সিলেটে নারীশিক্ষা

ব্রিটিশ আমলে সিলেটের হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই নারী শিক্ষার ব্যাপারে ছিল খুবই রক্ষণশীল। সে জন্য বাবা–মা বাড়িতে যে শিক্ষা দিতেন, এর বাইরে নারীদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কেউ বিদ্যার্জন করলে তাঁকে বিয়ে দেওয়াও ছিল কঠিন কাজ। সমাজের তখন এ ধারণা প্রচলিত ছিল, মেয়েদের শিক্ষিত করলে তাদের চরিত্র নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং শিক্ষিত মেয়েদের ঘরে আনাও ন্যায়বিরোধী। তখনকার দিনে সাত/আট বছরের মেয়েকে রাস্তায় তো দূরের কথা, বাড়ির সামনে, এমন কী পুকুর পাড়ে যেতেও দেওয়া হতো না।
সিলেটে নারীশিক্ষার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব খ্রিষ্টান মিশনারির এবং কলকাতায় গঠিত সিলেটী ছাত্রদের সংগঠন ‘শ্রীহট্ট সম্মিলনী’র। শ্রীহট্ট সম্মিলনী সম্পর্কে বিপিন চন্দ্র পাল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন—
As far back as 1874 young students from Sylhet reading in the Calcutta University had organised an association under the name of the Sylhet Union. Its main object was to promote closer relation between the different individuals belonging to Sylhet living in Calcutta for study of business. But it was recognised that such unity could not possibly be pursuit of some common object. This object was found in the promotion of education, particularly female education in the district from which they came. They were receiving a fairly high standard of modern education. They realised the value of this education to themselves and to participate in these benefits. Under inspiration of the patriotic motive these young students banded themselves into this union for self-culture and patriotic service. Babu Jay Gobinda Shome became the president of the union.
অর্থাৎ ১৮৭৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সিলেটী ছাত্রদের উদ্যোগে কলকাতায় বসবাসরত ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের লক্ষে ‘সিলেট ইউনিয়ন’ (শ্রীহট্ট সম্মিলনী) গঠিত হয়। জয়গোবিন্দ সোম নির্বাচিত হন এর প্রেসিডেন্ট। এর পরের বছর ১৮৭৫ সালে বিপিন চন্দ্র পাল সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি এবং এবং শ্রীহট্ট সম্মিলন সদস্যপদ গ্রহণ করেন।
‘সিলেট ইউনিয়ন’ গঠিত হওয়ার পর থেকে এটির প্রধান কাজ ছিল কীভাবে সিলেটের নারীদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া যায়। আগেই বলেছি, তখন সিলেটী হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে মেয়েদের বিদ্যার্জন ছিল একটি নিন্দনীয় কাজ। এ অচলায়তন ভাঙার জন্য ‘সিলেট ইউনিয়ন’-এর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রথমে সরকারকে বুঝিয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা চলে। একই সঙ্গে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলোকে শ্রীহট্ট সম্মিলনীর পক্ষ থেকে বার্ষিক সাহায্য দানেরও ব্যবস্থা করা হয়। এরপর গৃহিণীদের নারীদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য পরীক্ষা গ্রহণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সে লক্ষে জেলার বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষাকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়। এতে স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও সাহায্য করতেন। শেষ পর্যন্ত আসাম সরকারের