'রেস্তোরাঁ পুড়ে যাক, তবু ন্যায়বিচার চাই'

গান্ধী মহল রেস্তোরাঁর সামনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালিক রুহেল ইসলাম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
গান্ধী মহল রেস্তোরাঁর সামনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালিক রুহেল ইসলাম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

একটা দুঃসংবাদ শুনে সকাল ছয়টার দিকেই ঘুম ভেঙে যায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণী হাফসা ইসলামের। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনেপোলিস শহরে তাঁদের রেস্তোরাঁ ব্যবসা। গান্ধী মহল নামে বাংলাদেশি-ইন্ডিয়ান ওই রেস্তোরাঁ বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে। পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ওই রেস্তোরাঁ পুড়ে যাওয়ার সংবাদে বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। চোখের সামনে চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায় হাসফার। রাগে কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। কী করবে এখন?

কিন্তু এই রাগে নিমেষে জল ঢেলে দিলেন তাঁর বাবা, রেস্তোরাঁর মালিক বাংলাদেশি রুহেল ইসলাম। বুকে পাথর চেপে তিনি বললেন, ‌‘যদি ন্যায়বিচারের দাবিতে এই বিক্ষোভ হয় আর সেই বিক্ষোভে আমার রেস্তোরাঁ পুড়ে যায়, তবে যাক। তবু আমরা ন্যায়বিচার চাই।’

বাংলাদেশি এই রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ মে মিনেপোলিস শহরে পুলিশের নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড (৪৬) নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু হয়। ফ্লয়েড একজন সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড়। শ্বেতাঙ্গ একজন পুলিশ সদস্য ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন বলে অভিযোগ। ওই পুলিশ সদস্যকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কিন্তু এই ঘটনার প্রতিবাদে আমেরিকার নানা শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। ওই বিক্ষোভ চলাকালে ২৮ মে রুহেল ইসলামের গান্ধী মহল নামে রেস্তোরাঁটিতে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। এরপরও ন্যায়বিচারের দাবিতে বিক্ষোভকারীদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে আহত বিক্ষোভকারীদের প্রাথমিক শুশ্রূষা দেওয়া থেকে শুরু করে নানা সহযোগিতা করছে তারা। জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অনেকে আহতও হয়েছেন।

নিজেদের রেস্তোরাঁ পুড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ১৮ বছর বয়সী হাফসা ইসলাম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘খবরটা শুনে শুরুতে খুব রাগ হয়েছিল। কারণ, এটাই আমাদের পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস।’ তিনি বলেন, ‘পরে দেখি বাবা (রুহেল ইসলাম) ফোনে তাঁর কোনো এক বন্ধুকে বলছেন, “‘আমার রেস্তোরাঁ পুড়ে যাক, তারপরও ন্যায়বিচার চাইতে হবে”, এ কথা শোনার পর রাগ কমে গেছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, আগুনে পুড়ে যাওয়া রেস্তোরাঁ দেখেও রুহেল ইসলামের পরিবার বলেছে, রেস্তোরাঁ আপাতত বন্ধ থাকবে। তারপরও তারা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আছে। যে বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেল তাদের আয়ের প্রধান উৎস, সেই বিক্ষোভকারীদেরই পাশে দাঁড়াল বাংলাদেশি ওই পরিবার।

এ বিষয়ে ৪২ বছর বয়সী রুহেল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আবার একটি ভবন নির্মাণ করে ব্যবসা করতে পারব, কিন্তু আমরা কোনো মানুষকে আবার নতুন করে তৈরি করতে পারব না। আমাদের কমিউনিটি রয়েছে। আমরা সবাই পুনর্নির্মাণে একসঙ্গে কাজ করে যাব।’

কর্তৃপক্ষ বলছে, ২৫ মে মিনেপোলিস শহরে একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা নিরস্ত্র জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেপ্তার করার পর হাঁটু দিয়ে তাঁর গলা চেপে ধরেন। এতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন জর্জ ফ্লয়েড। এ ঘটনায় ওই পুলিশ অফিসারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ২৯ মে তাঁকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর বিরুদ্ধে থার্ড ডিগ্রি হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

