পরিবারের সঙ্গে হবে ঈদ

এমন ঈদ আগে আমরা কখনো কেউ দেখিনি। বাংলাদেশের মতো ঈদ আনন্দের সঙ্গে উদ্যাপন করেন বাংলাদেশি আমেরিকানরা। তবে দেশে ফেলে আসা সময়ের ঈদ আনন্দ নিয়ে কথা বলে কেউ কেউ অশ্রুপাত করেছেন। কেউ দেশে স্বজনের সঙ্গে ঈদ করা নিয়ে কাটিয়েছেন খুশির দিনের বিমর্ষ বিকেলটি।

করোনাকালের এ সময় সব বদলে দিয়েছে। দেশের মতো প্রবাসেও আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা। কারও মুখে খুশি নেই। আছে কেবল উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা। লকডাউনে থাকা নগরে ঈদের কোনো কেনাকাটা ছিল না। দেশ থেকেও ঈদের জামা, ঈদের শাড়ি এবারে আসেনি। গত কয়েক বছর থেকে জমে ওঠা চাঁন রাতে চাঁদ উঠবে ঠিকই। এবারে চাঁদের নিচে উৎফুল্ল মানুষের উচ্ছ্বাস থাকবে না।

ভিন্ন পরিস্থিতির এই ঈদ নিয়ে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেছেন আমেরিকায় বসবাসরত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি—

ডাক্তার জিয়া উদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশি আমেরিকান বিশিষ্টি এই চিকিৎসক জানালেন, হয়তো জুম অ্যাপের মাধ্যমে ঈদের নামাজে শরিক হবেন। প্রতিবছর ঈদের জন্য ছুটি নিতেন

এবং সারা দিন ঘুরে বেড়াতেন আত্মীয়স্বজনদের বাসায়। কিন্তু এ বছর ঈদে তিনি ছুটি নেবেন না। তিনি ডিউটিতে হাসপাতালে যাবেন। সেবা করবেন রোগীদের, যারা জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। একজন রোগীকে বাঁচাতে পারলে তার কাছে ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দের মনে হবে এখন। তার সহধর্মিণী, দুই মেয়ে সবাই ডাক্তার। তারা সবাই এই দুর্দিনে সেবা করে যাচ্ছেন রোগীদের। দরকার ছাড়া সবাইকে ঘরে নিরাপদে থাকার জন্য বলেন ডা. জিয়া।

 রায়হান জামান

উৎসব গ্রুপের সিইও রায়হান জামান। তিনি প্রতিবছর জ্যামাইকা আল আরাফা মসজিদে তিন থেকে চার হাজার মানুষের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তেন। দুঃখ নিয়ে জানালেন এই বছর তাকে ঘরেই ঈদের নামাজ পড়তে হবে। প্রতিবছর আল আরাফা মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসলিমদের জন্য মিষ্টির ব্যবস্থা রাখতেন, আর বাচ্চাদের জন্য নানা রকম খেলনা আর কটন কেন্ডির ব্যবস্থা করতেন। বাচ্চাদের হাসিমুখ দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগত। এই বছর হাসিমুখগুলো সে খুব মিস করবেন। জুন মাসে বাংলাদেশে, আর ১৭ মে থেকে হিলসাইডে বিশেষভাবে প্রোটেকশন নিয়ে কাজ শুরু করবেন বলে আশা করছেন। ঈদ উপলক্ষে তার নিজ গ্রামের বাড়ি শেরপুরের মাদ্রাসার বাচ্চাদের জন্য ডোনেশান পাঠিয়েছেন। এই বছর ঈদের দিন পরিবারের সবার সঙ্গে বাসায় ঈদ করার পরিকল্পনা করেছেন।

ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার

ডাক্তার ফেরদৌস সাহায্য করে যাচ্ছেন অনবরত দুস্থ অসহায় মানুষদের। তিনি জানালেন, প্রতিবছর ঈদে নামাজ পড়তে যেতেন জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের মাঠে। এই বছর ঈদের নামাজ সবার সঙ্গে করতে পারবেন না বলে মন খারাপ। তারপরও তিনি আশা করছেন, কোথাও যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের নামাজ পড়ানোর ব্যবস্থা থাকে, সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। সারা দিন আত্মীয়দের সঙ্গে দল বেঁধে ঈদের দিন ঘোরাফেরা করতেন, যেতেন সবার বাসায় বাসায়। এই বছর তিনি খুব সীমিত বাসায় যাবেন সামাজিক দূরত্ব মেনে। তার স্ত্রীকে বলেছেন, প্রতিবছরের চেয়ে কম রান্নার আইটেম করতে। ঈদ উপলক্ষে কিছু অভিবাসী শিক্ষার্থীদের নগদ অর্থ দিয়েছেন আর তাদের ঈদের দিন দুপুরে তাঁর বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর না আছে ওয়ার্ক পারমিট, না আছে কাজ। ঈদ উপলক্ষে কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কসের ২৫০টি পরিবার, যাদের কাগজ নেই তাদের বাসায় তিন সপ্তাহের খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। এ ছাড়া নিজ গ্রামের বাড়ির আশপাশের এক হাজার দুস্থ পরিবারকে পনেরো দিনের খাবার দিয়েছেন।

