আকাশের নীলে সাগর নীল

সময়ের নিয়মেই কেটে যাচ্ছিল জীবন; ছেদ পড়ল কুডি বছর পর কুর্মিটোলা সদর হাসপাতালে; চারদিকে তখন কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন আর সোশ্যাল ডিস্টেন্স বা সামাজিক দূরত্ব, একরাশ বিষণ্নতা, শঙ্কা আর অস্থিরতা নিয়ে শুরু হয়েছিল সকাল আকাশের; কেমন যেন একটা গুমোট আর অনিশ্চয়তায় ঘেরা চারদিক; চেনা চারপাশও বড় অচেনা আজ; বদলে গেছে মানুষের চিরচেনা অভ্যাসগুলোও।
চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসে পুরো বিশ্ব আজ অশান্ত; শুধু একটা ফ্লাইট ডিসটেন্সে করোনা ছড়িয়ে পড়ছিল সুপার সনিক জেট বিমানের গতিতে পুরো পৃথিবীতে; এ যেন বায়োউইপনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রবল শক্তিধর ইতালি, আমেরিকা, ফ্রান্স যেন এক একটি মৃত্যুপুরি; আমেরিকা আর ইতালির মতো উন্নত বিশ্বে যেখানে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় কয়েক হাজার লাশের স্তূপ। হিমায়িত গাড়িতে জড়ো করে ঠেসে রাখা শুধুই কোভিড আক্রান্ত মৃতদেহ; এ মহামারিতে মৃত্যুশঙ্কা জেনেও ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বের ডাক্তারেরা। মহামারিকে প্রতিদিনই বাড়ছিল আক্রান্ত আর মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশেও; সীমিত প্রোটেকশনে লড়ে যাচ্ছিল দেশের ডাক্তাররাও। এ যেন মৃত্যু শঙ্কা জেনেও অনুপযোগী সমরাস্ত্রে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়া। অদেখা শত্রু কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে আমাদের ডাক্তারদের আত্মাহুতি; ঠিক তখনই ঘটল অঘটন; ভাবেনি কখনো এভাবে আবার দেখা হবে।
একমুঠো রজনীগন্ধা আর নীল খাম হাতে দিয়ে দ্রুতলয়ে চলে গিয়েছিল সেদিন সাগর; ঝাপসা চোখে আকাশ তাকিয়ে ছিল সাগরের চলে যাওয়া পথের দিকে। তারপর চলে গেছে কুড়ি বছর; মন থেকে যে মুছে গিয়েছিল তা নয়, কখনো খুব একলা হলে, নির্জন দুপুরে বা পড়ন্ত বিকেলে খুব বুকে বাজতো, সাগরের এভাবে হারিয়ে যাওয়া; তখনো বাতাসে ভেসে আসত, চালতা ফুলের মিষ্টি সৌরভ বা খুব চুপিসারে এসে যেত কদম ফোটার প্রথম দিন।
লাশকাটা ঘরে, ডাক্তারি বিদ্যার বিশাল বই, আইটেম-কার্ড ফাইনাল আর ওয়ার্ডে রোগীদের মাঝে, কখন যে জীবন গড়িয়ে এত দূর চলে এসেছিল, ভাববার অবকাশই ছিল না আকাশের। উদয়-অস্ত বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা; তারও ইচ্ছে করত খোলা হাওয়ায় ঘণ্টা চুক্তিতে, রিকশার হুড ফেলে দিয়ে ভাবনাহীন, গাংগিনার পাড় বা সাহেব পার্ক ঘুরে বেড়াতে; এগ্রি বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে বান্ধবীদের নিয়ে, অলস দুপুর কাটাতে। সে সব দিনে বুকের কোথায় যেন, বিনা অর্কেস্ট্রার খুব করুন সুরে সিম্ফনি বাজতো আর সাগরকে খুব মনে পড়ত; সাগরকে ছুতে না পারার কষ্টে; আকাশের বুকে সৃষ্ট, সাগরের কষ্টগুলো বাষ্প হয়ে জমত মেঘে। ছুটত অশান্ত দুর্বার গতিতে, অস্থির উন্মাদনায়, কখনো জল-জোয়ারে, কখনো বা ঝোড়ো বাতাসে অনাসৃষ্টির ঘনঘটায়। এক সময় শান্ত হয়ে বৃষ্টি রূপে ঝড়ে পড়ত, শীতল ধরণি তলায়, আকাশ আর সাগরের ভার্চুয়াল মিতালি সুখ-ছোঁয়ার নগ্ন সাক্ষী বৃষ্টি হয়ে, যা ছিল, আকাশ আর সাগরের তপ্ত হৃদয়ের অতৃপ্ত ছোঁয়ার বাই প্রোডাক্ট। তারপরেও আকাশের নীলেই সাগর নীল; মানুষ কি সত্যি তার প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না?
