চুম্বন

বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমরা তখন প্রথম আমেরিকায় এসেছি, নিউইয়র্কে। বাবার দুই ক্লাসমেট কুইন্সের এলমহার্স্ট এলাকায় আমাদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট দেখে দিয়েছিল। শুরুতে দুই কাকা বাবুর পরিবার ছাড়া দেশি লোকজন দেখতে না পেয়ে খুব হাঁসফাঁস লাগত। পরে ওদের চেনা আরও কয়েকটি ভারতীয় পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়ে একরকম চলে যেত। তবে আজকের বাঙালি-ঠাসা কুইন্সের তুলনায় তা ছিল নস্যি।

একদিন ঘটল এক মজার ঘটনা। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের মেইন দরজায় কেউ যেন টোকা দিচ্ছে, এমন আওয়াজ পাওয়া গেল। খুলে দেখি ৪-৫ বছরের একটা বাচ্চা বাটি হাতে দাঁড়িয়ে। বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘পুরি’। বাতিটা ধরতেই সে সিঁড়ির দিকে দৌড় মারল। সিঁড়িতে আরেক পায়ের শব্দ শুনে বুঝলাম, ছেলেটি একা আসেনি। সঙ্গের মানুষটি বাচ্চাটির আসেই সটকে পড়েছিল। আর একদিন আবার পুরি দিতে এসে পালাবার আগেই বাচ্চাটাকে ধরে ফেলে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই ছেলে, তোমার নাম কি?’

সে বলল, ‘নরেন্দ্র’।

-নরেন্দ্র হোয়াট?

-নরেন্দ্র দেশাই?

-তোমাকে কে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে?

-মাই আংকেল।

-কি নাম তার?

-পারেশ।

-পরেশ?

-না, পারেশ।

-আচ্ছা, হলো পারেশ। তো সে সামনে না এসে পালিয়ে যায় কেন?

-তোমাকে ভয় পায়।

-আমাকে? আরে, আমি কি ভয় পাওয়ার মতো কেউ নাকি? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। পরেশ, এই পরেশ। এসো, সামনে এসো। এসো বলছি।

পরেশ কাঁচুমাচু হয়ে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। দেখে মনে হলো আমার চেয়ে সে ৪-৫ বছরের বড়ই হবে। অথচ এই ছেলে আমাকে ভয় পায়? আশ্চর্য!

জিজ্ঞেস করি, ‘তোমরা এই বিল্ডিংয়ে থাকো? কোন তলায়? মনে তো হচ্ছে তুমি কলেজে পড়। কোথায়, কী বিষয়ে? কত দিন ধরে এখানে আছ? বাড়িতে আর কে কে আছে? নরেন্দ্র তোমার কে হয়?’

ফোয়ারার মতো একসঙ্গে আমার এত প্রশ্নের উত্তরগুলো একত্র করলে এই দাঁড়ায়’—ওরা এই অ্যাপার্টমেন্টের চারতলায় আছে তা প্রায় এক বছর হলো। ও পরেশ। দাদা নরেশ একজন ফার্মাসিস্ট, কিন্তু লাইসেন্স নেই বলে অড জব করে। ভাইপো নরেন্দ্রের ছোট এক বোন আছে, নাম নায়না। বৌদি খুব ভালো মানুষ। তিনি লক্ষ্য করেছেন, ছয়তলায় ইন্ডিয়ান একটা নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। তাই বন্ধুত্ব করার জন্য ছেলেকে দিয়ে পুরি আর তরকারি পাঠিয়েছেন। সে হলো নরেন্দ্রর ব্যাক-আপ। তারপর পেছন ফিরে চলে যেতে যেতে বলল, ‘আর ব্রুকলিন পলিটেকনিকে আমার মেকানিক্যাল ফাইনাল ইয়ার চলছে।’

আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ওরা দুজন উধাও হয়ে গেল। এর পর এলিভেটর দিয়ে ওঠানামার সময় মাঝেমধ্যে পরেশের সঙ্গে দেখা ও চোখাচোখি হয়েছে, কিন্তু কোনো কথা হয়নি। একদিন আমাদের ছয়’তলা থেকে ফাঁকা এলিভেটরে উঠে নিচের দিকে নামার পথে দেখি চারতলা থেকে পরেশ উঠল। আর কেউ ছিল না। দুতলাটা পার হতেই হঠাৎ সে কাছে এসে আমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকল। অতর্কিতে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়ে আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তা ছাড়া একতলায় যদি লিফট থামে, আর কেউ উঠে পড়ে দেখে ফেলে? দেখলাম, পরেশের ঠোঁট ও হাত দুটো অনেকটা শিথিল হয়েছে। কিন্তু আমার ব্যাড লাক। একতলায় লিফটটা থামল না দেখে সে আবার আগের মতো শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর গ্রাউন্ড লেভেলে এসে থামতেই, ছেড়ে দিয়ে এক দৌড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল।

এর চার মাস পর আবার একদিন এলিভেটরে অকস্মাৎ তার সঙ্গে দেখা। আমি রেগে বললাম, ‘তোমাকে দেখে অনেক ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু অমন জানোয়ারের মতো ব্যবহার করবে চিন্তাও করিনি।’

সে অবাক হয়ে বলল, ‘আশ্চর্য, কী খারাপ ব্যবহার করেছি?’

-তুমি বিনা অনুমতিতে আমাকে চুমু খেলে কেন? আর তারপর এলিভেটর থামতেই ওভাবে দৌড়ে পালিয়ে গেলে কেন?

