ঈদের দিনে মিসরীয় বন্ধুর নিমন্ত্রণ

মিসরীয় বন্ধু মোবারক। দীর্ঘ চার দশকে আমেরিকার জীবনবৈচিত্র্যে মিশে যাওয়া এক মানুষ মোবারক। দেখতে অনেকটাই আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের মতো, এই সুবিধাটাও প্রায়ই নেন তিনি। নিজের ঐতিহ্য নিয়ে টানটান মোবারক আমার মার্কিন সহকর্মীদের মধ্যে এক রহস্যময় মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অনেক কিছু। অন্যরা মোবারককে একজন বিরক্তিকর মানুষ মনে করেন। আর আমি ছাই ভস্মে মুক্তা খোঁজা মানুষ, তাই খুঁজি।

ইরাক, সিরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ার মতো মুখ্য আরব প্রজাতন্ত্রগুলোর অনেক বিষয়ে জ্ঞান পশ্চিমা বিশ্ব থেকে কম। ষাটের দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল এলাকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এসব অঞ্চল। মিসরে ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল যে গোষ্ঠী, মোবারক প্রথম যৌবনে সেসব লড়াইয়ের উত্তাপ পেয়েছিলেন। নিজেও জড়িয়ে গিয়েছিলেন। একজন সমাজবাদী মিসরীয় বলে আড্ডায় আলোচনায় নিজের পরিচয় দিতে ভুল করেন না। একপর্যায়ে লড়াইয়ের মাঠ থকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ আমেরিকার এক প্রান্তিক জনপদে তাঁর নোঙর। এমন শিকড়হারা লোকজনের নোঙরের জায়গা আমেরিকা। আমেরিকায় থাকেন।

কর্মস্থলে মোবারককে সহকর্মীরা এড়িয়ে চলেন। আচরণগত কারণে তাঁকে আমার সব সময় ভিন্ন মনে হয়। তর্ক করেন, মানুষকে অবজ্ঞা করে কথা বলেন। কিছু হলেই নিজের রক্তে মিসরীয় ঐতিহ্যের কথা বলেন। তাঁর এসব বাগাড়ম্বর আমার আমেরিকান সহকর্মী জর্জ হজম করেন। বলেন না কিছু। মোবারক সরে গেলে জর্জ বলতে থাকেন, মোবারক মনমানসিকতায় এখনো ষাট-সত্তর দশকে পড়ে আছেন। ৪০ বছর আমেরিকায় থেকেও মোবারক যে আমেরিকান হতে পারেননি, এ কথা বলতে ভোলেন না জর্জ।
ঈদের দুদিন আগে মোবারক ফোন করেন। আমি ভড়কে যাই। মোবারকের ফোন মানেই বিস্তর এক অভিযোগের তালিকা বা আদি রসাত্মক কৌতুক শোনাবেন। এর কোনোটাই চলমান এ সময়ে শোনার ইচ্ছা কারও নেই। আমারও নেই। অনিচ্ছায় ফোন ধরতেই মোবারক হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। কান্না আর থামছে না। দ্রুত ভাবছিলাম, কী হতে পারে? মোবারকের স্ত্রী কি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেন?
ইব্বি (এই এক জায়গায় মোবারক পুরো আমেরিকান। আমাকে ইব্বি ডাকেন)
স্থির হও বন্ধু! নির্ভয়ে বলো, কী হয়েছে!
