তুমি নও একা

দরজার বেলটা আবার বাজল। এর আগেও মনে হয় কয়েকবার বেজেছে। অসুস্থ শরীরে সকালে ঘুম ভাঙার পরও একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। বিছানা থেকে উঠে লিভিং রুম পেরিয়ে দরজার পিপহোলে চোখ রাখতেই দেখে, পাশের অ্যাপার্টমেন্টের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। নীলিমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ঘরে দুজন অসুস্থ মানুষ। দেখার কেউ নেই। এর মাঝে এই সাত সকালে আবার কোন হুজ্জত। কলিং বেল আবার বাজল। নীলিমা আবারও পিপহোলে চোখ রেখে নিশ্চিত হয় পাশের বাসার ছেলেটাই। মাথার চুলে বিনুনি করা। নাকে কানে দুল। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। কার সঙ্গে যেন টেলিফোনে কথা বলছে। নীলিমা বেডরুমে গিয়ে আবিরকে গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখে গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
-এই শুনছ! পাশের বাসার কালো ছেলেটা এক নাগাড়ে বেল টিপে যাচ্ছে। এই সাত সকালে কী একটা বিপদ বল তো। তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর। এখন আমি কী করব?
-কিছু করতে হবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকো। হয়তো নেশাটেশা করে দরজা ভুল করে আমাদের দরজায় নক করছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঠিক চলে যাবে।
আবির যখন কাশতে কাশতে কথাগুলো বলছিল, তখন নীলিমার টেলিফোনে চঞ্চলের রিং। চঞ্চল নীলিমার জামাই। চঞ্চল আর ঊর্মি একমাত্র মেয়ে বুবলিকে নিয়ে বোস্টনে থাকে। রাতে ঘুমানোর আগে একবার কথা হয়েছে। শ্বশুর–শাশুড়ি দুজনই এক সঙ্গে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর থেকে ঘন ঘন খোঁজ খবর নিচ্ছে। লকডাউনের মাঝে খাবার, ওষুধ সবকিছুতেই টান পড়েছে। শুনে রাতেই চঞ্চল বলেছিল, দেখি সকালে কী করা যায়।
-মা, আপনাদের দরজাটা খুলুন। একজন আপনাদের খাবার আর ওষুধ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
-আর বলো না বাবা। আমরা তো আছি মহাবিপদে। তোমার শ্বশুরের জ্বরটা আবার বেড়েছে। এর মাঝে পাশের বাসার কালো ছেলেটা দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপে যাচ্ছে। সেদিন তুমি পুলিশ কল করে দিলে তারপর থেকেই তো আমরা ভয়ে ভয়ে আছি। তাঁকে কি কোনো বিশ্বাস আছে?
-আচ্ছা আমি পরে শুনছি। আপনি আগে দরজাটা খুলে খাবার আর ওষুধগুলো নিন। আমি লাইনে আছি। নীলিমার কথা শেষ করতে না দিয়েই চঞ্চল কথাটা বলল।
নীলিমা হাতে হ্যান্ড গ্লাভস আর মুখে মাস্কটা লাগিয়ে দরজা খুলে দেখে আর কেউ নেই। ওই কালো ছেলেটাই ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল, গুড মর্নিং। নীলিমা হতবাক হয়ে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে কোনো রাগ ক্ষোভের চিহ্নমাত্র নেই। ছেলেটা আবার বলল, গুড মর্নিং।
-গুড মর্নিং। নীলিমা বেশ আড়ষ্ট গলায় উত্তর দিল।
-আমার নাম অ্যান্ড্রু। মি. চৌধুরী আমাদের চ্যারিটিতে ফোন করেছিল তোমাদের খাবার আর ওষুধের জন্য। আমি এই পাশের দরজাতেই থাকি। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। কোনো লজ্জা করবে না।
