সেই ভুল পথেই আছেন ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

নতুন করোনাভাইরাস আমেরিকার ১ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। ২৭ মে আমেরিকায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়েছে। এই মানুষগুলোর জন্য এমনকি একটি এপিটাফও লেখার সময় হয়নি। শুধু মৃতের সংখ্যা কেন, জীবিতদের মানবেতর জীবনও এমনকি আর কোনো প্রশ্ন হয়ে সামনে দাঁড়াচ্ছে না। এক ভয়াবহ নির্লিপ্ততার মধ্যে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই যেন।

যেকোনো কিছুতেই এক লাখ—ছয় অঙ্কের এই সংখ্যা একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। এটি মৃত্যু না হয়ে অন্য কিছু হলে হয়তো একটি উৎসবের উপলক্ষও হতে পারত। কিন্তু তা তো হওয়ার জো নেই। কারণ এ সংখ্যা চলে যাওয়ার, হারানোর। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আমেরিকার মানচিত্র থেকে রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে এক লাখের বেশি মানুষ। এ সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে, তা কেউ জানে না। অথচ এত প্রাণহানি হয়তো হতোই না, যদি শুরু থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া হতো।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, সেন্টারস ফর ডিজিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের প্রধান ন্যান্সি মেসোনিয়ার ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গণপরিসর বন্ধের সুপারিশ করলেও তা মধ্য-মার্চের আগে শোনা হয়নি। তত দিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। অথচ সেই ২২ জানুয়ারি থেকেই কিনা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন, ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ এমনকি হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রশাসনের ভাষ্যটি সামনে নিয়ে আসা ল্যারি কুডল যখন বলেন, ‘আমরা ভাইরাসটিকে বন্দী করে ফেলেছি। একেবারে এয়ারটাইট হয়তো নয়, তবে তার কাছাকাছি।’ কুডলর এই ভাষ্যকে সমর্থন জানান ট্রাম্প। তাঁর কথাটি আরও স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় এ ভাইরাস কিছুই করতে পারবে না।’ নিজের ক্ষমতার বড়াই করে দেওয়া এ বক্তব্যের পর কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই অবশ্য তাঁকে নামতে হয়েছিল চীনকে ‘ভিলেইন’ হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে। কারণ, এ ছাড়া তাঁর আর কোনো কিছু করার  ছিল না।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার পর একটা লম্বা সময় পেয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন তখন শত সতর্কবার্তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিরোধী পক্ষ ও চীনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই ব্যস্ত ছিল। সঙ্গে ছিল চিরাচরিত দাম্ভিক উক্তি—আমেরিকায় এ ভাইরাস কিছু করতে পারবে না। এই দম্ভের কারণেই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মার্কিন প্রশাসন ভাইরাসটি রুখতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি ভাইরাসটি আমেরিকায় হানা দেওয়ার পরও সাড়া দিতে বিলম্ব করেছে। খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অন্য নানা ইস্যুর মতোই এ ক্ষেত্রেও ছড়িয়েছেন নানা বিভ্রান্তি, যা সংকট মোকাবিলাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এসব না হলে এত মৃত্যু হয়তো হতো না।

এ ভাইরাসে আমেরিকার সব ধরনের মানুষ আক্রান্ত হলেও অভিবাসী ও অশ্বেতাঙ্গদের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি।  আর এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মার্কিন পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, আমেরিকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হলেও কোভিড-১৯-এ মারা যাওয়া আমেরিকানদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। মধ্য-এপ্রিল পর্যন্ত মারা যাওয়া আমেরিকানদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় জীবাণুবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য পেয়েছেন।

মোটাদাগে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বর্তমান থেকে অতীতে পরিণত হওয়া আমেরিকানদের স্মরণে নিউইয়র্ক টাইমস এক বিশেষ প্রকাশনা করছে। ওই প্রকাশনায় কোনো এপিটাফ ছাড়াই, কোনো শেষকৃত্য ছাড়াই, কোনো প্রিয়জনের চোখে চোখ, হাতে হাত রাখা ছাড়াই জীবন ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের প্রতি এক সম্মিলিত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে। মার্কিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এমন নানা নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। এই দুঃসময়ে সব ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে মানুষের জন্য দিনরাত সেবা দিয়ে যাওয়া চিকিৎসক ও নার্সদের শ্রদ্ধা জানাতে আমেরিকানরা পথে নেমেছেন। কোনো কোনো অঞ্চলে দেওয়া হয়েছে গার্ড অব অনার। কিন্তু ঠিক একই সময়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় প্রশাসন বারবার করে এই পরিবর্তিত বাস্তবতার কথা ভুলে, জাতীয় ঐক্যের কথা মুখে একবারের জন্য না এনে প্রতিপক্ষ খুঁজেছে। প্রতিপক্ষ তার প্রয়োজন ছিল, কোভিড-১৯ মহামারিতে নিজের দেওয়া বিলম্বিত সাড়াকে আড়াল করতে। প্রতিপক্ষ প্রয়োজন ছিল নিজের প্রস্তুতিতে থাকা ঘাটতিকে আড়াল করতে। সর্বোপরি এই প্রতিপক্ষ তার এখনো প্রয়োজন ছয় অঙ্কের কোটায় পৌঁছে যাওয়া মৃত্যুর সংখ্যাকে আড়াল করার জন্য।

