করোনাকালে স্যার ফ্রান্সিস বেকন কী ভাবতেন

এই ঘরবন্দী সময়ে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপসহ অনলাইন দুনিয়াই মানুষে–মানুষে যোগাযোগের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। ছবি: রয়টার্স
এই ঘরবন্দী সময়ে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপসহ অনলাইন দুনিয়াই মানুষে–মানুষে যোগাযোগের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। ছবি: রয়টার্স

এক.
করোনাকালে স্যার ফ্রান্সিস বেকন জীবিত থাকলে অবশ্যই একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, সামাজিক দূরত্ত্ব, শারীরিক দূরত্ত্ব—এসব বিষয় নিয়ে অনেক 'রচনা' লিখে ফেলতেন। ষোড়শ শতাব্দীতে লন্ডনে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ আইনজ্ঞ, দার্শনিক, বিজ্ঞান গবেষণর পথিকৃত স্যার বেকন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যেগুলো নিয়ে লেখেননি। বন্ধুত্ত্ব, বিয়ে, ঈর্ষা, ভালোবাসা, সাহসিকতা থেকে শুরু করে মৃত্যুর মতো বিষয় নিয়ে তাঁর অনেক লেখা আছে। অতি সাধারণ বিষয়গুলোকে বেকন তাঁর দার্শনিক প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়ে চিরকালের মানুষের জন্য অসাধারণ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তাঁর জীবনকালে বিচিত্র বিষয়ের ওপর তাঁর লেখা ৫৯টি প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়।

ষোড়শ শতাব্দীর এ দার্শনিকের রচনাশৈলী, উপস্থাপনার ভঙ্গি, বিষয়–বিশ্লেষণ এতই অনন্য ছিল যে, তিনি শুধু আধুনিকই নন, উত্তরাধুনিক বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। বেকনের রচনাগুলো ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য। রচনাগুলো পাঠের বাধ্যবাধকতা থাকলেও পাঠ শেষে আনন্দানুভূতিও কম হয় না। এ কারণে সাহিত্যের শিক্ষার্থীই শুধু নয়, বিশ্বজুড়ে সব মানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় স্যার বেকন। করোনাকালে এই মানবিক বিপর্যয়ের সময় জীবিত থাকলে অসাধারণ প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির কাছ থেকে সমগ্র বিশ্ববাসী হয়তো জীবনাচরণ ও করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও করণীয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা ও প্রস্তাব পেয়ে যেত। যা করোনা মোকাবিলায় সব মানুষকে ইতিবাচকভাবে সহায়তা করতে পারত।

দুই.
মানুষ যখন একা থাকে, তখন নাকি সবচেয়ে কম একা থাকে। এ সময় পেছন ফিরে তাকায় মানুষ। স্মৃতির মিছিল সেলুলয়েডের ফিতার মতো মনের গহীন থেকে উঠে এসে চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। চরিত্রগুলোর সঙ্গে কথা হয়, সময়ের সঙ্গে কথা হয়, বিষয়ের সঙ্গে কথা হয়। চোখ বন্ধ করে আমি নিজেও হাজার মানুষের ভিড়ে এমন খেলা খেলতে পারি। সে খেলায় সামিল হন অনেকেই। স্কুলের সামনের আচার বিক্রেতা, আইসক্রিমের মোহনীয় বাক্সে রয়েল, কোহিনুর, কাকলি নামের আইস্ক্রিম বিক্রি করতেন যারা, সেসব মানুষ থেকে শুরু করে অনেক প্রিয় চরিত্র এবং প্রিয় বিষয়ের সঙ্গে খেলা করি। যেমন কিশোরবেলায় দুপুরের ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেয়ালে আকাশ, নদী, মেঘ, রাজা, সিপাহী, যুদ্ধ্ব সবকিছু দেখতে পেতাম এবং তাদের সঙ্গে মনে মনে খেলা করতাম; ঠিক সেরকম। ইদানীং হয়তো বয়সের কারণে দেয়ালের গায়ে চেষ্টা করেও কিছু দেখতে পাই না।