নীলিমা আফ্রিকান ইংরেজি ভালো বুঝতে না পারলেও অ্যান্ড্রুর কথাগুলো আর সেই সঙ্গে তাঁর আন্তরিকতাটাও বেশ বুঝতে পারে। মনে হয় চেহারার সঙ্গে ওর আচরণের কোনো মিল নেই। হয়তো ওর আমেরিকাতেই জন্ম। নিউইয়র্ক আসার পর প্রথম প্রথম তো কালোদের দেখে খুব ভয়ই লাগত। ঊর্মি বলেছিল, ওরা কিন্তু সবাই খারাপ না মা। দেখে তোমার পছন্দ হবে না। দেখবে মাজা থেকে প্যান্ট নেমে পড়ে যাচ্ছে। অথচ প্রয়োজনের সময় ওই ছেলেটাই ছুটে আসবে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। আর কিছু সাদা চামড়া দেখবে। ফিটফাট পোশাক পড়া। সাহেব মেমসাহেব মার্কা চেহারা, ওরা তোমাকে দেখে নাক সিঁটকাবে। ট্রেনে বাসে তোমার পাশে বসবে না। তুমি ওদের পাশে বসলে ডিসগাস্টিং, ন্যাস্টি, রিডিকুলাস বলে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে থাকবে। তোমাদের নিউইয়র্ক বারো জাতির শহর। এখানে অনেক কিছুই বেশ গা সওয়া। সাদাদের স্টেটগুলোতে তো এসব জাতি বিদ্বেষ আরও ভয়াবহ।
নীলিমা যখন ব্যাগ হাতে এসব ভাবছে তখন অ্যান্ড্রু তাঁর দরজা খুলতেই হাই ভলিউমের মিউজিক এসে ধাক্কা খেল নীলিমার কানে। অ্যান্ড্রু ভেতরে কী যেন একটা ইশারা করতেই মিউজিকের শব্দটা কমে গেল। আর সেই নচ্ছার মেয়েটা দরজায় এসে মুখ বাড়াল।
-আমার বান্ধবী, জুলিয়া। অ্যান্ড্রু পরিচয় করিয়ে দিল নীলিমার সঙ্গে।
-হাই! গুড মর্নিং। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুশি হলাম।
-গুড মর্নিং। আমিও তোমাকে দেখে খুশি হলাম।
নীলিমা কথাটা আমেরিকানদের মতো ভদ্রতা করে বলল বটে কিন্তু মেয়েটাকে দেখলেই তাঁর কাছে অসহ্য মনে হয়। স্প্যানিশ একটা অতি সুন্দরী মেয়ে। কালো ছেলেটার সঙ্গে থাকে। আজ হাফ প্যান্টের ওপরে ছোট্ট একটা টপস পরা। সারা শরীরে উলকি আঁকা। নাভির ওপরে একটা দুল লাগানো। গালে, ঠোঁটে, চোখের ওপরে ভ্রুর মাঝে নানা রকমের গোঁজ ঢোকানো, ঊর্মি ওগুলোকে বলে পিয়ারসিং। আজ কথা বলার সময় মনে হলো ওর জিহ্বার ওপরেও বল্টু ধরনে একটা কিছু লাগানো। মাথার চুল একদিকে চেঁচে ওপরের দিকে তোলা। রুচির বলিহারি। বিল্ডিংয়ের করিডরের মাঝেই দুজন মিলে নানা রকম অসভ্যতা করে। চোখে পড়লে লজ্জায় নিজেদের চোখ বন্ধ করতে হয় অথচ ওদের কোনো লাজ লজ্জার বালাই নেই। আজও নীলিমার সামনেই জুলিয়া মেয়েটা অ্যান্ড্রুকে টান দিয়ে চুমু খেতে খেতে দরজা বন্ধ করল।
নীলিমা নিজের ঘরে ঢুকতেই তাঁর হাতের টেলিফোনটা বেজে উঠল। মনে পড়ল চঞ্চল যে এতক্ষণ লাইনে ছিল সেটা তো ভুলেই গিয়েছিল।
-সবকিছু ঠিকমতো আছে কিনা দেখে নাও। সেই কালো ছেলেটা কোনো ঝামেলা করেনি তো? এবার টেলিফোনে ঊর্মি কথা বলল।
-ওই ছেলেটাই তো খাবার আর ওষুধ নিয়ে এসেছিল। চঞ্চল নাকি ওদের অফিসেই ফোন করেছিল। আমি তো খুব ভয় পেয়েছিলাম। না জানি আজ আবার কী হয়। কথা বলার পর মনে হলো ছেলেটা খারাপ না রে। মানুষের এই বিপদের সময় ওরা ওদের সংস্থা থেকে কী উপকারটাই না করছে। আমাকে ওর বউ না বান্ধবী সেই নচ্ছার মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। কী অসভ্য জানিস? আমার সামনে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। কোন লাজ লজ্জার বালাই নেই। ওর নাম জুলিয়া আর ছেলেটার নাম অ্যান্ড্রু। কথা বলে মনেই হলো না যে, ওদের লাউড মিউজিক বাজানোর জন্য দুদিন আগে আমরা পুলিশ কল করেছিলাম।
-বাদ দাও তো মা! ওরা কীভাবে জানবে আমরা পুলিশ কল করেছিলাম। পুলিশ কী আর এসে আমাদের নাম বলবে। ওদের কাজ সতর্ক করার, সতর্ক করে দিয়ে গেছে। আর সব সময় এই সব অসভ্যতা অসভ্যতা করবে না তো! এত দিন এ দেশে থেকেও বুঝলে না ওগুলো এখানকার কালচার। তুমি বাবাকে ওষুধটা খাইয়ে দাও। জ্বরটা মেপে আর শ্বাসকষ্ট হয় কিনা খেয়াল রেখো। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। আর তুমিও নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। মনে রেখো দেখার কিন্তু কেউ নেই। তাই নিজেদের মতো করে যতটা সম্ভব ভালো থাকার চেষ্টা করো। আমি আবার পরে ফোন করব। এখন রাখছি, বাই।
