রূপকথার সরোবর ও প্রশাসনিক সংস্কার

সরোবর শব্দটি শুনলে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। ফিরে যাই শৈশবে, যখন প্রচুর রূপকথার গল্প পড়তাম। রূপকথার গল্পে রাজবাড়িতে অবধারিতভাবে একটি সরোবর পাওয়া যেত। রাজকন্যারা সেই সরোবরে সখী পরিবেষ্টিত হয়ে অবগাহন করতেন। সেই সরোবরে নানা রকম জলপদ্ম ছিল। জলপদ্ম এবং সরোবরের স্বচ্ছ জলের বর্ণনায় বোঝা কষ্ট হতো, সরোবর সুন্দর নাকি সখী পরিবেষ্টিত রাজকন্যা? যেন সোনার হাতে সোনার কাঁকন, কে কার অলংকার! সেই সরোবরেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর প্রেমিক অন্য দেশের কোনো রাজপুত্র কিংবা হতদরিদ্র রাখাল ছেলের দেখা হয়ে যেত। তারপর অনেক রোমাঞ্চ, ক্লাইমেক্স, অ্যাকশন, ড্রামার মাধ্যমে পরিশেষে তাদের মিলন ঘটত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য মিলন ঘটানো হতো। কারণ, জাতিগতভাবে বাঙালিরা গল্পের শেষে দুষ্টের পরাজয়, শিষ্টের জয় দেখতেই পছন্দ করেন। বাঙালিরা এ ক্ষেত্রে দলমত-নির্বিশেষে একমত। সবাই মিলনান্তক পরিসমাপ্তি পছন্দ করেন।

গল্পের মধ্যে যতই বিয়োগান্ত ঘটনা থাকুক, পরিসমাপ্তি কিন্তু মিলনান্তক হতেই হবে। সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় ‘মধুরেণ সমাপয়াৎ’। মধুর ঘটনা দিয়েই গল্পের সমাপ্তি ঘটাতে হবে। যাক সরোবরকে কেন্দ্র করে রূপকথার গল্প বলতে আসলে এই লেখার অবতারণা করছি না। তবে এও ঠিক একটা ধন্যবাদ দেওয়াও এই লেখার একটি উদ্দেশ্য। কাকে ধন্যবাদ? কুড়িগ্রাম জেলার ভূতপূর্ব জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন মহোদয়াকে। কারণ, সরোবর শব্দটির ব্যবহার করে পত্রিকান্তরে আমরা জানতে পেরেছি, তিনি সরকারি অর্থে কুড়িগ্রাম সদরে একটি সরোবর স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলার জনগণের দাবিতে তিনি এই সরোবরের নাম রাখতে চেয়েছিলেন, পারভীন সরোবর।   

তিনি একটি কাব্যিক নাম রাখতেই পারেন। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাব, এমন একটি নামে সরোবর স্থাপন করে আমদের মতো নীরস, কল্পনা শক্তিহীন মানুষদের কাব্য ও রূপকথার জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বা আমরা কিছুটা রাগ করতেই পারি নিরাপোস সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ট্রিবিউন পত্রিকার কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের ওপর। কী প্রয়োজন ছিল তাঁর এমন একটি মহৎ উদ্যোগে বাগড়া দেওয়ার। তিনি তাঁর পত্রিকায় ভয়-ডরহীন ক্রিকেটের মতো, ভয়ডরহীন একটি রিপোর্ট করে দেন এই ‘পারভীন সরোবর’ নিয়ে। বিষয়বস্তু হলো—সরকারি অর্থে ব্যক্তিগত নামে সরোবর স্থাপন। তাঁর ভাবা উচিত ছিল, পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং করাটাই ভালো। তিনি মনে হয় জানতেন না যে, ভয়ডরহীন ব্যাটিং আসলে পাতানো খেলাতেই চলে, যেখানে আগে থেকেই কিছুটা আপস-রফা করতে হয় ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। যেমন কর্ম তেমন ফল। ভয়ডরহীন ব্যাটিং করে তিনি আহত হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে বাধ্য হন। রাতের গভীর আঁধারে প্রশাসনের লোকেরা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে নির্যাতন করেন, নির্যাতনের ধরনটি আমাদের ১৯৭১ সালের বর্বরতার ‘বিশেষ ধরনের’ কথা মনে করিয়ে দেয়।

