'বড় যদি হতে চাও শত্রু হও তবে'

মানুষের স্বভাব অনেকটাই একটি পাত্রে রাখা কাঁকড়ার মত। যখন একটি কাঁকড়া ওই পাত্রটি অতিক্রম করে ওপরে উঠতে যাবে তখন বাকি সব কাঁকড়া মিলে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তেমনি আপনি পাত্রের ওপরে বা সাফল্যের সিঁড়িতে উঠতে চেয়েছেন বলে অনেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার শত্রু বনে যাবে। কিন্তু তাই বলে আপনাকে থেমে থাকলে চলবে না। বারবার চেষ্টা করে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে। সব বাধা দৃঢ়তার সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে।

আপনি হয়তো ছোটবেলায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘বড় কে?’ কবিতাটি পড়েছেন। এই কবিতায় উল্লেখযোগ্য একটি লাইন হচ্ছে, ‘বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।’ আক্ষরিক অর্থে এই লাইনের পরমার্থ বোঝা মুশকিল। কিন্তু কবি এখানে বলতে চেয়েছেন, বিনম্র চিত্তে কাজ করলেই বড় হওয়া সম্ভব। কবি এখানে বড় হতে হলে কেমন মানসিকতার প্রয়োজন সেটা বলেছেন। কিন্তু আসল বাস্তবতাকে সংগ্রাম করে কীভাবে অতিক্রম করতে হবে তা তুলে ধরেননি। এখানে কবির সমালোচনা না করাটাই উত্তম। সময়ের সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারা বদলায়। নতুন ভাবনা নিয়ে মানুষ ভবিষ্যতের তরীতে পা দেয়। কিন্তু বাস্তবে আপনি যদি বড় হতে চান, তবে আপনাকে মানুষের শত্রু হতে হবে—এটাই নিয়ম। বাংলা সাহিত্য একটু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কবি স্বয়ং নিজেই এ কবিতাটি লিখে অন্যের শত্রু হয়েছেন। কেননা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের এই কবিতাটি এতই জনপ্রিয় হয়েছে যে কবিতাটির জনক এখন অনেকেই হরিশচন্দ্র মিত্রের কবিতা বলে ভেবে নিয়েছে। এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, আপনি যদি বড় হতে চান তবে আপনাকে মানুষের শত্রু হতে হবে? আরও বিশদভাবে আলোচনা করা যাক।

এই সংসারে কেউ চায় না আপনি বড় হোন, উন্নতির শিখরে পৌঁছে যান। কারণ সবাই নিজেদের অনেক বড় মনে করে। আপনি বড় হলে সংসারে তাদের মূল্য কমে যাওয়ার ভয়। তাই তারা মনে মনে আপনার ক্ষতি চাইবে। যারা আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী বলে নিজেদের জাহির করে, তারাই বিনা কারণেআপনার সমালোচনা করবে। আবার অনেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনার ক্ষতিও করতে চাইবে। আপনার দোষ হচ্ছে, আপনি এগিয়ে যেতে চান। কিন্তু সেই ভয়ে আপনি পিছপা হবেন না। আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে, উন্নতির শিখরে পৌঁছতে হবে। ভেবে দেখুন, উন্নতির শিখরে পৌঁছানো যদি সহজ কাজ হতো, তাহলে সবাই তাদের জীবনে সফল হতো। যারা অন্যের সঙ্গে শত্রুতার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখে তারাই তাদের জীবনে অগ্রগতির পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।

পাঠক হয়তো বলতে পারেন, আপনি বলেছেন এই সংসারে কেউ চায় না যে আমি বড় হই কিন্তু আমার খুব কাছের একজন বন্ধু আমাকে প্রতিনিয়ত ভালো করতে উৎসাহ দেয়। সে আমাকে এগিয়ে যেতে উপদেশ দেয়। একটু ভেবে দেখুন, আপনার সে বন্ধুটি আপনার চেয়ে প্রতিষ্ঠিত? যদি হয় তাহলে সে আপনাকে তার চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আপনাকে উপদেশ দেবে না। যেমন ধরুন, আপনার বন্ধুটি একজন ডাক্তার। তাহলে সে আপনাকে নার্স হওয়ার জন্য উপদেশ দেবে বা বড় জোর তার মত ডাক্তার হওয়ার জন্য উপদেশ দিতে পারে। কিন্তু সে নগরের বড় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হতে আপনাকে কখনো উৎসাহিত করবে না। আপনি যদি তার কথামত ডাক্তারি পাস করেন, তাহলে সে আপনাকে আগের চেয়ে আরও বেশি পাশে চাইবে। কিন্তু আপনি যখনই তার চেয়ে উচ্চপদের আশায় কাজ করে যাবেন, তখন সে আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখবে বা আপনার পেছনে আপনার সম্পর্কে কু–রটনা করতে চাইবে। এ সময় আপনার মনোযোগ আপনার আত্মোন্নতির দিকে থাকতে হবে, বন্ধু মনের অবস্থার দিকে নয়। আপনি যদি আপনার বন্ধুত্ব বজায় রাখতে বা বন্ধু মন খারাপ না করতে পদোন্নতির জন্য চেষ্টা না করেন, তাহলে সে সুযোগ পেলে ওই পদটি লুফে নেবে। তখন আপনি তার অবস্থান নেবেন এবং আপনার বন্ধুকে শত্রু ভাববেন। তাই আপনার বন্ধু আপনাকে শত্রু ভাবলেও আপনাকে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে হবে।