টেলিফোন ছেড়ে নীলিমা দুজনেরই জ্বর মাপে। আবিরের ১০১ আর তাঁর নিজের ৯৯ ডিগ্রি। গলার ব্যথা আর কাশি দুটোই আরও বেড়েছে। বারবার আদা লবঙ্গের চা খেয়েও তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সারা দিন বিছানায় শুয়ে টিভি দেখে আর গান শুনে সময়গুলো বড় একঘেয়ে মনে হয়। মনের মাঝে নানা রকম ভয় আর আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে। দেখার কেউ নেই। দেশে হলে আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের সাহায্য পাওয়া যায়। এখানে দুজন মানুষ একা একা থাকা। কেউ একজন হারিয়ে গেলে তখন কী হবে, এটা ভাবতেই মনটা বিষণ্নতায় ভরে যায়।
ওষুধ খাওয়ার পর থেকে আবিরের জ্বরটা সারা দিন বেশ কমের দিকে ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনের ভেতরে ভয় বাড়ছে। ঊর্মি আর চঞ্চল সারা দিনে বেশ কয়েকবার টেলিফোনে খবর নিয়েছে। মাঝরাতের পর শ্বাসকষ্টটা আরও বাড়তে থাকল। মনে হলো হাসপাতালে পাঠানো দরকার। চঞ্চল আর ঊর্মিকে বারবার ফোন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। নীলিমা অসহায়ের মতো কাঁদতে থাকে। দেখে আবিরের হাতের নখ আর ঠোঁট কেমন যেন নীলচে হয়ে আসছে। হঠাৎ মনে পড়ল অ্যান্ড্রুর কথা। কয়েকবার নক করার পর জুলিয়া চোখে ঘুম নিয়ে দরজা খুলল।
-কে? কী হয়েছে? এত রাতে দরজা ধাক্কা দিচ্ছ কেন?
-অ্যান্ড্রুকে একটু ডেকে দেবে, প্লিজ। আমার স্বামীর খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ওকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
-৯১১ এ কল দাও। অ্যান্ড্রু তো এখন বাসায় নেই। আমি কী তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি।
-আমি তো কখনো ৯১১ এ কল করিনি। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে, প্লিজ!
-ও, আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। আমি কল করে দিচ্ছি। ওরা এক্ষুনি এসে যাবে। তুমি তোমার স্বামীকে রেডি করে ফেলো।
মিনিট দশেক পরে ইএমএসের লোকগুলো স্ট্রেচার নিয়ে ঘরে ঢুকল। কিছু চেক আপ সঙ্গে আইডি, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স কার্ড আর কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যসহ আবিরকে নিয়ে চলে গেল।
ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হয় নীলিমার। হতাশার সঙ্গে কী যেন এক শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরে। অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই এ ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে তার একটি প্রস্তুতি মনে মনে ছিলই। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা নতুন এক আঙ্গিকে ধরা দিল নীলিমার কাছে। আজ থেকেই কী আমি একা হয়ে গেলাম? আবির কী সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে? যদি ফিরে আসে, তত দিন কী আমি বেঁচে থাকব। এখন তো হাসপাতালে নাকি দেখা করতে দেয় না। আমাদের আবার কী কখনো দেখা হবে? নীলিমার মাথায় ৫০ বছরের নানা স্মৃতি এসে ভিড় জমাতে থাকে। রাতে আর ঘুম আসে না। ভোরের দিকে ঊর্মির ফোন আসে।
-বাবার অবস্থা এখন কেমন? তোমরা ভালো আছ তো?