এই কয়েক মাসে মানুষের জীবন ভয়ানকভাবে বদলে গেছে। শুধু আমেরিকা নয়, পুরো বিশ্বের মানুষের জীবন, জীবনযাপন এক ভীষণ বদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে যেসব বিষয় আবার ঘটবে বলে কখনো ভাবাই হয়নি, তাই এখন নৈমিত্তিক হয়ে গেছে। খোদ আমেরিকায় ভাতার জন্য আবেদন করা বেকারের সংখ্যা চার কোটির পর্যায়ে। এ তো রীতিমতো অকল্পনীয়। কিন্তু এটাই এখন সত্য।

এটা সত্য যে, কোভিড-১৯ এর মতো সংকট শত বছরে একবার হয়তো আসে। কিন্তু এই সত্যই তো দাবি করে যে, এমন সংকট যখন আসবে, তখন সাধারণ মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া প্রশাসন তার দায়িত্বটুকু খুবই সততা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করবে। কিন্তু এই সময়ে আমেরিকার প্রশাসন শুধু অব্যবস্থাপনার উদাহরণই সৃষ্টি করেনি, একই সঙ্গে এটি সেই বিভাজনের রাজনীতিও চালিয়ে নিয়ে গেছে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকেই চালিয়ে গেছেন।

মার্কিন ফেডারেল সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে অঙ্গরাজ্য ও নগর পর্যায়ের প্রশাসনের সংকট মোকাবিলায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে ঘাটতি ছিল, তা আড়ালে পড়ে গেছে। কারণ, ফেডারেল সরকারের তুলনায় স্থানীয় সরকারগুলো দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। অথচ, এটা তো সত্য যে, খোদ নিউইয়র্ক নগরীর মেয়র বিল টি ব্লাজিওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিলম্ব করেছেন। হোটেল-রেস্তোরাঁও খোলা ছিল শুরুর বেশ কিছু দিন, যা ভাইরাসটির বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। শুরু থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া গেলে হয়তো এর বিস্তার অনেকটাই সীমাবদ্ধ রাখা যেত। ফলে বেঁচে যেত ঝুঁকিতে থাকা অনেকে।

এতসব যখন ঘটছে এবং ঘটে চলেছে তখন আগের মতোই নিজেকে দায়মুক্ত বলে দাবি করে আসছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই মার্চেই, আমেরিকায় সংকটের শুরুর ধাপের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এর কোনো দায় নেব না।’ হ্যাঁ, ট্রাম্প বরাবরের মতোই কথা রেখেছেন। তিনি এর কোনো দায় নেননি। এবং উপরি হিসেবে তিনি পুরোদস্তুর দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা বলেছেন, আচরণ করেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমেরিকা এই পুরো সময়ে এক নেতৃত্বশূন্যতার মধ্য দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এই সময়ে যে প্রশ্নটি সব থেকে বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে, তা হলো—আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্টের কেন প্রয়োজন? আর এই মারাত্মক প্রশ্নটি এমন সময় উত্থাপিত হচ্ছে, যখন আর মাত্র কয়েক মাস পরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফলে ট্রাম্প উদ্বিগ্ন হয়েছেন এবং এই উদ্বেগ থেকে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার সবই বলা যায় তাঁর ব্যক্তি স্বার্থেই। তা না হলে, কোনো গণপরীক্ষা ছাড়াই সব খুলে দেওয়ার মতো প্রস্তাব তিনি আনতেন না।

এখন যখন নিউইয়র্কসহ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গরাজ্যগুলো পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, তখন এমন তাড়াহুড়া করে অর্থনীতি খুলে দিলে, তা আবার বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কাটি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। খিল একটু আলগা হলেই ঢুকে পড়তে পারে।

শুরুর দিকে সংকটকে অস্বীকার না করলে এত মৃত্যু হয়তো দেখতো না আমেরিকা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বহু পরিবার প্রিয়জন হারানোর বেদনায় নীল হতো না। ভুলে গেলে চলবে না যে, মৃত্যুর সংখ্যা বললে এক একটি সংখ্যা সামনে এলেও এই প্রতিটি সংখ্যা আদতে এক একজন মানুষ।  সম্প্রতি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতিটি যদি আরও এক সপ্তাহ আগে থেকে চালু হতো, তবে অন্তত ৩৬ হাজার মানুষের জীবন বাঁচতে পারত।

বলা হচ্ছে, সংকট-পরবর্তী সময়ে যেসব গবেষণা হবে, সেগুলোয় আমেরিকার এত বিস্তৃত ক্ষতির পেছনের কারণ হিসেবে আঙুলটি বারবার ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের দিকেই তাক করা হবে। এই সময়ে এসে দ্বিতীয় আঘাতের বিষয়ে দেওয়া বিভিন্ন বিজ্ঞানীর সতর্কবাণীকেও অস্বীকার করা হচ্ছে, যা আরেকটি মহাভুল হতে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা বলে, এই ভুল হতে পারে লাখো মানুষের মৃত্যুর কারণ। সিএনএনের তথ্যমতে, আমেরিকার ১৪টি অঙ্গরাজ্যে এখনো ভাইরাসটির বিস্তার বাড়ছে। ১৭টি অঙ্গরাজ্যে একই ধারায়—ভাইরাসটি বিস্তার করছে আর ১৯টি অঙ্গরাজ্যে এর বিস্তার কমে আসছে। কিন্তু ফেডারেল সরকার ১৯টি অঙ্গরাজ্যকেই ৫০টি অঙ্গরাজ্যের বাস্তবতা বলে প্রচার করে সামগ্রিক অর্থনীতি পুরোদমে চালুর পদক্ষেপ নিচ্ছে। অথচ, আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি বারবার করে সেই একই সতর্কতা দিয়ে যাচ্ছেন, ‘অতি আত্মবিশ্বাস বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই খুব সাবধানে এগোতে হবে।’