নিউইয়র্কে কারফিউ ভেঙে অগ্নিসংযোগ, গ্রেপ্তার দুই শতাধিক

হোয়াইট হাউসের অদূরে লাফায়েত পার্কে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়লে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান বিক্ষোভকারীরা। ছবি: রয়টার্স
হোয়াইট হাউসের অদূরে লাফায়েত পার্কে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়লে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান বিক্ষোভকারীরা। ছবি: রয়টার্স

পুলিশি নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার মৃত্যুর প্রতিবাদে আমেরিকাজুড়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভ থামাতে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো আইনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশজুড়ে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিউইয়র্কসহ অন্যান্য নগরীতে কারফিউ জারি আছে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে কারফিউ ভঙ্গ করে ১ জুন রাত থেকে ম্যানহাটনে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ শুরু হয়েছে। 

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠছে আমেরিকা। নজিরবিহীন বিক্ষোভ ও সহিংসতায় বেসামাল হয়ে উঠেছে আমেরিকার অনেক নগরী। খোদ হোয়াইট হাউসের সামনে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্যে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যে ব্যাপক লুটপাট শুরু হয়েছে। জননিরাপত্তার চরম সংকটের মধ্যে ১ জুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে ‘আইনশৃঙ্খলার’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করে কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে নিউইয়র্ক নগরীতে রাত ১১টা থেকে এবং অন্য অধিকাংশ নগরীতে সন্ধ্যা ৭টার পর কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সন্ধ্যা সাতটার পর কারফিউ ভঙ্গ করে লোকজনের বিক্ষোভ চলছে। রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের বাধা দিতে দেখা যায়নি।

নিউইয়র্কে ১ জুন রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে ম্যানহাটনে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ শুরু হয়েছে। হেরাল্ড স্কয়ারে মেসিস স্টোর ও আশপাশে কয়েকটি দোকানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে। ম্যানহাটনে ৬০ স্ট্রিট থেকে ডাউন টাউনের দিকে অর্ধশতাধিক দোকানে ভাঙচুর ও লুটতরাজ চলেছে। রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করার কথা জানা গেছে।

এর আগের দিন ৩১ মে রাতে নিউইয়র্কসহ অন্তত ২০টি নগরীতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। আন্দোলনের সুযোগে নগর কেন্দ্র থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকায় পর্যন্ত হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ওই রাতে নিউইয়র্কে চার শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এক ডজনের বেশি দোকানপাটে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। নিউইয়র্কে মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকবে। তবে জরুরি বিভাগ কারফিউর আওতামুক্ত থাকবে। আগের রাতে চার হাজার পুলিশ নগরীতে দায়িত্ব পালন করেছে। গভর্নর কুমো জানিয়েছেন, ১ জুন রাতে এ সংখ্যা দ্বিগুণ করে আট হাজার পুলিশ নগরীর সর্বত্র টহল দেবে। নগরীর স্থানে স্থানে পঞ্চম দিনের মতো প্রতিবাদ সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। এসব সমাবেশে যুব তরুণ, কৃষ্ণাঙ্গসহ সব বর্ণের লোকজনের অংশগ্রহণ দেখা যায়। বিপুলসংখ্যক শ্বেতাঙ্গকেও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিতে দেখা যায়। আমেরিকায় সামাজিক অসাম্য, বর্ণে বর্ণে অসাম্যের, অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে স্লোগান আর বক্তৃতা হয়েছে দিনভর।

শান্তিপূর্ণ কোনো সমাবেশেই পুলিশ বাধা দেয়নি। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ হাঁটু গেড়ে বসে আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রতি সংহতি জানিয়েছে। নিউইয়র্কের ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কের সামনে আন্দোলনরত বিক্ষোভকারীদের সামনে হাঁটু গেড়ে সংহতি জানান পুলিশ চিফ টেরেন্স মোনাহেন। তিনি বলেন, নিউইয়র্কে এমন কোনো পুলিশ নেই যে মনে করে, মিনেসোটার ঘটনা সঠিক ছিল। তিনি কিছুক্ষণ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে অবস্থান করেন এবং উপস্থিত জনতা তাঁকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়।