আর বেশি দিন বাঁচব না ইব্বি।
আমরা কেউ বাঁচব না। এ নিয়ে কান্নার কিছু নেই। তুমি আমি মরলে এ জগৎ সংসারের কিছু যায়–আসে না। এখনো তো মরে যাওনি। কান্নাকাটি করে মারা যাওয়ার দরকার নেই।
ইব্বি, তুমি জানো, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। আমার বন্ধুদের মধ্যে সবাই মূর্খ আরব। আমেরিকান বন্ধু বলে তুমি যাকে মনে করো, এই জর্জ লোকটা আমাকে মনে মনে ঘৃণাই করে! জীবনে কী পেলাম ইব্বি? তোমাকে না পেলে আমার বন্ধুহীন মৃত্যু অবধারিত হয়ে উঠেছিল।
বুঝলাম মোবারক আবেগে পড়েছেন। পার্টিতে পানীয় বেশি পড়লে মোবারক এমন উল্টাপাল্টা কথা প্রায় বলেন। আমি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি।
অনেক পেয়েছ। দুই সন্তানকে লেখাপড়া করিয়েছ। মিসরে বিপ্লব করতে চেয়েছিলে। সেসব ছেড়ে সাম্রাজ্যবাদের দেশে এসে এখানের সব সুবিধা নিয়েছ। আমেরিকায় বাড়ি–গাড়ি করেছ। প্রাণ ভরে এ দেশকে গালিও দাও। সুন্দরী স্ত্রী তোমার ঘরে। অবশ্য জর্জ মনে করেন, মিসরে আরও গোটা দুয়েক স্ত্রী আছে তোমার। এ কারণেই কিছুদিন পরপর মিসরে যাও।
এই ব্যাটা রেসিস্ট জর্জের কথা বাদ দাও।
মোবারক, আমি তোমার সব কথা শুনব। তুমি জর্জের বা অন্য কারও বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না আজ।
ঠিক আছে, তাই হবে। আমি কারও বিরুদ্ধেই আর কিছু বলব না। কিন্তু আমার সমস্যা নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আগে বলো বন্ধু রমাদান করিম কেমন যাচ্ছে?
মোবারক, আবার ভুলে যাচ্ছ। বিশ্বাস, রাজনীতি—এসব নিয়ে জিজ্ঞাসা না করার জন্য আমাদের বন্ধু জর্জ বারবার বলে থাকেন।
আবারও এ কথা বলছ তুমি? আমি নিজের কথা তো বলতে পারি।
তা পারো। আমাকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। এখন শুরুতেই বলে নাও সমস্যার তালিকা। তারপর একটা একটা করে আমরা সমাধান করার চেষ্টা করব।
আমার সমস্যা একাধিক।
গুরুত্ব অনুসারে বলে যাও মোবারক।
মোবারক এবারে হাসলেন। বললেন, করোনাও তোমাকে বদলায়নি বন্ধু। এমন কাটকাট কথা বলতে পারো দেখেই তোমাকে ভালোবাসি।
মোবারক, আমার প্রশংসা করার লোক আছে। তোমার তা করার দরকার নেই।
লোক আছে মানে! এখানেই আমার সমস্যা। তুমি কি সাধু মনে করো নিজেকে?
মোবারক! ঝটপট করো বন্ধু। তোমার ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে।
ওকে ওকে, বলছি। আমার সমস্যা চারটি। এক, করোনাভাইরাস। দুই, ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিন, আমি। চার, আমার স্ত্রী ফাতিহা। অবশ্য তালিকার বাইরের বড় সমস্যা হচ্ছো তুমি—ইব্বি।
এবারে আমি হাসতে থাকি। মোবারক প্রায়ই রসিকতা করেন। আমাকে স্থির রাখার জন্য এমনটি বলছেন মনে করে আমি জবাব প্রস্তুত করি।
মোবারক, আমি দেখছি, এখানে সমস্যা একটাই। আর সেই সমস্যা হচ্ছে, তুমি নিজে। প্রথমত তুমি বলবে করোনাভাইরাস নিয়ে। এ নিয়ে তোমার আর কোনো সমস্যা নেই। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। রাষ্ট্রনেতারা ভাবছেন। এর মধ্যেই এ নিয়ে তুমি যা জানো, তার সবই ঠিক। আমাদের এ সমস্যা নিয়েই বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। এরপরেও ধরে ফেললে, জয় করতে হবে। এ কারণে মরে গেলে মরে যাবে। গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যেতে পারো, হার্ট ফেল করে মারা যেতে পারো—এসব আশঙ্কা নিয়ে বেঁচে থাকার মতো এ নিয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টা আমাদের করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। ব্যস, এ নিয়ে কান্নাকাটি করার কিছু নেই। দ্বিতীয় সমস্যা বলেছ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ নিয়েও তোমার কিছু করার নেই। পছন্দ না হলে আগামী নির্বাচনে ভোট দিয়ো না। আগেও দাওনি। তুমি ডেমোক্রেট। ফলে আরও চার বছর ট্রাম্পকে নিয়ে থাকতে হতে পারে। বেশি অপছন্দ করলে মিসরে চলে যাও। তিন নম্বর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারো। তোমার স্ত্রীকে নিয়েও আলোচনার দরকার নেই। সব ঘরেই এখন বিবাদ চরমে। তিন মাস হয় ঘরে থাকলে মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। করোনায় নয়, ঝগড়া করেই মারা যাওয়ার কথা ছিল আমাদের অনেকের। এখনো বেঁচে আছি!