তবে লকডাউনের এই অদ্ভুত সময়ে আমি চোখ বন্ধের খেলাটা খেলছি নানাভাবে। আমার অবচেতন মনে জমে থাকা অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ চরিত্রের মধ্যে বেকন একজন উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তাঁর সঙ্গেও কথা হয়। তাঁর রচনাগুলো পুনঃপাঠ করি। কথা যখন হয় না, তখন আরও বেশি কথা হয়। শারীরিক দূরত্বের কারণে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রয়োজন, অপ্রয়োজন মেটানোর জন্য কত রকম বিকল্পই না ব্যবহার করছে মানুষ। মানুষের দূরত্ব মেটানো, ভাব বিনিময়, বিনোদনের অদ্ভুত উপায়গুলো দেখে নিশ্চয় বেকনের মনে অনেক দার্শনিক চিন্তার উদয় হতো, যেখানে মানুষের জন্য তাঁর কিছু সর্বজনীন নির্দেশনাও হয়তো থাকত। কী ভাবতেন বেকন? যখন দেখতেন, মানুষ শুধু ব্যবহারিক প্রয়োজন নয়, সামাজিকভাবে কাছকাছি থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই যে কাছে থাকার, পাশে থাকার আকুল ইচ্ছা, এর মধ্যে কোনো স্বার্থ চিন্তা নেই। এর মধ্যে কোনো ক্ষুদ্রতা নেই। বেকন হয়তো তাঁর স্বভাবসিদ্ধ্ব কঠিন বিশ্লেষণ শেষে বলতেন—মানুষ আসলে পরস্পরকে ভালো না বেসে থাকতে পারে না, ওপর থেকে তাদের যতই নির্দয় বা নিষ্ঠুর মনে হোক না কেন।

তিন.
অপ্রস্তুত মানুষকে করোনা চমকে দিয়েছে এবং থমকেও দিয়েছে। সামাজিকভাবে কাছে এসে আনন্দ উৎসব, ভালোবাসা–বাসি প্রকাশ করার প্রত্যক্ষ সুযোগকে শুধুমাত্র সীমিতই করেনি, প্রায় বন্ধই করে ফেলেছিল। বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মানুষ তাই কাছে আসার, উষ্ণ ভালোবাসার জন্য অনেক বিকল্প বেছে নিয়েছে। করোনাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিজেদের নিরাপদে রেখে বিভিন্ন বয়সের মানুষ পরস্পরের কাছে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিয়মিত।

প্যারিস থেকে 'প্যারিসের জানালা' নাম দিয়ে সিলেটের মেয়ে, বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মৌসুমী চক্রবর্তী মানুষকে জাগিয়ে রাখার জন্য, মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হক, শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্যকে যুক্ত করেন, যুক্ত করেন কলকাতা, লন্ডনসহ অনেক দেশের সংগীত শিল্পী, বাচিক শিল্পী, নৃত্য শিল্পীকে। ফেসবুক লাইভে তিনি সারা পৃথিবীর অনেক মানুষকে যুক্ত করে চমৎকার কতগুলো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। মৌসুমীর নামটি উদাহরণ হিসেবে এল। মানুষের সংহতি বাড়ানো যে প্রয়োজন, তা মানূষ এই করোনাকালে দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করছে। এ জন্যই সারা পৃথিবীর মানুষ ফেসবুক লাইভ, জুম, স্কাইপ, ওয়েবনারসহ অসংখ্য অ্যাপের মাধ্যমে আলোচনা, গান, আবৃত্তি, নাটক এমনকি সংগীত প্রতিযোগিতা পর্যন্ত আয়োজন করছেন।

