মিশাকা ও ক্রিসেনথিমাম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ প্রায় আট বছর আছি ছয়তলা এই বাড়িটিতে। এখানে ষাটটি অ্যাপার্টমেন্ট। সবার নাম না জানলেও মুখে হাই–হ্যালো বলে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অনেকের সঙ্গেই। ৭২ বছর বয়সী স্বাস্থ্যকর্মী মিশাকা রিটায়ার করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সার্টিফায়েড নার্স। আমার সামনের মুখোমুখি ফ্ল্যাটে থাকেন। করোনার ছোবলে নিউইয়র্কের স্বাস্থ্য বিভাগ যখন টালমাটাল, তখন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নরের আমন্ত্রণে আবার কাজে ফিরে গেছেন কনি আইল্যান্ড হাসপাতালে।
প্রতিদিন ঘুমাতে যাই এবং ঘুম ভাঙে অ্যাম্বুলেন্স আর সাইরেনের শব্দে। এটাই এখনকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সারাক্ষণ মনে জাগে অমঙ্গলের আশঙ্কা।
মেয়ে আর আমি প্রতিদিনই একবার ছাদে যাই, রোদ থেকে ভিটামিন ডি গ্রহণের জন্য। চোখে পড়ে, গত চার দিন ধরে মিশাকার দরজায় বাড়িভাড়ার রিসিটটা পড়ে আছে। অথচ দরজা খুললে সেটা নেওয়ার কথা।
সুপারকে জানাতেই সে এসে কয়েকবার কলিং বেল বাজাল। ওর ফোন নম্বরে কল করল। মোবাইল বেজে বেজে নো আনসার হয়ে যাচ্ছে। তারপর বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিল। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। অবশেষে ডুপ্লিকেট চাবি এনে খুলে দেখল বিছানায় শুয়ে আছে মিশাকা। শুক্রবারে কাজ শেষে ঘরে ফিরে শুয়েছে। আর ওঠেনি। সেই শোয়াই তার শেষ শোয়া হবে, তা কী জেনেছে কেউ?
বড় দুঃসময় এখন। কবরস্থানে দু-একজন মানুষ তবুও এসেছে তাদের প্রিয় মানুষটিকে বিদায় দিতে। দেখলাম একজন যুবক কবরের পাশে অনেকক্ষণ ধরে নীরব দাঁড়িয়ে আছে, কাঁদছে। সে খুব যত্ন করে কবরের পাশে ফুল রাখল। ফুলের গোছাটী কবরে রেখে জানাল—
‘এটা আমার মায়ের কবর। সাদা ক্রিসেনথিমাম আমার মায়ের খুব প্রিয় ফুল। এতে সুগন্ধ খুব।’ বলেই কবরের গায়ে ওনার মায়ের ছবিটি দেখাল। বলল—
‘এই যে দেখো, দুনিয়াতে কত ভেদাভেদ আমাদের। কিন্তু এখানে সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষ সহাবস্থান করছে। কেউ কারও শত্রু নয়।’
আমি দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকি। ওকে বললাম—
‘আমি তোমার মায়ের প্রতিবেশী ছিলাম।’