-বারে, তুমি আমার ছোট বোনের মতো না? তাই স্নেহের বশে আদর করতে একটা চুমু দিয়েছিলাম।

-ফাজলামি কর? স্নেহের চুমো হলে তো গালে দিতে। ঠোঁটে দেওয়ার মতলবটা কী? ওটা যে অসভ্যতা, তা বোঝার বয়স আমার হয়নি ভেবেছ? তা ছাড়া আমাদের ইন্ডিয়ান কালচারে এত বড় ধামড়ি মেয়েকে কোনো যুবক ওভাবে স্নেহ দেখায়?

-কি বলছ তুমি? জানো, বিশেষজ্ঞদের মতে কয়েক মিলিয়ন ইয়ার্স আগে এই সিস্টেমটি স্তন্যপায়ীদের মধ্যে শুরু হয়েছিল। তখন মায়েরা খাবারগুলো চিবিয়ে নরম করে ঠোঁট দিয়ে তাদের বাচ্চাদের ঠোঁটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিত, আর সেগুলো খেয়ে বাচ্চারা বাঁচত, বড় হয়ে উঠত। টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির নৃতত্ত্ববিদ এবং চুম্বন বিশারদ ভন ব্র্যায়ান্টের মতে, প্রায় ৩৫০০ বছর আগে সংস্কৃতে লেখা বেদ-এর মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের মধ্যে চুম্বনের সূত্র পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে এক ধরনের চুম্বন প্রচলিত ছিল। তাতে নাকি তারা একে অন্যের সঙ্গে নাক ঘষাঘষি করত। এভাবেই ঘষতে ঘষতে একসময় নাক হড়কে, একজনের ঠোঁট অন্যের ঠোঁটে গিয়ে পড়ে। তখন তারা আবিষ্কার করে যে, ঠোঁট কিছু নরম, কিছু গরম, বেশ স্পর্শকাতর এবং খুবই আরামদায়ক শরীরের একটি অঙ্গ। এর পর প্রাচীন মিসরের কবিতার মধ্যেও এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যেমন—

‘And when her lips are pressed to mine

I am made drunk and need not wine

When we kiss, and her warm lips half open,

I fly cloud-high without beer!’

এসব শুনে আমি রাগ করব কী? ছোড়ার জ্ঞানের বহর দেখে আমি তো অবাক। তবু মনে মনে বলি, তুই ব্যাটা পুরো একটা শয়তান, এক নম্বরের মতলববাজ! জেনে শুনে অন্যায় করে এখন সাফাই গাইতে বসেছে। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো, আমিও যে পরম আনন্দে অভূতপূর্ব এক শিহরণ অনুভব করেছিলাম, সেটা কী করে অস্বীকার করব? সেই থেকে আমি তো মনে মনে সদাসর্বদা ওটাই, মানে ওকেই কামনা করে আসছি।

যাকগে, টু মেক ইট শর্ট, ওই দুষ্টুমিভরা চুমুটা আমার জীবনে শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদ হয়ে আসে। আমরা বিয়ে করি। এখন ছেলেমেয়েরা সবাই বড় হয়ে অন্যান্য স্টেটে সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা আর কোথাও যাইনি। বুড়োবুড়ি রিটায়ার করে নিউইয়র্কের এই কুইন্সেই একটা বাড়িতে থাকি। আমি নার্সিং থেকে রিটায়ার করলেও আমাদের এখানকার এলমহার্স্ট হাসপাতালে সপ্তাহে দু দিন পার্টটাইম কাজ করতাম। এর পর হারামি করোনাভাইরাস যখন এল, তখন ফুলটাইম ডিউটির ডাক পড়ল। বাড়িতে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রাখার জন্য এক বিছানায় আর শুতে পারি না। আলাদা রুমের বদলে, বেসমেন্টে ৮ থেকে ১০ ফিট দূরত্ব রেখে আমাদের আলাদা আলাদা বিছানা সাজানো হলো। এত দিনের অভ্যাস, রোজ রোজ আলিঙ্গন করে দিনে দু-তিনবার চুমু খাওয়া না হোক, দুজন দুজনকে অন্তত দেখতে পাব সেই আশায়। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট হলেও এই সাময়িক বিচ্ছেদ ব্যবস্থায় একভাবে চলছিল।

একদিন সকালে কাজে যাওয়ার আগে শরীরটা একটু দুর্বল লাগল। শুনে নরেশ অস্থির হয়ে এসে কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘তোমার তো কোনো টেম্পারেচার নেই। ভালো ঘুম হয়নি মনে হয়। যা খাটাখাটুনি যাচ্ছে! আজকে এসে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। একটা ভালো ঘুম দিলে ফ্রেশ হয়ে যাবে।’ এই বলে সে আগের মতো গভীর আবেগভরে ঠোঁটে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল, ‘যাও, চিন্তার কিছু নেই। সাবধানে থেকো আর প্রোটেকটিভ গিয়ার, মাস্ক ও গ্লাভস ঠিকমতো পরে নিয়ো।

হাসপাতালে ঘণ্টা দু-এক কাজ করার পর শরীরের দুর্বলতা আরও বেড়ে গেল। অন্য নার্সরা দুবার টেস্ট করে দেখল, আমার টেম্পারেচার বাড়ছে। আমার কিন্তু কোনো শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল না। শুনে ডাক্তাররা করোনা আক্রান্ত হয়েছে সন্দেহ করে আমাকে আর ছাড়েনি। ওখানেই ভর্তি হতে হলো। তিন সপ্তাহ পর যখন বাড়ি ফিরে এলাম, দেখি কেউ কোথাও নেই, বাড়ি ফাঁকা। বুঝলাম, আমি পুরো সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত কেউ আমাকে আমার চরম সর্বনাশের খবরটা দিতে চায়নি।