প্রবাসের মাটিতে বাঙালির চাষবাস

গাছপালা ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে সূর্যের তাপ। হ্যাঁ, গ্রীষ্ম এসে গেছে দরজায়। কিন্তু ভূ-প্রকৃতি আজ বড্ড বৈরী। নভেল করোনাভাইরাসে মলিন পৃথিবীর সকল আনন্দ। করোনা মহামারির ছোবলে মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। চলছে আত্ম উপলব্ধির নীরব খেলা।

থমকে থাকা এ গল্পের ভেতরে কেউ কেউ মাটির দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পেলেন। আমরা মানুষেরা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি প্রকৃতিকে ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। তাই সবাই এখন আপন নিবাসে থেকে বাগান আর প্রকৃতির মধ্যে আনন্দ খুঁজছেন। কৃষিপ্রধান দেশ থেকে আসা বাঙালিরাও পিছিয়ে নেই। বৈশ্বিক করোনা মহামারির সময়ে প্রবাসী বাঙালিরা চাষবাস করার জন্য আরও বেশি তাগিদ অনুভব করছেন। তাই অন্য বছরের চেয়ে এবার তারা আরও বেশি মনোযোগী। গ্রীষ্মকাল আসার আগেই সবাই  বাগান  করতে ব্যস্ত উঠেছেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময়ও ভালো কাটছে এবং সময়েরও সদ্ব্যবহার হচ্ছে। এ ব্যস্ততা যেন কৃষিকাজের শিকড়ের কথাই আরও বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে।

বাঙালিদের সত্তা ও শিকড়ের সঙ্গে মিশে আছে কৃষিকাজের আনন্দ-বেদনা। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসেও প্রবাসে বাঙালিরা নিজেদের রসনা স্বাদের সঙ্গে সংগতি রেখেই চাষবাস করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বাগান করার মধ্য দিয়ে প্রবাসী, তথা অভিবাসী বাঙালিরা মা-মাটির একটি স্বাতন্ত্র্য পরিচয় তুলে ধরেন। বিশেষভাবে উত্তর আমেরিকাতে গ্রীষ্মকাল এলেই বাঙালিরা কাজের ফাঁকে বাগান করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কঠিন পরিশ্রমের পরও ঘরে ফিরে বাঙালিরা লাউ, কুমড়ো, করলা, শসা, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, শিম, মরিচ, ডাঁটা, টমেটো, পুঁইশাক, পাটের বীজ বোনেন। কেউ আবার গাঁদা, গন্ধরাজ আর গোলাপের চারাও লাগান। জায়গা না থাকলে কেউ আবার টবে সবজি ও ফুলের চাষ করেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্রীষ্মকালে রাস্তা ধরে হাঁটার সময় টালির ওপর লতানো লাউ, কুমড়ো ফুল আর বাড়ির আঙিনায় সারি সারি গাঁদা ফুলের বাহার দেখে বাইরে থেকেই বোঝা যায় যে, এটা বাঙালির বাড়ি। কেউ শখের বসে, কেউ আবার দেশি শাক-সবজি খাওয়ার তৃপ্তির জন্য এ চাষ করেন। চাষবাস কৃষিপ্রধান দেশের মানুষের   রক্তে। তাই দেশে বাগান না করলেও প্রবাসে     সবাই ঠিকই বাগানবিলাসী হয়ে ওঠেন। বাপ-দাদাদের দেখে বা শুনেই এই বাগান চাষের বিলাসিতা। তবে প্রবাসে এ বাগান করতে করতে অনেকের ভেতরে এক ধরনের নেশা তৈরি হয়। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে সবজির বাগান করাটা অনেক বাঙালির কাছেই এখন অন্যতম শখে পরিণত হয়েছে ।

বাঙালিরা প্রবাসের মাটিতে সবজি চাষে ফিরে পান দেশি সবজির স্বাদ। বাগান করার এ আনন্দ নেশা দেহ-মন-আত্মায়ও নিয়ে আসে অনাবিল প্রশান্তি। স্বেচ্ছায় নির্বাসন নেওয়া, অথবা ভাগ্য অন্বেষী প্রবাসীর ভেতরেও গুমরে কাঁদে মাটির টান। তাই বাগানবিলাসী অনেক বাঙালি মনে করেন বাগান করার সময় তাঁরা কিছু সময়ের জন্য যেন বাংলার মানচিত্রেই ফিরে যান। এই প্রবাসে প্রতি বছর যারা সবজির বাগান করেন, তাঁদের অনেকটুকু চাহিদা এ বাগান থেকেই মিটে যায়। ফলে ঘরে বসেই তাঁরা বাংলাদেশের সবজির স্বাদ পান। আর নিজের বাগানের সবজি দিয়ে মায়ের ঢঙে নানা রকম তরকারি রান্না, আর ভর্তা বানিয়ে তৃপ্তি ভরে খান।

প্রবাসের মাটিতে চাকরি ও সংসার সামলে অবসর সময়ে নিজের আঙিনায় ফসল ফলানোর কাজে যারা সময় ব্যয় করেন, তাঁদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। বাগান করার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যও ভালো থাকে, আর অন্যদিকে শরীরের  রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। তবে চাষাবাদ ও দেশের শাকসবজির প্রতি প্রবল মমত্ববোধে থেকেই বাঙালিরা এ ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজ করেন। অনেক বাঙালি আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের বাসায় গিয়েও আন্তরিকভাবে নিজেদের বাগানের ফসল দেশীয় এই সবজি পৌঁছে দিয়ে আসেন। প্রবাসে বাঙালিরা কোনো প্রকার বিনিময় ছাড়া একজন আরেকজনের সঙ্গে এ সবজি ভাগ করে নেন।  কোথাও কোথাও গ্রীষ্মকালে অনেক প্রবাসী বাঙালি নিজ জমির সবজি দিয়ে একটা করে দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না করে এক জাগায় মিলিত হন। এতে করে প্রবাসের মাটিতে এক মানচিত্র থেকে আসা বাঙালিদের মধ্যে ভাব-ভালোবাসার সম্মিলন ঘটে। সহভাগিতার আতিথেয়তায় দূর পরবাস এ চর্চা যেন শিকড় আর সংস্কৃতির এক মিলন বন্ধন ঘটায়।

প্রবাসের মাটিতে বাঙালির চাষাবাদ পত্রপল্লবে বিকশিত হোক। যুগে যুগে টিকে থাকুক এ শুভ অভ্যাস। ভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় পরবাসে বাগানবিলাসী নেশা ঘুচে দেখ মনের সকল মলিনতা। ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজের প্রেরণায় জেগে উঠুক মা-মাটি-মানুষের চেতনা। প্রকৃতি আবার হেসে উঠুক মানুষের ভালোবাসায়। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজের আনন্দ সহভাগিতা ইতিবাচক মূল্যবোধে বাংলার অনন্য পরিচয় তুলে ধরুক বিশ্বময়।