অদৃশ্য বীর

এক সপ্তাহ পর আজ বিকেলে ডা. যাহরা বাড়ি ফিরেছে। গত দিনগুলোর বিভীষিকাময় স্মৃতিটাকে কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে। চিকিৎসক জীবনের এক দশকে এতগুলো মৃত্যুকে এত বীভৎসভাবে কাছে থেকে দেখেনি। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি পার্ক করার সময় দোতলার বেডরুমের জানালা থেকে স্বামী হামদি হাত নেড়ে তাকে বাড়িতে স্বাগত জানিয়েছে। তবে আজ বাড়ির সদর দরজায় নয়, তাকে ঢুকতে হবে বেসমেন্টে। সে জানে না, তার কাপড়, হাত-মুখ কিংবা ফুসফুসে বহন করে এনেছে কিনা করোনার বীজ।
বাড়ির পেছন দিয়ে বেসমেন্টে ঢুকেই এক সপ্তাহ ধরে পড়ে থাকা স্ক্রাব আর স্কার্ফ খুলে নির্দিষ্ট ঝুড়িতে রেখে বাথরুমে ঢোকে। হামদি তার কোয়ারেন্টিনের যাবতীয় ব্যবস্থা করে রেখেছে। গায়ে গরম পানির ঝাপটায় বেশ আরাম লাগে। গোসল শেষে অজু করে আসরের নামাজ পড়ার সময় এক তলায় মেয়েদের ছোট্ট পায়ের দুষ্টু আওয়াজ শুনতে পায়। একতালা থেকে হামদি ফোন করে—
‘যাহরা, তোমার ইফতার আমি সিঁড়ির ওপর রেখেছি, নিয়ে যাও। বাচ্চারা তোমাকে ভীষণ মিস করছে, ওরা জানে না, তুমি বাড়ি এসেছ।
মানসিক ও শারীরিক ধকলে ক্লান্ত, আর অবসন্ন যাহরার দুচোখ জলে ভরে ওঠে।
–‘আমারও খুব ইচ্ছে করছে বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু আমি এখন ওদের কাছে যেতে পারব না। খুব ভয় করছে, হয়তো কোন দিনই ওদের আর ছুঁতে পারব না।’
হামদি চিন্তিত স্বরে জানতে চায়, ‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? হাসপাতালে জানিয়েছ?’
–‘হাসপাতালে এখন অনেক রোগী, আমাদের কথা ভাববার সময় নেই কারওর। কাল থেকে আমাদের এক নার্স আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছে। ইফতারের সময় হয়ে গেছে, বাচ্চাদের নিয়ে ইফতার কর।’
ফোনটা বন্ধ করে সিঁড়ি থেকে প্লেট আর শরবতের গ্লাসটা এনে কার্পেটের ওপর বসে। গলায় ভীষণ ব্যথা, কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করে না। অ্যালার্ম বাজতেই শরবতের গ্লাসটা থেকে এক ঢোক পান করে, কিন্তু তীব্র ব্যথা তাকে কাবু করে ফেলে। সে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ে।
বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে হামদি যাহরাকে ফোন করে, কোন সাড়া না পেয়ে ৯১১–এ কল করে। এক ঘণ্টা পর ইমটি ডা. যাহরার নিথর দেহ প্রটেকটিভ ব্যাগে ভোরে ফিউনারেল হোমে নিয়ে যায়।