কিছুক্ষণের জন্য আকাশ হারিয়ে ফেলেছিল, নিজেকে বুঝতে শেখা সেই প্রথম বসন্তের দিনগুলোয়, যা গহিনে আজও তুমুল ঝড় তুলে যায়। অন্ধকার রাতে কামিনী ফুলের গন্ধ মাদকতায়; সমাজের হিসাব কষতে গিয়ে, যাকে নেওয়া হয়নি সেদিন আপন আলোয়। এইচএসসি শেষে সাগর চলে যায় ইউএসএ কম্পিউটার বিষয়ে পড়তে আর আকাশ চিকিৎসাবিদ্যায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে; মোবাইল আর ওয়াইফাইহীন পৃথিবীতে চুপ হয়ে যাওয়া অনেক প্রেমের মতো, ওদের প্রেম ও নীরবেই ঝরে গিয়েছিল কালের আবর্তে; বুকের খুব কোণে, সূক্ষ্ম চিনচিন এক ব্যথার ছাপ ফেলে রেখে; তারপর ব্রহ্মপুত্রের বুক চিরে বয়ে গেছে অনেক জল।
এমবিবিএসের পর নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে ছুটেছে বিএসএমএমইউয়ের বটতলায়, তারপর লাইব্রেরির লিফটের সামনে দীর্ঘ লাইনের অপেক্ষা। একই সঙ্গে অনারারি, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন আর বিসিএসের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলার সে কী সংগ্রাম। মাঝে মাঝে মনে হতো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া তার বান্ধবীরা; সঙ্গীর আলোক লতা হয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, তারা কি জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়েনি? এ দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কি শুধু ডাক্তাররাই পড়ে? বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, আইনের ছাত্ররা পড়ে না? কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম। ইউজিসির মাথাপিছু খরচের হিসাবই তার স্পষ্ট প্রমাণ। স্বাস্থ্য খাতে রাজস্ব আয়ের মাত্র ১ শতাংশ খরচ হয়। তারপরও চিকিৎসকদের ওপরই সাধারণ মানুষের যত ক্ষোভ, ছড়ি ঘোরাবার সময় মনে হয় এরা দেশের মানুষের টাকা চুষে চুষে খেয়েছে, এদের শায়েস্তা করতে হবে। জীবনের কোনো যোগ্যতার প্রমাণে ডাক্তাররা কখনো পিছিয়ে ছিল? অথচ ক্যাডার সার্ভিসের নামে সৃষ্টি কেন এই সীমাহীন বৈষম্য?