করোনার ভয়াল থাবায় যখন পৃথিবীর মানুষ কম্পমান, ব্রিটেনের অভিজাত রাজ পরিবার থেকে শুরু করে আমাদের অনভিজাত বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষেরা বিপন্ন, তখন এই সরোবর নিয়ে কথা বলা কতটুকু প্রাসঙ্গিক। জীবন-জীবিকা, রাজনীতি আজ একে অন্যের মুখোমুখি। বাংলাদেশে নয় শুধু, ইউরোপ, আমেরিকাসহ সমগ্র বিশ্বেই এ অবস্থা। করোনার নির্মম ছোবলে নীল হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে এই মুহূর্তে এক বিশাল রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে। এই রূপান্তরকালে যারা পরিস্থিতির আলোকে নিজেদের রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজ নীতি, অর্থনীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবেন, মনে হয় করোনাত্তোর পৃথিবীতে তাঁরাই এগিয়ে যাবেন।

আমরা দেখছি, উহানে করোনার আক্রমণ প্রায় শেষ করে যখন ইউরোপ-আমেরিকায় করোনার নির্মম আক্রমণ চলছে, তখনই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এমন কর্মে লিপ্ত হলেন। আশার কথা, সম্প্রতি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকার শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রেখেছে। করোনার ভয়াল আক্রমণ যখন ধীরে ধীরে সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে, তখন এ ধরনের উচ্চারণ সবাইকে আশ্বস্ত করেছে।

অদৃশ্য করোনা, পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে অননুমেয় করে তুলেছে। সমাজ গবেষক, অর্থনীতিবিদ এমনকি বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না। ধারণার ওপর ভিত্তি করে শুধু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও পৃথিবীতে এত অন্ধকার আর কখনো নেমে আসেনি, অননুমেয় হয়ে ওঠেনি সবকিছু। তবে এ কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়  রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি আর গতানুগতিক ধারায় চলবে না। পরিবর্তন পৃথিবীতে সব সময় অবধারিতভাবে হয়ে থাকে। কিন্তু এবারের পরিবর্তন আসলে পরিবর্তন না হয়ে র‍্যডিক্যাল সংস্কার হতে বাধ্য। পুঁজিবাদী সমাজে হয়তো বাম ঘরানার সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়বে, নতুন নামে, নতুনভাবে, নতুন বিষয়বস্তুতে। এই পরিবর্তন বা সংস্কারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যারা রাজনীতি ও প্রশাসনকে পরিবর্তন করতে পারবেন, তাঁরাই সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে এগিয়ে যাবেন। একগুঁয়েমি, সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দার জন্য  যারা বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন বা নেবেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো এর মধ্য দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন।

এই ভয়াবহ সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্বে যারা আছেন, তাঁরা যদি সনাতনী ধারার রাজনীতি অব্যাহত রাখেন, তাহলে তাঁরা যে খুব সফল হতে পারবেন না, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমাদের অতি সনাতনী ধারার রাজনীতি, অর্থনীতিতে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। পরিবর্তন, সংস্কার যথাযথ না হলে, রাষ্ট্র হিসেবে আমরা অপাঙেক্তয় ও মর্যাদাহীন হয়ে যাব। অদৃষ্টের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জনগণের সামনে ধাঁধা ছুড়ে দিতে হবে, বেছে নাও জীবন না হয় অদৃষ্ট? আর এ জন্য আমাদের প্রশাসনকে, প্রভুত্ববাদ, অভিজাততন্ত্র বর্জন করে প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবক হয়ে উঠতে হবে।

প্রশাসনের সংস্কারে তাই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সর্বাগ্রে হওয়া জরুরি। ইংরেজিতে একটা নীতি কথা আছে, ‘থিংক গ্লোবালি অ্যাক্ট লোকালি’ অর্থাৎ ‘ভাব বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, আর কাজ কর স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে।’ আমরা যাদের প্রায় দুই শ বছরের উপনিবেশ ছিলাম, তারা যখন প্রশাসনকে সংস্কার করে, কর্মকর্তাদের প্রকৃত অর্থে জনগণের ভৃত্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন, করোনাত্তোরকালে টিকে থাকার জন্য আমরা কেন যথাযথ প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে আসতে পারব না?  এ জন্য শুধু সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক ইচ্ছাই যথেষ্ট।