আবার ধরুন, আপনার বন্ধুটি একজন বড় ব্যবসায়ী। সে সব সময় দেখছে আপনি কিছু করছেন না, তাই সে বারবার আপনাকে কিছু করতে বলছে। নানা রকমের উপদেশ সব সময় দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত সে আপনাকে তার মত একটি বড় ব্যবসা করতে অনুপ্রাণিত করবে না। খুব ভালো বন্ধু হলে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আপনাকে তার কর্মচারী হয়ে কাজ করতে বলবে। আপনি যদি তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে অর্থ সঞ্চয় করে নিজে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে চান, তাহলে আপনাদের বন্ধুত্বের ফাটল ধরবে। আর যদি তার চেয়েও আরও বড় কিছু করতে যান, তাহলে সে আপনার পেছনে লাগবে। সে আপনার শত্রু হয়ে যাবে। 

এবার একটু ভেবে দেখুন, যদি আপনার সে বন্ধুটি আপনার চেয়ে অনেক কম প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে সে কি করতে পারে? সে আপনাকে হয়তো আরও বড় হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। কারণ সে জানে, সে হয়তো কোনো দিন আপনার সমস্থানে পৌঁছতে পারবে না। কিন্তু আপনি আরও বড় পর্যায়ে পৌঁছলে সে বন্ধুত্বের খাতিরে আপনার কাছ অনেক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে। কিন্তু যদি একদিন আপনি তার একটি অনুরোধ না রাখতে পারেন, তাহলে সে আপনাকে আর অনুপ্রাণিত করবে না। বরং সে আপনাকে তার শত্রু ভাবতে শুরু করবে বা আপনাকে এড়িয়ে চলবে। আপনার পেছনে সে নানা ধরনের সমালোচনা করে যাবে। এতে আপনার পিছপা হওয়ার কোন কারণ নেই। জীবন হচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার, যে থমকে যাবে সে কোনো দিন উন্নতি করতে পারবে না। জীবনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে শত শত বাধার মধ্যে অন্যের শত্রু হওয়াও একটি বাধা—যা আপনাকে অতিক্রম করতে হবে।

এবার বলি, আপনার দুঃখে অনেকেই দুঃখী হলেও আপনার সুখে কেউ সুখী হয় না। তাই তারা আপনার কোন সুখের সংবাদ পেলে মিষ্টি খাওয়াতে বলে। কেননা, তার জানে আপনার সুখে তাদের ভেতর কেমন এক অসহনীয় বোধ কাজ করছে। আমাদের যখন মনে হঠাৎ কোন অসহনীয় বোধ কাজ করে, তখন পেটে কামড় দিয়ে ওঠে—যা অনেকে ভুল ব্যাখ্যাবশত ক্ষুধা মনে করে। তাই যদি মিষ্টি খাওয়ান, তাহলে অন্তত তাদের পেটের ক্ষুধাটি কমবে এবং সাময়িকের জন্য পেটের কামড় দূর হয়ে যায়।

পাঠক হয়তো বলতে পারেন, আপনি বলেছেন আমাদের দুঃখে সবাই দুঃখী হলেও আমাদের সুখে সবাই সুখী হয় না। এটা সত্য নয়। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন। মানুষের জীবনে তাদের বিবাহের দিনটি কতই-না সুখের। কিন্তু আপনার বিয়েতে সবার আসার জন্য নিমন্ত্রণ আপনাকে করতে হয়। সবার সেবা করতে হয়, আবার সবাইকে ভালোমন্দ খাওয়াতে হয়। তাহলে কি আসলে তারা আপনার সুখে সুখী? এবার লক্ষ্য করুন, যদি আপনার বাবা–মা মারা যায়, তাহলে কতজন বিনা নিমন্ত্রণে আপনার কাছে আসবে? আবার কিছু খেতেও চাইবে না। মানুষের জীবন দুঃখে পরিপূর্ণ, তাই আমরা অন্যের দুঃখ দেখতে পছন্দ করি। কেননা এতে আমাদের একপ্রকার ভালো অনুভূতি হয়। অন্যের দুঃখ দেখলে নিজের দুঃখ সহজে ভোলা যায় এবং নিজেকে অন্যের চেয়ে অনেক সুখী মনে হয়।

কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ‘পরের দুঃখের কথা করিলে চিন্তন, আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ?’ এবার হয়তে বুঝতে পারছেন। তাহলে আপনি যদি জীবনে উন্নতি করে এগিয়ে যান তাহলে আপনার ভালো কাজকর্ম প্রতিনিয়ত এদের স্মরণ করে দেবে, তারা আসলে কতটাই অসুখী। আর মানুষ অসুখী থাকতে পছন্দ করে না—মানুষ সুখী থাকতে পছন্দ করে। সুখের জন্য মানুষ যেকোনো কাজ করতে প্রস্তুত, এমনকি আপনার শত্রু হতেও! তাই একবার ভেবে দেখুন—আপনাকে বড় হতে হলে অন্যের শত্রু হতে হবে।