দক্ষিণ এশিয়ার সৌন্দর্য মানদণ্ডের ইতিহাস

বর্ণবাদী অনেক অপরাধের জন্য আমেরিকান পুলিশের বিচার হয় না
বর্ণবাদী অনেক অপরাধের জন্য আমেরিকান পুলিশের বিচার হয় না

আমেরিকার আধুনিক পুলিশ বাহিনীকে প্রথম দাস ও সংখ্যালঘুদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৈরি করা হয়েছিল। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ পুলিশই শিশু, নারী ও কুকুরসহ বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে আপত্তিজনক আচরণ করে। আমেরিকার ৩৩ টি অঙ্গরাজ্যে পুলিশ সদস্যরা তাদের হেফাজতে থাকা নারীদের কোনো ধরনের শাস্তির ঝুঁকি ছাড়াই ধর্ষণের অনুমতি পায়।
জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকারী ডেরেক চওভিনের পেছনে জঘন্য ইতিহাস রয়েছে। তাঁর করার সহিংসতার কোনো বিচার সিস্টেম করেনি। তিনি দুজনকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে এমন ১৭টি অভিযোগ রয়েছে। যদি করত, তবে আজকের এ দিন দেখতে হতো না। এখন পর্যন্ত চওভিনকে কেবল তৃতীয়-ডিগ্রি হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর হত্যার জন্য কালো সোমালি-আমেরিকান পুলিশ অফিসার মোহাম্মদ নূরকে ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল। কারণ, অনেকে ভাবেন যে এই সাজাটি অন্যায় ছিল। কারণ, বেশ কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সদস্য রয়েছে, যারা মানুষকে হত্যা করেও প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিনা সাজায় আইনত মুক্ত রয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সকল পুলিশ আলাদা এবং তাঁদের নৈতিকতা বোধ এক নাও হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে। তবে তারা যে সিস্টেমের জন্য কাজ করে, তা যেমন ঠিক, তেমনি তাদের আচরণগত কারণগুলোও ঠিক। সিস্টেমেই বর্ণবাদ গভীরভাবে প্রোথিত। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা পুলিশকে অনেক কিছু থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সে কারণে তারা যথাযথ জবাবদিহি করে না। এর পরিবর্তন আনতে হবে ব্যবস্থা বা সিস্টেমটিকেই।
দাঙ্গা ও লুটপাটের বিষয়ে আমাদের জানা কিছু তথ্য এখানে রয়েছে: প্রতিবাদকারীদের নামে কুৎসা রটাতে এই লুটপাটের অনেকগুলো ঘটেছে শ্বেত আধিপত্যবাদী ও গোপন পুলিশ দ্বারা। বিক্ষোভকারীরা প্রথমে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছিল। পুলিশের নির্যাতনে আহত হওয়া বা রাবার বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিক্ষোভও শান্তিপূর্ণ ছিল। এই বিক্ষোভের সঙ্গে কোনো শিশুর সংযুক্তিও ছিল না।
একই সপ্তাহে মিশিগানের রাজধানীতে আমরা দেখেছিলাম বন্দুকধারী লোকেদের, যাদের বেশির ভাগই সাদা, যারা করোনাভাইরাসের কারণে আরোপিত লকডাউন খুলে দেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করছিল, তারা কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে একেবারে কোনো ধরনের হিংসার মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু বর্তমানে পুলিশের বর্বরতা ও হত্যার প্রতিবাদকারীরা পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প তাঁর অজ্ঞতাও দেখিয়েছেন। আক্ষরিকভাবে একটি ভাইরাসের প্রতিবাদকারী সশস্ত্র সাদা মানুষদের প্রতি তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল যে তারা ‘খুব ভালো মানুষ’, আর বিক্ষোভকারীরা, যারা বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ ছিল, যারা সত্যিকারের যুক্তিসংগত কারণে প্রতিবাদ করেছিল, আমাদের রাষ্ট্রপতি তাদের ‘ঠগ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