ইব্বি, সব কিছুরই সমাধান পাচ্ছি। কিন্তু...
সমস্যা বলো।
ইব্বি, তুমি জানো, ব্যক্তিজীবনে আমি খুব অসুখী মানুষ। সন্তানদের মানুষ করেছি। ঘরে স্ত্রী, বাড়ি, গাড়ি আছে কিন্তু আমি খুব অসুখী মানুষ ইব্বি। আমি সুখী হয়ে মারা যেতে চাই। জানি, আর বেশি দিন বাঁচব না। এই যে বাঁচব না জেনেও আমি নিজেকে বদলাতে পারছি না। মারা যাওয়ার আগে আমি নিজেকে ভালো মানুষ হিসবে একজনের কাছে হলেও প্রমাণ করে যেতে চাই। আমার ডাক্তার থেরাপিস্ট বলেছেন কাছের বন্ধুকে যেন বেছে নেই।
মোবারক, আমি তোমার বন্ধু। আমাকে মন খুলে নিজের সব কথা বলে ফেলো। মারা গেলে তোমার স্মৃতি নিয়ে আমি বিরাট উপাখ্যান লিখব। এমন লিখে পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারি।
মোবারক হাসলেন না, আবার কাঁদতে শুরু করলেন।
মোবারক, অকপটে নিজের কথা বলো।
মোবারক বললেন, তাঁর মিসরীয় আদি গোত্রের বিশ্বাস, কেউ মন খুলে তাঁর পাপবোধের কথা প্রকাশ করে গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে পারে। এতে নাকি মৃত্যুযন্ত্রণা কম হয়। মৃত্যুর পর আত্মা শান্তি পায়!
বুঝলাম, মোবারকের মৃত্যু চিন্তা বেশ বেড়ে গেছে।
ঠিক আছে বন্ধু। একনাগাড়ে বলে ফেলো তোমার মনঃকষ্টের সব কথা। তোমার গ্লানিবোধের কথা।
ধন্যবাদ ইব্বি, আমি তাই করছি। তুমি তো জানো, আমি নানা অসুখে ভুগছি বেশ কিছুদিন থেকে। আসলেও আর বেশি দিন বাঁচব না। এর আগে আমি কিছু অভ্যাস ছেড়ে দিতে চাই। এর মধ্যে বেশি যা আমাকে পীড়া দেয়, তা হচ্ছে—অন্যের সুখ।

মোবারক বলছেন, আমি অন্যকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে ভালোবেসেছি জীবনভর। অন্যের কোনো দুর্বলতা থাকলে তা উসকে দিতে মন চায়। কোনো বন্ধু কাউকে পছন্দ করলে, ওই পছন্দের লোক সম্পর্কে অযাচিত কথা বলে আনন্দ পাই। কেউ কিছু বললে তর্ক করি। নিজেকে স্পষ্টবাদী দাবি করি। একান্ত বন্ধু বলে যে এগিয়ে আসে, তাঁর বিরুদ্ধে আমি লোকজনকে একত্র করার চেষ্টা করি। আবার বন্ধুর সঙ্গে চতুর আচরণ করে তাঁকে বোঝাই, আমি বন্ধুই আছি। আমি খুব হীনম্মন্যতায় ভুগী। নিজের মূর্খতা জেনেও তা আড়াল করে জ্ঞানীর ভাব করি। আমি মানুষকে অপমান করে আনন্দ পাই। কাউকে প্রশংসা করতে আমার কষ্ট হয়। অন্য কেউ কারও প্রশংসা করলে, আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি খুবই ঈর্ষাপরায়ণ লোক। অন্যের ভালো দেখলে আমার রাতে ঘুম আসে না। আমাকে যে পথ দেখিয়েছে সারা জীবন, আমি পারলে তার ক্ষতি করি। তার বিপক্ষে অবস্থান নিই। আমি কখনো কারও ঋণ স্বীকার করি না, আমি একটা মহাপাপী। আমি একটা অধম মানুষ—জীবনের এ পর্যায়ে এসে আর এসব করতে চাই না। বদলাতে চাই নিজেকে। তুমি কী বলবে, বেশির ভাগ মানুষই এমন? আমি কি পারব বদলাতে?