এসব উত্তরহীন গভীর ভাবনায় ডুবে, জীবন বিপন্নের ঝুঁকি নিয়েই সেবা দিয়ে যাচ্ছিল করোনা আক্রান্ত রোগীদের। নিম্নমানের পিপিই আর নকল এন৯৫ মাস্কের ছদ্ম সুরক্ষা; হঠাৎ আলোর ঝলকানি; ঠিক দেখছে তো আকাশ? সামনে তার সাগর! কৈশোরের হারিয়ে ফেলা প্রথম প্রেম; যাকে হারিয়ে খুঁজেছে বহু বছর; ভোলেনি আজও। মায়ের অসুস্থের কথা শুনে দেশে এসেছিল, এসেই লকডাউনে আটকে গেছে। নিউইয়র্কে কোভিডের মৃত্যুপুরি থেকে সংক্রমিত হয়েই হয়তো এসেছিল, বুঝতে পারেনি। এসে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতেই শুকনো কাশ, বুক ব্যথায় নিশ্বাস নিতে পারছিল না। আকাশের বুক ধপাস করে উঠল; স্মৃতির রুপালি পাখি যেন উড়ে এল এই ভোর সকালেই কোভিড হাসপাতালে। আকাশকে উড়িয়ে নিয়ে গেল নিমেষে সাত সাগর আর তোর নদীর পাড়ে; যেখানে শৈশব-কৈশোর কেটেছে অস্থির এক অস্ফুট উন্মাদনায় বাড়ির কার্নিশে, ঝুল বারান্দায় বা পাঁচ ইঞ্চি সীমানা প্রাচীরে ভারসাম্য রক্ষা খেলাতে। ছাদ-বারান্দা-সিডি বা পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে সাগর পানে চেয়ে থাকত আকাশ, এ যেন এক অন্তহীন চেয়ে থাকা।
মন চাইতো সারাক্ষণ দেখে, এ যেন এক নেশা। লোহা আর চুম্বকের ক্রমাগত প্রবল থেকে প্রবলতর আকর্ষণে সৃষ্ট, দুর্নিবার টানের নেশা; এক বিন্দুতে না আসা পর্যন্ত যে নেশার টান চলতেই থাকে। আকাশের মন খারাপে সাগর বিষণ্ন কেঁদেছে; সাগরের বিষণ্নতায় আকাশ নীরবে ঝরেছে; সামাজিক বৈষম্যে কখনো পারেনি ভালোবাসি চিরকুট লিখে, কেউ কারও হাতে গুঁজে দিতে; নীরব ভালোবাসা নীরবেই গুমরে মরেছে।
নিজের সব ডাক্তারি বিদ্যা আর ভালোবাসায় সাগরকে সুস্থ করে তোলে আকাশ নিজেই আজ ভেন্টিলেটরে; অক্সিজেন স্যাচুরেশন ক্রমাগত কমে গিয়ে ভারসাম্যহীন আজ আকাশ; ঠিক যেমন মানুষের নিষ্ঠুরতায় সবুজকে হারিয়ে কোভিড আক্রমণে ভারসাম্যহীন প্রকৃতি আজ। নিজের জীবন বাজি রেখে আকাশ একজন বাংলাদেশিকে বাঁচালেন। একজন মার্কিন নাগিরককে বাঁচাল; তার প্রথম প্রেমকে বাঁচাল; নিজেই চলে যাওয়ার পথের পথিক হলো; জীবন হয়তো আবার প্রানচঞ্চল হয়ে উঠবে। আবার সাবওয়ের হুইসিল বাজবে, আবার প্লেন চলবে, সাগররা আবার আকাশে চড়ে নিজের ঘরে ফিরবে। আকাশের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে শ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসছে, ক্রমাগত অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমছে অনেক নিচে। নিজেকে আবার দেখতে পাচ্ছে পাঁচ ইঞ্চি সীমানা প্রাচীরের ভারসাম্য খেলায়। প্রাচীরের ওপারেই দাঁড়িয়ে সাগর। গভীর নীল আজ সাগর; আকাশের ক্ষীণ হয়ে আসা প্রদীপের আলোয় সাগরকে ঝাপসা দেখাচ্ছে। ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে আকাশ আজ আকাশেই ভেসে বেড়াচ্ছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে সপ্তর্ষি মন্ডলে, প্রকৃতি কি মনে রাখবে আকাশের কথা?
আকাশ আজ হারিয়েছ
পলকহীন মেঘের মতো;
সাগর বুকে জমা রেখে
স্বপ্ন গুলো যত।।