আদেশে ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুলস এই পরীক্ষা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পায়। শুধু তাই নয়, সেকালের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করে পাঠ্যতালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছিল। দেশের বিশিষ্ট পণ্ডিতরা তখন স্বেচ্ছায় পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন রিপন কলেজের অধ্যাপক বিপিনবিহারী গুপ্ত ও সতীনাথ তত্ত্বভূষণ, সিটি কলেজের অধ্যাপক ব্রজ সুন্দর রায় প্রমুখ। এমন কী আসামের চিফ কমিশনার স্যার গার্লস ইলিয়েটের স্ত্রী নিজে বালিকাদের হস্তশিল্প পরীক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে এ স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলন শুধু সমাজের উচ্চস্তরের মেয়েদের মধ্যে না থেকে হিন্দু-সমাজের সর্বস্তরে এবং মুসলমান সমাজেও বিস্তার লাভ করেছিল। চার বছরের বালিকা থেকে ৩৫ বছরের মহিলাদের এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। কোনো কোনো সময় ৫৫ বছর বয়সের মহিলারাও পরীক্ষায় উপস্থিত থাকতেন। এ সকল পরীক্ষায় যে সব বালিকা ও নারী কৃতিত্ব দেখাতেন, তাঁদের পদক, পুরস্কার ও প্রশংসাপত্র দেওয়া হতো। ১৯০০ সাল পর্যন্ত এভাবে পুরস্কৃত বালিকা ও নারীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। তাদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন ছিলেন মুসলমান নারী ও বালিকা।
সিলেট জেলার পাইলগাঁওয়ের জমিদার ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ‘শ্রীহট্টের স্ত্রীশিক্ষার প্রারম্ভ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে সেকালের মেয়েদের শিক্ষার একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন—
শ্রীহট্ট সম্মিলনীর সঙ্গে আমার পরিচয় বাল্যে প্রায় ৪৫ বছর পূর্বে। তখনকার দিনে জেঠিমা, মা, খুড়িমা শ্রীহট্ট সম্মিলনীর পরীক্ষা দিতেন এবং হাতবাক্স ইত্যাদি পুরস্কার পাইতেন। তাঁদের পুরস্কারপ্রাপ্ত কাঠের একটি হাতবাক্স এখনো আমার কাছে আছে। জ্ঞাতি এক খুড়া মহাশয় পরীক্ষা নিতেন। তিনি তখনো জীবিত, স্ত্রীশিক্ষা ইত্যাদির উন্নতিমূলক নানা কাজে উৎসাহশীল; আরও ত্রিশ বৎসর পূর্বে আমাদের বাড়িতে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন হয়। প্রথম বর্ণ পরিচয় বাবার ছোট পিসিমার। ১৪ বৎসর বয়সে তাহার বিবাহ হয়। সেদিন পাড়া-প্রতিবেশীর নিকট বর্ণ পরিচয় এবং ১৪ বৎসরে বিবাহ দুইটাই নিন্দনীয় ও কুলক্ষণ বলিয়া বিবেচিত হয়েছিল। [...] ১৯৩০ ইংরেজির রাজনৈতিক আন্দোলনে নারীশিক্ষার অনেকটা বিস্তৃতি ঘটিয়াছে। প্রবল জাতীয় ভাবের বশে মাতৃত্বের ও ভগিনীত্বের প্রেরণায় ‘ভ্রাতা-পুত্রের’র সাহায্যার্থে মাতা-ভগিনীগণ অবরোধ হইতে রাজপথে বাহির হইয়াছিলেন। [...] জনৈক ইংরেজ সিভিল সার্জন লেখককে বলিয়াছিলেন, ‘অর্ধশতাব্দীর চেষ্টায় যে পর্দা ফাঁক হয় নাই, আজ তাহা এক মুহূর্তে হইয়া গেল’।
সিলেটের রক্ষণশীল সমাজের নারীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রথম যাঁদের নাম আসে তার মধ্যে ওয়েলস ক্যালভিনিস্ট মেথোডিস্ট ফরেন মিশনারি সোসাইটির প্রধান রেভারেন্ড উইলিয়াম প্রাইজ এবং সোসাইটির অন্যান্য কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করতে হয়। তারপরে যে নামটি আসে সেটি ‘সিলেট ইউনিয়ন’ বা শ্রীহট্ট সম্মিলনীর। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ‘সিলেট ইউনিয়ন’-এরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন রেভারেন্ড প্রাইজের শেখঘাট স্কুলের ছাত্র জয়গোবিন্দ সোম। এমন কী বিপিন চন্দ্র পালসহ এই সমিতির প্রায় সবাই ছিলেন সিলেট মিশন স্কুলের ছাত্র।