না, পারবে না। বেশির ভাগ মানুষ এমন নয়। তুমিও এমন না। আমাদের সবারই নানা সীমাবদ্ধতা আছে মোবারক। তোমার মতো একজন মানুষ, সে মৃত্যু চিন্তায় উপনীত হয়েও নিজেকে নিয়ে এমন সমালোচনা করতে পারে, সে নিজেও অনেক ভালো লোক। মোবারক, তুমি বদলাতে পারবে না ঠিকই। মানুষ কবর থেকে উঠে এসেও বদলায়নি এমন প্রমাণ আমার তোমার কাছে অনেক আছে। তুমি বদলাতে না পারলেও একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছ। তোমার এ উপলব্ধি নিয়ে আমি লিখব। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা দেখাব। তুমি যা, তা নিয়েই তোমাকে ভালোবাসি বন্ধু। তোমার আমার মতো মানুষ নিয়েই এ ধরা এমন সুন্দর। এ জীবন এমন বৈচিত্র্যের। নিজেকে নিয়ে এমন উপলব্ধির কথা বলতে পারার মধ্য দিয়ে তুমি হালকা বোধ করতে পারো।
তা করছি, আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে অনেক বছর। জীবনটা কত দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। আমি একটা একটা করে এসব থেকে বেরিয়ে এসে মারা যেতে চাই। (মোবারক কাঁদছেন)
মোবারক, তুমি না একদা বস্তুবাদ নিয়ে আমাকে কথা বলতে?
আজও বলি। সব সময়েই সন্দেহ নিয়ে জীবন কাটিয়েছি। আদর্শের সঙ্গে প্রতারণা করেছি। বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা করেছি। নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেছি। আর এসব করতে চাই না।
এসব নিয়ে মনোচিকিৎসকের কাছ থেকে থেরাপি নিচ্ছেন বলে মোবারক জানালেন। মনোচিকিৎসক বলেছেন, নিজের চিহ্নিত ত্রুটিগুলো লিখে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার জন্য। চিকিৎসক প্রতি সপ্তাহে তালিকা ধরে থেরাপি দেবেন একটা করে বিষয় নিয়ে।
ওকে, তাহলে তো একটা সমাধানের দিকে যাচ্ছে।

এবারে অন্য সমস্যার কথা জানার জন্য আমি উসখুস করতে শুরু করি। কথা দীর্ঘ হচ্ছে। আমি ইচ্ছুক মোবারকের স্ত্রীকে নিয়ে সমস্যার কথা শোনার। মোবারকের চেয়ে বয়সে ২৫ বছরের ছোট ফাতিহা। ফাতিহাকে কয়েক বছর আগে মোবারক মিসর থেকে নিয়ে এসেছেন। আগের দুই সন্তান অন্য পক্ষের। আগের স্ত্রী নিয়ে মোবারক কখনো কথা বলেন না। এ স্ত্রীকে অনেকটাই আগলে রাখেন। বলে দিয়েছেন, আমেরিকান লোকজনের সঙ্গে যেন মেলামেশা বেশি না করে। আমাদের অফিস পার্টিতে নিয়ে আসেন। অবশ্য আমার আর জর্জের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমরা কয়েক দফা অফিস ভ্যাকেশন করেছি এক সঙ্গে। মোবারকের স্ত্রীর সঙ্গে আড্ডা দিই। মাঝেমধ্যে ফোন করে মিসরের গল্প শুনি। নৃবিজ্ঞান নিয়ে ফাতিহার পড়ালেখা। আমার সঙ্গে মিসরীয় সভ্যতা, উত্তর আধুনিক মিসরীয় জীবন নিয়ে গল্প করেন। মিসরের ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ফাতিহা আমেরিকান নাগরিক হওয়ার জন্য মোবারকের কাছে পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করেছেন, এটুকু জানি।
মোবারক, এবার বলো, তোমার স্ত্রীকে নিয়ে কী সমস্যা। থাকতে চাচ্ছে না বেচারা?
না। জানো ইব্বি, আমার স্ত্রী মনে হয় তোমার প্রেমে পড়ে গেছে। এ লকডাউনে কিছুক্ষণ পরপর তোমার কথা বলে। ঘুরেফিরে তোমার প্রশংসা করে।

এ তো খারাপ কিছু নয় মোবারক। স্বামীর বন্ধুর প্রশংসা করে, ভালোবাসে—এর কোনোটাই সমস্যা হতে পারে না।
ইব্বি, যে জীবনে কোনো ভালোবাসা পায়নি, তার মর্মবেদনা তুমি বুঝবে না। আমার মনে হয়, মরে গেলে আমার স্ত্রী আমার বাড়িঘর নিয়ে তোমার কাছে চলে যাবে।
মোবারক, আমার বাড়ি, ঘর, স্ত্রী—সবই আছে। আমার কাছে আসবে কেন? আর আমরা কেউ কারও মর্মবেদনা আসলেই জানি না। বুঝি না।
ইব্বি, ফাতিহা আমাকে কাল বলেছে, আমি যেন আমার জীবদ্দশায় বলে যাই, মরে গেলে ওকে যেন তুমি দেখে রাখো।
মরে গেলে কেন? আমি, এখন থেকেই দেখভাল শুরু করতে পারি। তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে।
আপত্তি দিয়ে আমার কী হবে! শেষ বয়সে মেয়েটিকে মিসর থেকে নিয়ে এসে আমেরিকান করেছি। আমার ঘরে থেকে সে তোমার নাম জপ করে ইব্বি। আমার সহ্য হয় না। অবশ্য মেনে নিয়েছি মনে মনে। মরে গেলে মনে রেখো, তোমার এক বন্ধু কোনো নারীর হৃদয় জয় করতে পারেনি এক জীবনে। বঞ্চনার এ জীবনে শুধু প্রতারণাই পেয়েছি।
এসব তোমার দুর্বল মনের কথা মোবারক। থেরাপি নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।
মোবারক আবার কান্না শুরু করে দিলেন। জানালেন সামাজিক দূরত্বের বিধি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন বিকেলে যেন তাঁর বাসায় যাই।
আমি কি পরিবার নিয়ে আসব?
মোবারক না করলেন। জানালেন, তিনি নিজেও কোনো হুঁক্কা পার্টিতে যাবেন। সামাজিক দূরত্ব মেনেই আরব বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের হুঁকা আড্ডা। তাই বললেন, আমি যেন একা যাই। তাঁর স্ত্রী খুশি হবেন। ঘরে একা আমাকে ঈদের আপ্যায়ন করাবেন। মিসরীয় ঐতিহ্যের সব খাবার নাকি থাকবে।
মোবারকের এমন প্রস্তাব শুনে আমি তার থেরাপির ডাক্তারের নম্বরটা চেয়ে নেই। মোবারক হাসি আর কান্নার মধ্যে ফোনটা রেখে দেন।