গান্ধী মহল রেস্তোরাঁর ভেতরে বাবা রুহেল ইসলামের (ডানে) সঙ্গে হাসফা ইসলাম (মাঝে)। ছবি: গান্ধী মহল রেস্তোরাঁর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
গান্ধী মহল রেস্তোরাঁর ভেতরে বাবা রুহেল ইসলামের (ডানে) সঙ্গে হাসফা ইসলাম (মাঝে)। ছবি: গান্ধী মহল রেস্তোরাঁর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, জর্জ ফ্লয়েড নিশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে বলছেন, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।’

নিউইয়র্ক টাইমস আরও লিখেছে, মিনেপোলিস পুলিশ ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় প্রিসিঙ্কটের কয়েকটা ভবনের পাশেই রুহেল ইসলামের গান্ধী মহল রেস্তোরাঁ। ২৮ মে রাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদকারীরা আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবনসহ ওই রেস্তোরাঁতেও আগুন ধরিয়ে দেন।

হাফসা ইসলাম ডোর ড্যাশের হয়ে পার্ট টাইমে খাবার ডেলিভারির কাজ করেন। তিনি বলেন, ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েড গ্রেপ্তার হওয়ার দিনে সড়কে লাল বাতি দেখে তিনি গাড়ি থামান। গাড়ি থেকে তিনি বীভৎস দৃশ্য দেখেছেন। ততক্ষণে ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তাই আমি বুঝতে পারছি মানুষ কেন বিক্ষোভ করছে। শুরুতে তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু করেছিল। যদিও পরে তা শান্তিপূর্ণ থাকেনি।’

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুহেল ইসলাম ২০০৮ সালে মিনেপোলিসে গান্ধী মহল নামে রেস্তোরাঁর ব্যবসা শুরু করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সম্মানে তিনি রেস্তোরাঁর নাম রাখেন। তাঁর মতোই তিনি অহিংস আন্দোলনের পক্ষে। তিনি বলেন, ‘আমি শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনে নিয়মিত সমর্থন জানিয়ে আসছিলাম। তবে আমাদের তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ বেশি আর তাদের এই ক্ষোভ বেশি হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে।’

হাফসা বলেন, ২৬ মে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনার পর তাঁদের পরিবার রেস্তোরাঁর একটি কক্ষ আহত বিক্ষোভকারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য খুলে রাখে। ২৬ মে থেকে গত দুই দিন এখানে অন্তত ২০০ জন বিক্ষোভকারী প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। কাঁদানে গ্যাসের কারণে অনেকের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এক নারীর চোখে রাবার বুলেট লেগেছিল, এতে তিনি হয়তো অন্ধ হয়ে যাবেন। আরও একজনের ঘাড়ে এই রাবার বুলেট লেগেছে। তিনি অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। সবাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতার চেষ্টা করা হয়েছে।

মিনেপোলিসের এই ভয়বহতা রুহেল ইসলামকে তাঁর শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশে। তখন সেখানে এরশাদ সরকারের স্বৈরশাসন চলছিল। সে সময় স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তাঁর দুই সহপাঠীর মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি ভয়বাহ পুলিশি রাষ্ট্রে বেড়ে উঠেছি। তাই আমি এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত।’

২৬ মে থেকে গত দুই রাত পুলিশের হাতে আহত বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসা ও সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন রুহেল ইসলাম। বিক্ষোভকারীদের আগুনেই বর্তমানে পুড়ে যাওয়া রেস্তোরাঁর সামনের রুমে চলছিল আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা। আর রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন রুহেল। সারা দিন বিক্ষোভ করে রাতে তো তাঁদের কিছু খেতে হবে—এই চিন্তায় ডাল ও ভাত রান্না করেন রুহেল। তিনি বলেন, এগুলো খুবই সাধারণ খাবার, তবে উচ্চ প্রোটিন রয়েছে এতে।