মিশন বালিকা বিদ্যালয়
সিলেট মিশন বন্ধ থাকার পনেরো বছর পরে ১৮৮৫ সালের ১৩-১৫ জুলাই দ্য জেনারেল অ্যাসেম্বলি অব আবারডেয়ার অনতিবিলম্বে সমতল এলাকাগুলোতে মিশনের কাজ আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রেভারেন্ড জে পেঙ্গুইন জোন্স, রেভারেন্ড ডাক্তার টি জে জোন্স, এলিজাবেথ উইলিয়ামস ও মিস ব্রাউনলো ১৮৮৭ সালের ২৮ নভেম্বর সিলেটে আসেন। ১৮৮৮ সালে মিশনারি সারা এ জন সিলেট শহরে একটি গার্লস স্কুল চালু করেন। আরেকটি গার্লস স্কুল চালু করা হয় শহর থেকে প্রায় তিন মাইল ধুরে দলাদলি চা বাগানে। মিসেস এ জোন্স সিলেট চলে যাওয়ার পরে স্কুলটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন গৌরচরণ দাসের মেয়ে সুশীলা দাস ও শশীরমুখী দাস। ১৯২১ সালে শশীরমুখী দাস মারা যাওয়ার পরে স্কুলটি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন কিশোরীমোহন দাস। কোনো একপর্যায়ে তাঁর নামানুসারে স্কুলের নামকরণ হয় ‘কিশোরীমোহন বালিকা বিদ্যালয়’।

সিলেট গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল
ওয়েলস প্রেসবিটারিয়ান মিশনের মিশনারি এলিজাবেথ উইলিয়াম ১৮৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সিলেটে যান এবং মিশনারি কাজের অংশ হিসেবে ১৯০৩ সালে সিলেটের প্রথম গার্লস স্কুল চালু করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ লাভ করে হেমন্ত কুমারী চৌধুরী। আগেই বলেছি, সিলেটী সমাজের তখন এ ধারণা প্রচলিত ছিল, মেয়েদের শিক্ষিত করলে তাদের চরিত্র নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং শিক্ষিত মেয়েদের ঘরে আনাও ন্যায়বিরোধী। এ ছাড়া তখন মিশনারিদের কার্যক্রম স্থানীয়রা খুব একটা সুনজরে দেখতেন না। সমাজের সে দুর্ভেদ্য অচলায়তন থেকে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসার ব্যাপারে তখন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন হেমন্ত কুমারী চৌধুরী। এক বছরের মাথায় এর ছাত্রী সংখ্যা গিয়ে উন্নীত হয় ৬০ জনে। ১৯১৭ সালে এলিজাবেথ ক্যানসারে মারা গেলে পরে স্কুলটির নামকরণ করা হয় ‘এলিজাবেথ উইলিয়ামস স্কুল ফর গার্লস’। ১৯১৮ সালে এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ লাভ করেন জেইন হেলেন রাওলেন্ডস। ১৯২৫ সালে রাওলেন্ডস ‘দার্জিলিং ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুল ফর মিশনারিজ’-এর প্রিন্সিপাল হয়ে চলে যান। আসাম সরকার তখন স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং স্কুলের নাম হয় ‘সিলেট গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল’। প্রধান শিক্ষক নিয়োগ লাভ করেন সুমতিবালা মজুমদার। একই বছর স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
১৯৪১ সালের ত্রি-বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এটা অত্যন্ত সন্তোষজনক খবর যে, বর্তমান পঞ্চবার্ষিক সময়ে সিলেট সরকারি গার্লস স্কুলের একজন ছাত্রী ১৯৪০ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ছাত্রী মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করল।
এই কৃতী ছাত্রী ছিলেন শ্রীমতি কনক পুরকায়স্থ। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল আসামের মধ্যে দ্বিতীয় সরকারি গার্লস স্কুল। তখন এটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৫৯। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্কুলটি ‘সিলেট গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল’ নামেই পরিচালিত হয় এবং একটানা ২২ বছর সুমতিবালা মজুমদার এটির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।