ঊর্মির টেলিফোন পেয়ে কান্নায় ভেঙে পরে নীলিমা। বাঁধ দিয়ে বন্যার জল আটকে রাখার পর বাঁধ ভেঙে গেলে যেমন এক লহমায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় তেমন নীলিমার বুক ভেঙে কান্না আসে। তাঁর সব কথা ভেসে যায় কান্নার তোড়ে। ঊর্মি অধৈর্য হয়ে ওঠে। বুকের মাঝে চরম কোনো সংবাদের জন্য ঢিপ্ ঢিপ্ শব্দ করতে থাকে।
-তুমি কাঁদছ কেন? কী হয়েছে আগে বলবে তো?
-তোর বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমি যে একা হয়ে গেলাম রে। আমি কেন আগে মারা গেলাম না।
-তুমি এত কাঁদছ কেন? হাসপাতালে নিয়ে গেছে তো সমস্যা কী? ঠিকমতো চিকিৎসা পেলেই ভালো হয়ে যাবে। বেশির ভাগ মানুষই তো হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে ফিরে আসছে। তুমি তোমার দিকে খেয়াল রাখো। আমরা তো এখন বোস্টন থেকে নিউইয়র্ক যেতে পারছি না। তুমি নিজের মনকে শক্ত করো।
ঊর্মি মায়ের মন শক্ত করার কথা বলতে বলতে নিজের মন গলে জল হয়ে যায়। সে জলের উথালপাতাল ঢেউ এসে আছড়ে পরে বুকের মাঝে। গলার ভেতরে কথাগুলো আটকে গিয়ে কেমন যেন শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে বের হতে থাকে। ঊর্মির হাত থেকে চঞ্চল টেলিফোন নিয়ে কথা বলে শাশুড়ির সঙ্গে। কী পরিস্থিতি হয়েছিল? কখন হাসপাতালে নিয়ে গেল? কোন হাসপাতাল? এখন কেমন আছে? হাসপাতাল থেকে কোনো খবর পাওয়া গেছে কিনা জেনে নিয়ে বলে, ঠিক আছে আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।
তখন সকাল হয়ে এসেছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখে জুলিয়া আর অ্যান্ড্রু। ওরা মুখে মাস্ক লাগিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলে।
নীলিমা তাঁর মাস্ক গলা থেকে তুলে নাক-মুখ ঢেকে নেয়। অ্যান্ড্রু কেবল বাইরে থেকে ফিরেছে। জামা প্যান্ট ভেজা। হয়তো কারও ওষুধ কিংবা খাবার দিয়ে ফিরল। জানতে চায়, হাসপাতাল থেকে কোনো খবর পাওয়া গেছে কিনা। সান্ত্বনা দেয়। আশ্বস্ত করে, তাঁরা সবকিছু টেক কেয়ার করবে। বেশির ভাগ মানুষই হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে ফিরছে। তাঁর স্বামীও ভালো হয়ে ফিরবে। আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে কোনো ইতস্তত ছাড়াই যেন তাঁদের জানানো হয়।
অপেক্ষার সময় শেষ হয় না। চঞ্চল বারবার টেলিফোন করে জানতে চায়, হাসপাতাল থেকে কোনো খবর পাওয়া গিয়েছে কিনা। আর জানায় সে হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবর বের করতে পারেনি। দিনের শেষে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন আসে। আবির রায়কে আইসিইউর ৪৫ নম্বর বেডে রাখা হয়েছে। তাঁর শ্বাসকষ্ট আছে। ভেন্টিলেশনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলে জানানো হবে। অপ্রয়োজনে টেলিফোন না করার জন্য অনুরোধসহ সার্বিক পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
নীলিমা জুলিয়া-অ্যান্ড্রুকে এই খবর দেয়। ঊর্মিকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে।
-তোর বাবাকে তো আইসিইউয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে রেখেছে। খবরে দেখেছিলাম ভেন্টিলেটর দেওয়ার পর খুব কম রোগীই বেঁচে ফিরে আসে। তার ওপরে তোর বাবা বলত ৫৪ ধারা মানে সন্দেহজনক। তোর বাবার বেড নম্বর ৫৪। আমার খুব ভয় হচ্ছে। তোর বাবা মনে হয় বাঁচবে না।
কথাগুলো বলে নীলিমা কাঁদতে থাকে। ঊর্মির এত দুঃখের মাঝেও হাসি পায়।
-তুমি সবকিছু গুলিয়ে ফেলছ। ৫৪ ধারা তো বাংলাদেশের আইনের ধারা। যেকোনো মানুষকে ধরে সন্দেহজনক বলে জেলে ভরে দেওয়ার একটা আইন। তার সঙ্গে হাসপাতালের বেড নম্বরের কী সম্পর্ক?