বাঙালির ভালোবাসার কবি রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী সারা পৃথিবীর বাঙালি এবার বিচিত্র আয়োজনে বিভিন্ন অ্যাপের ব্যবহার করে পালন করেছে। করোনা–ভীতি ও কত দিন থাকবে, আমরা জানি না। তত্ত্ব, তথ্য ও বিশেষজ্ঞ অভিমত বলছে, খুব সহসা আমাদের করোনা–পূর্বকালে অনুশীলিত জীবনে ফিরে যেতে দেবে না। করোনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই যে ভার্চ্যুয়াল সম্পর্ক দিয়ে আমরা কাছে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, অনুশীলিত জীবন থেকে বাইরে গিয়ে আর কত দিন আমরা এমন জীবন অব্যাহত রাখব? জীবনের প্রয়োজনে হয়তো এ প্রচেষ্টা আরও কিছু মাস, কিছু বছর চালিয়ে যেতে হবে। হয়তো গায়ে হলুদ, বিয়ের মতো জীবনের অতি প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানও এভাবে উদ্‌যাপিত হবে। দেখা গেল গায়ে হলুদ হচ্ছে কনের বাড়িতে, আর জুম অ্যাপে যুক্ত আছেন অনেক সংগীত শিল্পী, নৃত্য শিল্পী, যুক্ত আছেন কনের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। গান হচ্ছে, নাচ হচ্ছে, কথা হচ্ছে; কিন্তু সবই প্রযুক্তির মাধ্যমে। অনলাইনে অর্ডারে খাওয়াও পৌঁছে যাচ্ছে, প্রত্যেকে আয়েশ করে খাচ্ছে, কথা বলছে জুমে। একজন সঞ্চালকও থাকছেন। খাওয়া–দাওয়া, নাচ–গান, আড্ডার পর সঞ্চালক এক সময় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষের ঘোষণা দিচ্ছেন। এভাবে বিয়ে, নবান্নের উৎসব, পয়লা বৈশাখসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসবও হতে পারে। যেমন করে এবারের 'বিশ্ব মা দিবস' অনুষ্ঠিত হলো সারা পৃথিবীতে। এমন ভার্চ্যুয়াল জীবন খুব সাময়িক, আর এই সাময়িক জীবনকে আনন্দময় করে তোলার জন্য এত রকম আয়োজন। মেঘনাদের মতো মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করে গেলে অদৃশ্য ভাইরাস নির্মূল হবে অচিরেই। মানুষ যে কত সম্ভাবনাময়, তা শুভশক্তিসম্পন্ন মানুষেরা খুব ভালো জানেন। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানী দল, পেনসিলভানিয়ার বিজ্ঞানী দল, রোমের বিজ্ঞানী দল, বেইজিংয়ের বিজ্ঞানী দল যখন একসঙ্গে কাজ করেন, সঙ্গে যখন বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবী থেকে তত্ত্ব, তথ্য দিয়ে সাহায্য করা হয়, তখন কি বসন্ত দূরে থাকতে পারে। মোটেই না। শুভশক্তির যোগফল, শুভ সময়কে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারে দ্রুত—এটাই নিয়ম।

চার.
অতঃপর মানুষের ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা, শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর কাল শেষ হবে। আবার সূর্যালোকিত দিনে কিংবা জ্যোৎস্নালোকিত রাতে, প্রিয়ার কোলে মাথা রেখে সংগীতের সুর মূর্ছনায়, তরুণ প্রেমিক–প্রেমিকারা ভালোবাসাকে নতুন করে উপলব্ধি করা শুরু করবে। ভালোবাসবে আমাজনকে, ভালোবাসবে সুন্দরবনকে, ভালোবাসবে অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলসহ সমুদ্র, আকাশ, পাহাড়সহ সমস্ত প্রকৃতিকে। সাতটি মহাদেশের মানুষ, এক আকাশের ছাদের নিচে অবস্থানকে একই বাড়িতে, একই পরিবারে অবস্থান হিসেবে মনে করবে। এই ভূ–গ্রাম প্রকৃত অর্থে একটি গ্রামের মানুষের মমতা, ভালোবাসায় প্লাবিত হবে। এমন ভালোবাসা থেকে প্রকৃতিকে ভয় করার যে অসুখ সৃষ্টি হয়েছে, সে ভয়কে সফলভাবে জয় করবে মানুষ। মায়ের হাতের মায়ার ছোঁয়াতে- জাদুর মতো জ্বর ছেড়ে যাবে, উষ্ণ আলিঙ্গন, উষ্ণ করমর্দন আবার নির্বাসিত প্রত্যক্ষ ভালোবাসাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। ফ্রান্সিস বেকন সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে মানুষের ভালোবাসা নিয়ে নতুন করে লিখবেন ভালোবাসা নিয়ে তাঁর নতুন রচনা, শিরোনাম হবে—'করোনাকালে মানুষের ভালোবাসা'। তিনি তাঁর রচনায় লিখবেন—মানুষকে কোনোভাবেই উষ্ণ, প্রগাঢ়, রোমান্টিক ভালোবাসা থেকে ফেরানো যায় না। মানুষের জীবনই আসলে প্রকৃত ভালোবাসা–বাসির বসতিস্থল।