 আলমাস আলী

মার্কস হোম কেয়ার কর্মকর্তা।  আলমাস আলী দেশে তাঁর নিজ এলাকায় সাধারণ মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছেন। নিউইয়র্কেও একই সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, মানুষের সেবা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। এবারে ঈদে খোলা জামাতে অংশ না নিতে পারলেও ফোনে দেশ–বিদেশে আত্মীয়স্বজন, পরিজনের খবর রাখবেন। সবকিছু আল্লাহর রহমতে আবার ঠিক হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করলেন তিনি।

 গিয়াস আহমেদ

গিয়াস আহমেদ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও হোম কেয়ার ব্যবসায়ী। তিনি ডিজিটালি এই বছরের ঈদ পালন করবেন বলে জানালেন। মিস করতে চান না ঈদের নামাজ, তাই তার ইচ্ছে আছে লং আইল্যান্ডে ডিক্সহিল এলাকায় সোলাইমানিয়া মসজিদে যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের জামাত হয়, তাহলে সেখানে গিয়ে নামাজ পড়ার। জুম, ফেসটাইম, বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ঈদের দিন বন্ধু–বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটাবেন। এবারের ঈদে কারও বাসায় যাবেন না। সবার প্রতি পরামর্শ, এই ঈদ বাসায় নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে করুন। ঘরে থাকুন নিরাপদে থাকুন। তিনি ফোবানার ভাইস চেয়ারম্যান। ফোবানার উদ্যোগে ৩০০ দুস্থ পরিবারকে দুই সপ্তাহের খাবার দিয়েছেন। ফোবানার উদ্যোগে দেশেও ঈদ উপলক্ষে সাহায্য করেছেন।

অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী

অ্যাটর্নি মঈন ইস্ট এলমহার্স্টের আবু হুরায়রা মসজিদে (সামাজিক দূরত্ব মেনে জামায় হরে) সেখানে পড়ার ইচ্ছে আছে। পরিবারের সঙ্গে ঘরে বসে ঈদ করার পরিকল্পনা করেছেন এই বছর। পরিচিতজন, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ভাইবার, মেসেঞ্জার, ফেসটাইম বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় ও সময় কাটাবেন। কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস, মিশিগানসহ ২২টি মসজিদের আজীবন সদস্য তিনি। ঈদ উপলক্ষে সব মসজিদে সাহায্য করার ইচ্ছে আছে। আল আমীন, আবু হুরায়রা মসজিদেও ঈদ উপলক্ষে তিনি সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া তাঁর গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই থানায় ৫টি মসজিদে ডোনেশান করেন। সবাইকে ঘরে থেকে নিরাপদে ঈদ করার পরামর্শ তার।

আহনাফ আলম

 আহনাফ আলম নিউ আমেরিকান ইয়ুথ ফোরাম অব নিউইয়র্কের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এই সংগঠনের তরুণদের নিয়ে করোনা মহামারিতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি অবসর সময়ে ২৩ জুনের নির্বাচনে প্রার্থীদের সমর্থনে ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছেন অনলাইনে।

অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন

 অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন সাবেক বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ও রাজনীতিবিদ১ এই দুর্দিনে কমিউনিটির পাশে আছেন। গোপনে ত্রাণ সহায়তা করছেন সাধারণ মানুষকে। দেশেও গরিব–দুঃখীদের সেবায় নিয়োজিত আছেন তিনি।

 মোহাম্মদ হোসেন ইশতিয়াক

 মোহাম্মদ হোসেন ইশতিয়াক এসেনশিয়াল হোমকেয়ারে সিইও। করোনায় আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। জ্যামাইকার একাধিক সংগঠনের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, প্রচার–প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে দান দেওয়ার বিষয়টি আমি তেমন একটা পছন্দ করি না। অতীতে সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করেছি, ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।

রিজ চৌধুরী

 রিজ চৌধুরী সাবেক গুগুল কর্মকর্তা। বর্তমানে আই অ্যান্ড ডি কোম্পানির সিইও। দেশে তার নিজ এলাকা চট্টগ্রামে ৪৯২ জন দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করেছেন। নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানেও সহযোগিতা করেন। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে তার এই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে জানান।

 আবদুর রহিম হাওলাদার

 আবদুর রহিম হাওলাদার বাংলাদেশ সোসাইটির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এই করোনায় তিনিসহ সংগঠনের একাধিক ব্যক্তি মানবতার সেবায় কাজ করেছেন দিনের পর দিন। প্রায় এক শর বেশি মানুষকে সোসাইটির পক্ষ থেকে দাফন করা হয়েছে। আবদুর রহিম ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন একাধিক মানুষকে। তিনি জানান, যারা আমাদের কাছে আসছে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আমরা সহযোগিতা করছি।