়ে এই সংকট কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

করোনাভাইরাসের কারণে যে মন্দা শুরু হয়েছে, তা আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ২০ মে অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শুধু অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই ট্রাম্পকে ঐতিহাসিক এক পরাজয় বরণ করে নিতে হতে পারে। এতে বলা হয়েছে, ভোটারদের মাত্র ৩৫ শতাংশ বর্তমান প্রেসিডেন্টের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে। করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর আগে করা সর্বশেষ পূর্বাভাসে সংস্থাটি জানিয়েছিল, ভোট হলে ট্রাম্প মোট ভোটারের ৫৫ শতাংশের সমর্থন পাবেন।

পপুলার ভোটের ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের করা পূর্বাভাস এখন পর্যন্ত খুব কমই ভুল হয়েছে। অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ক্ষেত্রে পূর্বাভাস ঠিক থাকলেও, তাঁরা দুজনই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই পূর্বাভাসের মডেলটি দাঁড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক নানা সূচকের ভিত্তির ওপর। আর বর্তমানে এই ভিত্তিটি ভীষণ রকম নড়বড়ে। বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশের বেশি, মাথাপিছু আয় ৬ শতাংশ নেমে গেছে, মুদ্রাবাজারও অস্থিতিশীল। সব মিলিয়ে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রই অস্থিতিশীল।

একই সংস্থার করা অঙ্গরাজ্যভিত্তিক আরেক নির্বাচনী পূর্বাভাস মডেলে বলা হয়েছে, নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেক্টোরাল কলেজেও খুব বাজেভাবে পরাজিত হবেন। এতে আইওয়া, উইসকনসিন, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, ওহাইও, মিজৌরি ও নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্য ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্পের বিপরীতে শুধু এই অর্থনীতিই দাঁড়াচ্ছে না। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মহামারির মতো বড় একটি সংকট মোকাবিলায় তাঁর প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টিও। এরই মধ্যে খবরে প্রকাশ পেয়েছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন যদি দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নিত, তবে ৩০ হাজারের বেশি মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব ছিল। কিন্তু এত সবের মধ্যেও ট্রাম্প বরাবরের মতোই নানা বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন, যা তাঁর জন্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।

এই ক্রমেই জটিল হওয়া পরিস্থিতিটি ডোনাল্ড ট্রাম্প ভালোভাবেই বুঝছেন। বুঝছেন যে, তাঁর সামনে থেকে পুনর্নির্বাচনের সুযোগটি ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে। আর এটি তিনি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। ফলে তিনি দোষারোপের মাধ্যমে, এবারের মতো পার পেতে চাইছেন। তাই কখনো চীন, কখনো জাতিসংঘ, কখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তো কখনো আবার নিজেরই নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে দুবার ভাবছেন না। আর এই কাজটি যখন তিনি করছেন, তখন এক ভীষণ অপ্রিয় সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ছে তাঁর অজান্তেই। আর তা হলো—এমন মহাসংকটে আমেরিকানদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আখ্যা দিয়ে ৫০টি অঙ্গরাজ্যই খুলে দিতে চাইছেন, তখন সত্য হলো—১৮টি অঙ্গরাজ্যে করোনাভাইরাসের বিস্তার বাড়ছে। ১৫টি অঙ্গরাজ্যে সংক্রমণ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে এক জায়গায়। আর মাত্র ১৭টি অঙ্গরাজ্যে ভাইরাসটি বিস্তারের হার ক্রমে কমে আসছে। কিন্তু এই হিসাব বিবেচনায় না নিয়েই এখনই ৫০টি অঙ্গরাজ্য পুরোপুরি খুলে দিতে চান ট্রাম্প। কারণ তো ওই পুনর্নির্বাচনের জন্য অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে বাঁচানো। কিন্তু এটিই অর্থনীতিকে আরও বড় পাকে নিয়ে ফেলতে পারে, যদি হিসাব এলোমেলো হয়ে যায়। টেক্সাস বা ফ্লোরিডার মতো অঙ্গরাজ্যগুলো যেভাবে খোলা হচ্ছে, তাতে অন্যরা হয়তো আশাবাদী হয়ে উঠবে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলে, এটাই আবার সবচেয়ে বেশি হতাশাগ্রস্ত করবে।

শুধু তাই নয়, নিজের আবারও ক্ষমতায় যাওয়া, না-যাওয়া প্রশ্নে ডোনাল্ড ট্রাম্প এতটাই একরোখা ভূমিকা নিয়েছেন যে, এমন সংকটকালেও তিনি বিপরীত দলের প্রার্থী ও রাজনীতিকদের হেনস্তা করতে ছাড়ছেন না। মিশিগানের গভর্নর গ্র্যাচেন হুইটমারের বিরুদ্ধে মামলা করা, আগামী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকিসহ এমন বহু ঘটনায় তাঁর এই একরোখা চরিত্রটি প্রকাশ পেয়েছে। অথচ এই সময় জাতীয় ঐক্য স্থাপনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁরই মুখ্য ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মানুষ দেখছে যে, এই ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন জো বাইডেন, বার্নি স্যান্ডার্স, বারাক ওবামার মতো নেতারা।

সবচেয়ে সুসময় ও সবচেয়ে দুঃসময়েই প্রেসিডেন্সির মতো গুরুদায়িত্ব মানুষকে পথ দেখায়। কখনো কখনো একটি গোটা যুগকে পথ দেখানোর কাজটি করা সম্ভব হয়। এ সুযোগ সবাই পায় না। বিশেষত দুঃসময়ে যারা হাল ধরেন, তাঁদের পক্ষে এক দীর্ঘ পথের নির্দেশ অল্প সময়েই দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকা ও বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বড় স্বাস্থ্য সংকট ও অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়েও নিজের আরেক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার খোয়াবটিকে ভুলতে পারছেন না। আর এই ভুলতে না পারার কারণেই তাঁর এই স্বপ্নটি ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

দুঃসময়ে মানুষ মূলত একজন নেতা চায়, যে তাকে আশ্বাস দেবে, তাকে আত্মবিশ্বাস দেবে। তারা এমন নেতা চায়, যে দুঃসময়ে তাদের সঙ্গে এক হয়ে হাঁটবে। মনে এই বিশ্বাস জোগাবে যে, সংকট কেটে যাবে এক দিন। আর এই আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিকারী নেতা এমনি এমনি হওয়া যায় না। মুখের কথায় হওয়া যায় না। এমন নেতা হয়ে উঠতে হয় কাজের মাধ্যমে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সময়ে ঠিক এর বিপরীত আচরণটিই করছেন। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে ‘শয়তান’ হিসেবে দেখাতে গিয়ে, নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। দ্রুত সংকট উতরাতে ভুলভাল দাওয়াই দিয়ে নিজের অস্থিরমতি ও অজ্ঞতা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। যেনতেনভাবে সবকিছু সচল করার কথা বলে মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি কতটা স্বার্থপর। ফলে তাঁর অন্ধ সমর্থকেরা ছাড়া বাদবাকি সবাই তাঁর ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। অর্থ এই দুরবস্থায় মানুষ হয়তো সব সচল করার পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তারা প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস করছে। বরং প্রেসিডেন্টকে ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনকে বিশ্বাস করতে পারছে না বলেই মানুষ পথে নেমে নিজেরটা নিজে করে নিতে চাইছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই মুহূর্তে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম বারাক ওবামা, জো বাইডেন, বার্নি স্যান্ডার্স বা এমন কোনো নেতা কিংবা ডেমোক্রেটিক দলও নয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম অর্থনীতি, যা এখন ১৯৩০-এর মতো মন্দায় আক্রান্ত।