-সে কথা তো আমিও জানি কিন্তু প্রতিদিনের খবর তো দেখছিস। এলমহার্স্টে হাসপাতালে লাশ রাখার জায়গা হচ্ছে না। লাশ টানা গাড়ির অভাবে খাবার পরিবহনের ফ্রিজিং ভ্যানগুলো লাশ টানার কাজে লাগানো হচ্ছে।
-তুমি ওসব খবর টবর দেখা বাদ দাও তো। খবর দেখে মন খারাপ করে লাভ নেই। তাতে আরও তোমার শরীরের ক্ষতি হবে। বরং নিজের যত্ন নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করো।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। নীলিমা নিজের যত্ন নিয়ে ঘরে থেকেই সুস্থ হয়ে ওঠে। হাসপাতাল থেকে কোনো খবর আসে না। বোস্টন থেকে চঞ্চল-ঊর্মি আর নিউইয়র্কে জুলিয়া-অ্যান্ড্রু অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। জুলিয়ার এক বান্ধবী এলমহার্স্টে হাসপাতালের নার্স। অন্য একটি সেকশনে কাজ করে। ভেতরের ব্যবস্থাপনা এমন যে ভেতরে কাজ করেও অন্য একটি সেকশনের খবর বের করা সম্ভব হচ্ছে না।
১৭ দিন পার হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে খবর আসে, মি. রায়কে আইসিইউ থেকে সাধারণ বেডে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাঁর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলে জানানো হবে।
এই খবরের সন্ধান করতে করতে নীলিমার সঙ্গে জুলিয়া আর অ্যান্ড্রুর সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ওদের লাউড মিউজিক শুনে নীলিমার এখন আর তেমন খারাপ লাগে না। জুলিয়ার পোশাক আচরণ কোনো কিছুই এখন খারাপ মনে হয় না। দূর থেকে সাদা চোখে যা কিছু দেখা যায় তা সবকিছুই হয় তো সত্যি না। কাছ থেকে অন্তর দিয়ে দেখলে অনেক কিছুর চেহারাই অন্য রকম হয়ে যায়। ভালোবাসার আবরণে অনেক দোষ ত্রুটি বৈষম্য ঢাকা পড়ে যায়। জুলিয়া বাসায় বসে মাস্ক তৈরি করে ওদের চ্যারিটি সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করছে। নীলিমা জুলিয়ার কাছ থেকে শিখে নিয়ে নিজের ঘরে বসে মাস্ক তৈরি করে অ্যান্ড্রুর হাতে তুলে দেয়। আবিরের অবস্থার উন্নতি হলে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেওয়ার জন্য খবর আসে। নীলিমা জুলিয়া-অ্যান্ড্রুকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে আবিরকে বাসায় নিয়ে আসে।
পরদিন সকালে নীলিমা ইউটিউব থেকে জুলিয়া-অ্যান্ড্রুর গানটা খুঁজে বের করে বাজাতে থাকে। মাস্কের ডেলিভারি নেওয়ার জন্য জুলিয়া আর অ্যান্ড্রু আসে নীলিমার ঘরে। জুলিয়া গান শুনে অবাক হয়ে চিৎকার করে ওঠে, হাউ সারপ্রাইজ! ইউ আর লিসনিং মাইকেল জ্যাকসন মিউজিক। তারপর জুলিয়া আর অ্যান্ড্রু মিউজিকের তালে তালে নাচতে থাকে। মিউজিকের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে নীলিমা ওদের নাচের সঙ্গে যোগ দেয়। আবির বিছানায় শুয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। লাউড ভলিউমে মিউজিক বেজে চলে-
‘You are not alone
I am here with you
Though we’re far apart
You’re always in my heart
You are not alone.’