করোনাভাইরাসে গত তিন মাসে আমেরিকায় এক লাখ ছয় হাজার মানুষের নিশ্চিত মৃত্যু ছাড়িয়ে ক্ষুব্ধ লোকজনের প্রতিবাদ এখন বড় হয়ে উঠেছে। বর্ণবিদ্বেষ আর বৈষম্যের চাপা কান্নার সহিংস বিচ্ছুরণ ঘটছে আমেরিকাজুড়ে। মানুষ মৃত্যুভয়কে চাপা দিয়ে সড়কপথে নেমে এসেছেন।

কারফিউ ভঙ্গ করে ম্যানহাটনের হেরাল্ড স্কয়ারে মেসিস স্টোরসহ আশপাশে কয়েকটি দোকানে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ছবি: রয়টার্স
কারফিউ ভঙ্গ করে ম্যানহাটনের হেরাল্ড স্কয়ারে মেসিস স্টোরসহ আশপাশে কয়েকটি দোকানে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ছবি: রয়টার্স

আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকান ব্যক্তিকে ২৫ মে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে নির্যাতন করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এতে সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণ করা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে চাওভিন ফেঁসে যান। সেখানে দেখা যায়, গলায় হাঁটু চেপে ধরায় ফ্লয়েড নিশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার চাওভিনকে বলছেন, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।’ ভিডিওটি ভাইরাল হলে চাওভিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। মিনেসোটা থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আমেরিকায়। কৃষ্ণাঙ্গদের পাশাপাশি অনেক শ্বেতাঙ্গও এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। চাকরি হারিয়েছেন চাওভিন। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বিচারের অপেক্ষায় এখন কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন।

অধিকাংশ বিক্ষোভ সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হচ্ছে। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সংগঠকেরা আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ রাখার চেষ্টা করলেও স্থানে স্থানে তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। সুযোগ বুঝে অপরাধী চক্র সক্রিয় হয়ে পড়েছে। এরাই লুটপাটে যোগ দিচ্ছে। বন্ধ দোকান ভেঙে নিউইয়র্কসহ বেশ কিছু এলাকায় লুটতরাজ হয়েছে।

নিউইয়র্কের জ্যামাইকা এলাকায় বসবাস করেন প্রবাসী জিয়াউস শামস। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে তিনি বলেন, ১৬৪ স্ট্রিটে তাঁর বাসার সামনে রাত সাড়ে ১১টার দিকে কে বা কারা বাইরের ময়লা ফেলার বিনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশে কল দিলে তাঁরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিভিয়ে ফেলে। জিয়াউস শামস জানান, তিনি নিজের আত্মীয়স্বজন ও স্বদেশিদের সতর্ক করে দিচ্ছেন নিরাপদ থাকার জন্য।
ফিলাডেলফিয়া নগরীতে বাংলাদেশি মালিকানাধীন কিছু দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমেরিকার ১৮০৭ সালে প্রণীত ‘ইনসারেকশন’ আইনে বলা হয়েছে, কোনো নগরী বা রাজ্য জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করলে প্রেসিডেন্ট সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। ১৯৯২ সালে আইনটি সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (প্রথম) ব্যবহার করেছিলেন। রন্ডি কিং নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ লস অ্যাঞ্জেলেস নগরীতে পুলিশি সহিংসতার শিকার হলে এমন করে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। বিক্ষোভ দমনে প্রেসিডেন্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।

১ জুন দিনভর বিক্ষোভকারীরা হোয়াইট হাউসের আশপাশে অবস্থান নেন। কিছু লোক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত করে। পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিক্ষোভ দমাতে পুলিশকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে হয়েছে।

এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের অদূরে লাফায়েত পার্কে সেন্ট জোন্স চার্চে হেঁটে যান। গির্জাটি আগের দিন বিক্ষোভকারীদের হাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার, ডিফেন্স সেক্রেটারি মার্ক এস্পার এবং চিফ অব স্টাফ মার্ক মেডোজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ছিলেন। এ সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বাইবেল হাতে ছবি তুলতে দেখা যায়।