বিলাতে বাংলার রাজনীতি

গবেষক ফারুক আহমদের গবেষণামূলক গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ‘বিলাতে বাংলার রাজনীতি’ গ্রন্থটি। এটি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় আলাদাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় লেখা গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন ঢাকার খ্যাতিমান প্রকাশনা সংস্থা ‘সাহিত্য প্রকাশ’-এর কর্ণধার মফিদুল হক। প্রকাশ কাল ২০০২। ইংরেজি ভার্সনের প্রকাশক, ক্রিয়েট স্পেস, নিউইয়র্ক, আমেরিকা। প্রকাশ কাল ২০১২; পেপারব্যাক: ২০১৩। এর পরে তিনি ‘বিলাতে বাঙালি অভিবাসন’ এবং ‘বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা’নামে আরও দুটি আকর গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা’ গ্রন্থটির প্রকাশক বাংলা একাডেমি এবং ‘বিলাতে বাঙালি অভিবাসন’ গ্রন্থটির প্রকাশক ইউনিভার্সিটি প্রেস লি.।
‘বিলাতে বাংলার রাজনীতি’ শীর্ষক বইটিতে বিলাতে বাঙালি-সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আদ্যোপান্ত স্থান পেয়েছে। অনেক না–জানা কাহিনি, বিশেষ করে রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
লেখক দেখিয়েছেন বিলাতে বাঙালিদের শতাধিক বছরের অবস্থান রয়েছে এবং তিনি এই শতাধিক বছরকে তিনটি পর্বে ভাগ করে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রথম পর্বে রয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের কাল। দ্বিতীয় পর্বে, পাকিস্তান শাসনামল। অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল অবধি। তৃতীয় পর্বে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তথা ১৯৭১ থেকে সাম্প্রতিক কাল।
প্রথম পর্বে অতি সংক্ষেপে ব্রিটেনে সর্বভারতীয় পটভূমিতে বাঙালিদের অগ্রণী ভূমিকার কথা বর্ণিত হয়েছে। এই পর্ব থেকে আমরা রাজা রাম মোহন রায়ের আগমন ও তার পরবর্তী বিশিষ্ট ভারতীয় কর্মকর্তাদের ঐতিহাসিক সাফল্যের কথা সুস্পষ্ট করে জানতে পারি। আরও জানতে পারি, রাজা রাম মোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবাসী তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় করতে হলে, স্বাধীনতার দাবি নিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় প্রতিনিধি পাঠাতে হবে। তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রথম উদ্যোগী হন একজন বাঙালি, ব্যারিস্টার লালমোহন ঘোষ। ১৮৯৫ সালে তিনি সাউথ লন্ডনের ডেপ্টফোর্ড নির্বাচনী এলাকা থেকে লিবারেল পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৩৬৭ ভোটে পরাজিত হন।
পরবর্তীকালে একটা বিপ্লবী পর্বের সূচনা হলো বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের অবসানে লন্ডন থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা হয়। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ অবসানের পর ভারতে স্বায়ত্তশাসনের অজুহাতে, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ফলে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে জ্যোতি বসু, শাহ আবদুল মজিদ কোরেশি, আইয়ুব আলী মাস্টার প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র-লস্কর সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণের মাধ্যমে নানাবিধ কার্যক্রম শুরু করতে দেখেছি।
বিশ শতকের সূচনায় আরেকটি ঘটনা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সম্প্রদায়গত উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। ১৯০২ সালের মে মাসে স্যার সৈয়দ আমির আলী এটির ইংল্যান্ড শাখা প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯২৮ সালে মৃত্যুকাল অবধি তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ইংল্যান্ড শাখা, ব্রিটিশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং ওকিং মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে স্বদেশে ও বিদেশে বাঙালিরা নানাভাবে নির্যাতিত হতে লাগল। এই পটভূমিতে লন্ডনে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, পাকিস্তান ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব গ্রেট ব্রিটেন, ন্যাশনাল ফেডারেশন অব পাকিস্তানি অ্যাসোসিয়েশন ইন গ্রেট ব্রিটেন ইত্যাদি সংগঠন গড়ে ওঠে, এবং এগুলোর মাধ্যমে বাঙালিরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, ১৯৬৫ সালে ইস্ট পাকিস্তান হাউস প্রতিষ্ঠা করে তারা উপযুক্তভাবে পাকিস্তানি মনোভাবের প্রতিরোধ করতে লাগলেন।
১৯৫২– এর ভাষা আন্দোলনের পর পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের এবং ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসনের চেতনা বদ্ধমূল হয়ে যায় এবং তার ব্যাপক প্রভাব প্রবাসীদের ওপর পড়ে। এই পটভূমিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে জোরদার করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে নাজমূল করিমের (সমাজবিজ্ঞানী) পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমী গড়ে ওঠে। এরপর বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালিদের স্বদেশপ্রেমের চর্চা অব্যাহত থাকে। এই বই থেকে জানা গেল, ভবিষ্যতের ব্যারিস্টারও স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ মওদুদ আহমদ রচিত ‘নবজন্ম’ নাটক নাকি ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে সেন্ট জর্জেস হলে অভিনীত হয়েছিল। যে নাটকে পাকিস্তানের সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দেওয়া হয়েছিল (পৃ.-৭৩)।
এভাবে আরও জানা যায়, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য গড়ে ওঠা ‘পূর্বসূরি’ এবং ‘দ্য গ্রুপ ২১’ নামের সংগঠনের কথা। এরই ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে ব্রিটেনপ্রবাসী বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। অচিরেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইউকে আওয়ামী লীগ।
গ্রন্থটির পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধে যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিদের অংশগ্রহণের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা। এখানে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে, যা বাংলাদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত বইপত্রে মিলবে না। অতি সাম্প্রতিক ঘটনাবলির অনেক সূত্রও এতে আমরা পাব। উপসংহারে (২২৬-২৩১) আমরা আরও কিছু তথ্য জানাব যাতে ব্রিটেনে বাংলার রাজনীতির নানা বর্ণাঢ্য দিক উন্মোচিত হবে।
সবদিক বিবেচনা করে বলব, গবেষক ফারুক আহমদ এই বইটি লিখে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে তাঁর গবেষক পরিচিতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে।

লেখক: অধ্যাপক ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী। শিক্ষাবিদ ও লেখক। সাবেক মহাপরিচালক বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১৯৬০–এর দশক থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক ও ডিন। বর্তমানে অবসরে আছেন।