পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, তবে...

করোনার প্রকোপ কমে এসেছে আমেরিকায়। মানুষ ফিরছে স্বাভাবিক জীবনে। উত্তাল এক ঝড়ের শেষে যেমন নাবিক খুঁজে পায় তার পথ, তেমনি যেন করোনা ঝড়ের পর মানুষ পথে পা ফেলেছে। অথচ এই পথ তার চেনা-জানা। মনে হচ্ছে, ঝিমিয়ে থাকা আমেরিকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। ঘরবন্দী থাকা মানুষ দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঘরের বাইরে পা ফেলছে। এসেছে গ্রীষ্ম, প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে পাখা মেলতে শুরু করেছে। পাতা ঝরা নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোতে এসেছে সবুজ পাতা, চোখ মেলেছে ফুলের কুড়ি। আবহাওয়া চমৎকার, ঝকঝকে রোদ, ঝিরিঝিরি বাতাস। মনে হচ্ছে, এইতো সেই আমেরিকা, সেই দেশ। তবে লকডাউন এখনো চলছে। কিছুটা শিথিল হয়েছে। তবে যে সব এলাকায় ভাইরাসের প্রকোপ এখনো অনেক বেশি, সেসব এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত আছে।
লকডাউনের সুফল বলা যায়। এর ফলেই আমেরিকার অনেক রাজ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে আসছে। তাই ট্রাম্প প্রশাসন অর্থনীতির কথা চিন্তা করে সবকিছু খুলে দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু ডা. অ্যান্টনি ফাউসি বলছেন, এখনো সে সময় আসেনি। কারণ ভাইরাস একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এখনো আছে। লকডাউন তুলে দিলে মানুষ বাইরে এলে জনসমাগম হলে আবারও ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে পারে নিঃসন্দেহে। তাই ভেবেচিন্তে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক বলছেন, ধাপে ধাপে খুলে দেওয়ার কথা। যেসব অঙ্গরাজ্যের কাউন্টিতে একেবারে ভাইরাসের প্রভাব কম, নেই বললে চলে প্রথম সেখানকার অফিস মার্কেট সব খুলে দেওয়ার কথা। যেকোনো দেশের মেরুদণ্ড হল অর্থনীতি। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়লে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, মানুষের মৌলিক চাহিদার কথাও ভাবতে হবে। খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সরকার সহযোগিতা করছে, কিন্তু বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরিয়ে যায়। তাই যেসব এলাকায় ভাইরাসের প্রকোপ একেবারেই কম সেগুলো খুলে দেওয়ার কথা চলছে, যাতে অর্থনীতি সচল থাকে।
করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হওয়ায় এখন জনমনেও এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। যারা নন-ইমিগ্রান্ট, ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকে ভাবছেন ভবিষ্যতে দেশে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেশে গিয়েও যে সুবিধা করতে পারবেন না, তাও বুঝতে পারছেন। কারণ সেখানেও করোনা হানা দিয়েছে, কত দিন এর প্রকোপ থাকে কে জানে? অনেকের জীবন যেন হ্যাঙ্গারে ঝোলানো শার্টের মতো ঝুলে আছে। মানুষ এখন একধরনের আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, কী হবে ভবিষ্যতে এই ভেবে। বিশেষ করে যারা ছোটখাটো ব্যবসায়ী তারা আছেন বিপদে। ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পর তারা পথে বসে গেছেন বলা চলে। অনেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। যদিও এখন তা স্থগিত করেছে অনেক রাজ্যে। কিন্তু কোন কিছু একবার ভাটা পড়ে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতেও সময় লাগে। তবে আগের সেই অবস্থানে ফিরে আসাও যায় না।
অনেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, কী করবে। বিশ্বে আমেরিকাতেই সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ। এবং মৃতের সংখ্যাও এ দেশেই বেশি, প্রায় ৯০ হাজারের কাছাকাছি। কিছুদিন আগেও এমন সংখ্যা দাঁড়াবে কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। অনেক পরিবার তাদের শোক কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সামনে কী করলে ভালো থাকবে, তাই ভাবছে। তবে বুকের গহিনে আপনজন হারানোর ক্ষতটা থেকেই যাবে। পৃথিবীর কোন ওষুধ নেই, এই ক্ষত মুছবার।
বিল গেটস অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, কোন মহামারি আসলে আমাদের প্রস্তুতি কী? আমাদের স্বাস্থ্য খাতে আরও গবেষণা প্রয়োজন, আরও অর্থ ব্যয় করা দরকার। কিন্তু কেউ তার কথা গুরুত্ব দেয়নি। এখন আলোচনা চলছে কী করে ভ্যাকসিন বাজারে আনা যায়। চলছে ট্রায়াল।
গবেষকেরা চেষ্টা করছেন তাদের সাধ্যমতো। তবে তারা এটাও বলছে, এই করোনাভাইরাসের রেস থেকে যাবে প্রায় দুই বছর। ভ্যাকসিন বাজারে না আসা পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়। যেকোনো মুহূর্তে জনসমাগম থেকে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। লকডাউনের ফলে এখন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমে আসছে।
তাই লকডাউন এখনই তুলে দেওয়া মানে আবার ভাইরাসের থাবায় আক্রান্ত হওয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, করোনাভাইরাস যে আবার ফিরে আসবে না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আবারও ফিরে আসতে পারে। তবে ফিরে আসলে তার রূপ হবে আগের চেয়ে ভয়াবহ।
আবারও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হব আমরা। তাই খুব সতর্কভাবে চলতে হবে। হুট করে যেন সারা দেশে লকডাউন তুলে না দেয়।
চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, এক সময় লকডাউন ও কঠোর পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু সেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি চলার চার মাস পর আবার ভাইরাস ফিরে এসেছে। অনেকে আবার আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায়, ভাইরাস তার রেস রেখে যাচ্ছে। অবশ্য গবেষকেরা বলেছে, আগামী দুই বছর পর্যন্ত ভাইরাসের রেস থেকে যাবে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক মানে এই না, আগের মতোই জীবনযাপন করা যাবে। হ্যান্ডশেক, জনসমাগম, অনুষ্ঠান—এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। নিজের মতো করে যা খুশি করা, সেই দিন আর আসবে না। একটু অসতর্কতা বা অবহেলা চলাফেরায় বিপদ ডেকে আসনতে পারে। করোনাভাইরাস তার জিন পরিবর্তন করে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। ফলে ভাইরাস বিলুপ্ত হয়ে গেছে ভাবলে, ভুল ভাবা হবে। অন্যান্য ফ্লুয়ের মতোই হয়তো থেকে যাবে এই ভাইরাস। আমাদের হয়তোবা সাবধানতা অবলম্বন করেই চলতে হবে ভ্যাকসিন বাজারে না আসা পর্যন্ত। এ এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরছি ঠিকই, কিন্তু সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক। নিয়মের বাইরে গেলেই বিপদ। ভাইরাস যেন ওত পেতে আছে সুযোগের অপেক্ষায় মানুষকে আক্রমণ করতে। আর মানুষ চাইছে নিজেকে রক্ষা করতে।
তবে এটুকু বলা যায়, আগের থেকে পরিস্থিতি এখন অনেক ভালোর দিকে, ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে।