তারুণ্য জিতলে বাংলাদেশ জিতবে

নতুন করোনভাইরাস ভয়াবহ ছাপ রেখে যাবে পৃথিবীর বুকে। এই সময়ে মানুষের অমানবিক হয়ে ওঠার গল্প অনাগত মানব সন্তান জেনে যাবে কোনো এক দিন। সেই দিন যেন কেউ কেউ শোনাতে পারে মানুষের মানবিকতার উপখ্যান। সেই দিন যেন কেউ বুক চিতিয়ে বলতে পারে, মানুষের মধ্যে কেউ কেউ মহামানব হয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়ে ছিল অন্য মানুষের জীবন। বিজ্ঞানের কঠোর সাধনা আর মানবিক মানুষের সংকল্প টিকিয়ে রেখেছিল মানব সভ্যতাকে। এই করোনাকালে নিউইয়র্ক বসেই বাংলাদেশে তারুণ্যের জয়গান দেখেছি। এই তারুণ্য জিতলে বাংলাদেশ জিতবে।

কাঠফাটা রোদের ভেতর রাজধানীর গুলশান অঞ্চলের পুলিশের ডিসি সুদীপ চক্রবর্তীর গাড়ি ছুটছে। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে মানুষের দরজায় দরজায় খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। খবরে পড়েছি পুলিশের এই মানবতার গল্প শুধু গুলশান থানার নয়, সমস্ত ঢাকার, সারা বাংলাদেশের। মহাখালির যে সড়কগুলোতে পুলিশের গাড়ি দেখে দৌড়ে পালাত ছিন্নমূল শিশুরা, সেই রাস্তায় তারা ভয়হীন হাত পেতে আছে পুলিশের গাড়ির সামনে। পুলিশ তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে সুস্বাদু খাবার। এই সব ভালোবাসা ছোঁয়াছে হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। করোনার দিন গেলেও যেন ভালোবাসা এই পৃথিবীতে থেমে না যায়। করোনা আতঙ্কে যখন লাশ সৎকারের লোক নেই, আছে দাফনে বাধা, তখন দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন পুলিশ ও প্রশসনে থাকা মানবিক মানুষেরা। করোনাকালে আমূল বদলে গেছে বাংলাদেশ পুলিশের স্বভাব ও চরিত্র। তরুণেরাই এই রং বদলে দিয়েছেন।

সিলেটের মানুষ মুনাওয়ার মইনুল। ইউরোপ-আমেরিকার সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগ করে দেশের মানুষেল জন্য কাজ করছেন রাজধানীতে থেকে। তরুণ মইনুল খুঁজে বের করছেন প্রকৃত ভুক্তভোগীদের। কোনো প্রচারে না গিয়ে, কোনো ছবি না তুলে, নীরবে সাড়ে তিন কোটি টাকা পাঠিয়েছেন হাজার হাজার অসহায় মানুষের জন্য। মইনুলের ৪ বন্ধু প্রবাস থেকে অর্থ দিয়ে এই কার্যক্রম বেগবান রেখেছেন। তাঁরা কেউ কোথাও নিজের নাম প্রকাশ করেন না। এর মধ্যে একজন ৫৩ লাখ টাকা দিয়ে বলেছন, আমার নাম যেন কেউ না জানে। এমন অনেক নাম না জানা মানুষ, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মানুষ এই সময়ে হয়ে উঠেছেন অতি মানব। সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বিদ্যানন্দ সারা দেশে মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। এমন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অসহায় মানুষের আশ্রয় হয়েছে তপ্ত রোদে বটবৃক্ষের মতো।

মহামারীর এই নিদানকালেও সরকার দলীয় বিভিন্ন নেতার ত্রাণসামগ্রী চুরির গল্পে পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব হতে দেখেছি। যখন পত্রিকার পাতা পেরিয়ে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে আপামর জনতা, তখন খুব নীরবে কোথাও কোথাও ঘটে গেছে এক বিশাল পরিবর্তন। বিভিন্ন জেলার নেতারা যখন ‘বিধিসম্মত’ উপায়ে চুরি কীভাবে করবে তার ছক আঁকছেন, তখন বাগেরহাট–২ আসনে চালু হলো ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল। করোনা সংকটে বাংলাদেশে এমন উদ্যোগ এটাই প্রথম। এপ্রিল মাসের ১ তারিখ বুধবার সে আসনের তরুণ সাংসদ শেখ সারহান নাসের তন্ময় এই ব্যবস্থা চালু করেন। ভাইরাস আতঙ্কে সাধারণ রোগীরা যখন হাসপাতালে যেতে ভয় ও আতঙ্কে শঙ্কাগ্রস্ত, তখন তরুণ তন্ময়ের এই অগ্রপথিক পদক্ষেপে বাংলাদেশ আশার আলো দেখে।

এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ। বাগেরহাট-২ আসন পেরিয়ে গল্পটা এগিয়ে যায় নড়াইল-২ আসনে। সেই আসনের সাংসদ ‘ক্যাপ্টেন’ মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেখানেও চালু হলো একই রকম চিকিৎসাসেবা। কোনো হীনমন্যতায় না ভুগে এক তরুণ সাংসদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন আরেক তরুণ। তরুণদের শক্তিটা এখানেই। ভালোর জন্য সব অনুকরণে এই সম্প্রদায় দ্বিধাহীন। বাগেরহাট–২, আর নড়াইল–২ এর এই উদ্যোগ দৃশ্যমান হওয়ার কথা ছিল সমস্ত বাংলাদেশজুড়ে। হয়নি। কক্সবাজার থেকে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের আরেকটি সংবাদ আসে ৭ মে। এর উদ্যোক্তাও একজন তরুণ। তিনি সেই জেলার ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ জয়। জয় স্বপ্ন দেখেন তরুণ প্রজন্ম তন্ময়-মাশরাফির মতো তরুণ রাজনীতিবিদদের কার্যক্রম দেখে একদিন ‘আই লাভ পলিটিক্স’ লিখবে তাদের ফেসবুক বায়োতে।

দিকে দিকে খবর আসছে দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই ছোঁয়াচে রোগ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাল দিয়ে চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন জেলায়। সেই সব সংবাদ তোয়াক্কা না করে কোনো কোনো চিকিৎসক নিজের জীবন বিপন্ন হবে জেনেও নিজের খরচে পিপিই জোগাড় করে নিজস্ব চেম্বারে ও হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন। সেখানেও তরুণদেও সংখ্যা ছিল অগ্রগণ্য। তার পরও চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে অনেক মানুষ। ঠিক তখন নড়াইল–২ আসনের সাংসদ মাশরাফি সেফটি চেম্বার স্থাপন করেন। তিনি জানান দিলেন আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে যুগোপযোগী কার্যক্রম ও জনসম্পৃক্ত রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই।

মাশরাফির নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহনে ১১ মে নড়াইল-২ আসন করোনামুক্ত ঘোষণা হয়েছে। এই খবর আশাবাদের। এই খবর তরুণ নেতৃত্বে আস্থা রাখার। সারা বাংলাদেশের মানুষ ধান কাটার অহেতুক সংবাদ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। একটা সময় মনে হয়েছে এই ধান কাটা শুধু বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ হওয়ার জন্য। ঠিক তখন নড়াইলে ধান কাটার অত্যাধুনিক মেশিন নিয়ে হাজির হয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, দ্য ক্যাপ্টেন। তাঁর অনুকরণে আরও কয়েক জেলায় মেশিনে কাটা হয়েছে ধান।

সেফটি চেম্বারের ধারণা দ্বিধাহীন চিত্তে মাশরাফিকে অনুকরণ করলেন তন্ময়। বাগেরহাটেও তিনি বানালেন সেফটি চেম্বার। এই দুই সাংসদ এ যাবৎ সংসদ থেকে যত বেতন পেয়েছেন, তা দিয়েই বেশির ভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তন্ময়ের নির্বাচনী আসনে হাজারের বেশি সদস্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল। তাদের নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। দুর্যোগকালে স্বেচ্ছাসেবা কেমন হবে, তা শেখানো হচ্ছে এই দলকে। তারা মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। হাসপাতালে নার্স সংকট হলে দায়িত্ব পালন করবে এমন প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে তাদের। এই দল নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই থাকবে। নিয়মিত ভাতাও পাবে তারা। এসবই আধুনিক চিন্তার ফসল।

শেখ তন্ময়ের এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরকার অথবা প্রত্যেক এলাকার সাংসদরা যদি এমন একটি দল গঠন করতেন, তাহলে দেশের মানুষ খুব উপকৃত হতো। শেখ সারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাটে গর্ভবতী মায়েদের ঘরে ঘরে পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন করোনা শুরুর প্রথম দিকেই। যে শিশু এখনো জন্মায়নি তার জন্যও ভাবেন একজন প্রতিনিধি। এমন উদ্যোগ আশা জাগানিয়া। এমন প্রতিনিধিই তো চায় বাংলাদেশ, যার ভাবনা হবে সুদূরপ্রসারী।

প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ নড়াইল, বাগেরহাট, কক্সবাজারসহ আরও কিছু জেলার তরুণ নেতৃত্বের কার্যক্রম দেখেছে বাংলাদেশ। এমন নেতৃত্ব ছোঁয়াচে হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলাদেশের শহর-নগর-গ্রাম-গঞ্জ ও বন্দরে। এই ক্ষীণ আলো বড় হয়ে একদিন চৌর্যবৃত্তি-দুর্নীতি-অশুভপরায়ণতা অতিক্রম করে ঘোষণা দেবে নতুন এক অস্তিত্বের, সেই তরুণ অস্তিত্বের নাম বাংলাদেশ। তারুণ্য জিতলে বাংলাদেশ জিতবে।