১৭৭৩ সালে আমেরিকানরা ব্রিটিশদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। বর্তমানে স্কুলগুলোতে শিশুদের বোস্টন টি পার্টির বিখ্যাত পরিস্থিতি সম্পর্কে শেখানো হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে হওয়া ওই সংঘর্ষে ২ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি লুট ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর এর দায় শোধ করতে হয়েছিল কর হিসেবে বিক্ষোভকারীদেরই। ইতিহাসের ওই মুহূর্তটিই ছিল স্বাধীনতার মুহূর্ত। আর তাকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা লোকেদের একটি মহৎ কাজ হিসেবে ধরা হয়।। কিন্তু আজ যখন একই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তখন তারা অন্যভাবে দেখছে। লুটপাট ও দাঙ্গার ঘটনা কেবল জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ার ঘটনা না, বরং প্রত্যেক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে যে প্রতিদিন জাতিগতভাবে সরকার টার্গেট করে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়।
এটা সত্য, লুটপাট জর্জ ফ্লয়েডকে ফিরিয়ে আনবে না। তবে ৯/১১-এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্যে বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং শত শত নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করেছিল, তখন এই একই শক্তি প্রয়োগ করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গত কয়েক বছরে আমেরিকা ল্যাটিন, আফ্রিকান এবং এশীয় দেশগুলোতে একই শক্তি প্রয়োগ করেছে, লুট করেছে।
বর্ণবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের বৈষম্য সম্পর্কেও কথা বলতে হবে। আসুন এবার দেখি এর উৎস কোথায়? যেখান থেকে ‘সাদা ভালো / কালো খারাপ’—এর ধারণাটি এসেছে। একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, ইউরোপীয় দেশগুলো ক্ষমতায় আসার পর শিল্প বিপ্লব ঘটে। এ দেশগুলো তাদের লাভের জন্য যন্ত্রপাতি ও কারখানার ব্যবহার শুরু করে। তারা আফ্রিকা এবং এশিয়ার প্রায় প্রতিটি স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করতে শুরু করেছিল এবং তাদের নিজস্ব লাভের জন্য আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদও চুরি করেছিল। এ সময়টিতে চার্লস ডারউইন তাঁর প্রথম বিবর্তন তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন। বিবর্তন তত্ত্বটি উল্লেখ করেছিল যে , দুর্বলরা মারা যাবে এবং শক্তিশালীরা টিকে থাকবে। আমরা জানি যে এটি প্রকৃতিগত কারণে কেবল শক্তিশালীরা বেঁচে থাকবে। হোয়াইট ইউরোপীয়রা বিবর্তন এবং বর্ণের এই ধারণাটিকে একত্রিত করে সামাজিক ডারউইনবাদ নামে একটি দর্শন তৈরি করেছিল। সামাজিক ডারউইনবাদ মানে যারা সাদা তারা মনে করত যে, যারা বাদামি বা কালো ছিল তাদের চেয়ে শ্বেতাঙ্গরা উন্নত, আরও আধুনিক ও আরও সভ্য। ইউরোপীয়রা এই তত্ত্বটি তাদের উপনিবেশগুলোতে অতি কর্তব্য হিসেবে প্রচার ও ব্যবহার করেছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, কালো এবং বাদামি মানুষকে জয়যুক্ত করা এবং তাদের আধুনিকীকরণ করা তাদের জন্য সর্বোত্তম এবং কর্তব্য।
দক্ষিণ এশিয়া যখন ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন এই বিদ্বেষমূলক ধারণাটি দেশি মানুষের জীবনে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এখানেই আমরা ধারণা পেয়েছি যে সাদা আরও ভালো। এখন, ব্রিটিশরা কয়েক দশক ধরে আমাদের জমি থেকে দূরে রয়েছে। তবে তারা যে বর্ণবাদী বিশ্বাসটি বপন করেছিল, তা এখনো আমাদের সংস্কৃতিতে গভীরভাবে জড়িত।
আমরা কী কতভাবে দেখি না যে , আমাদের খালা-চাচিরা এসে আমাদের কালো ত্বক হালকা করার উপায়গুলো নিয়ে পরামর্শ দেন? আমরা কী কতবার শুনিনি ‘তুমি কালো হলে কে তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে?’ আমরা কতভাবে দেখেছি ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ ‘বিজ্ঞাপনগুলো বলছে যে, আমরা ভাবতে পারি না এমন কিছু পরিবর্তন করছে? আমরা কী কতবার শুনিনি যে, খুব কালো হওয়ার কারণে কেউ এই পুরুষ বা মহিলাকে বিয়ে করবে না? আমরা যখন নিজের বাচ্চাদের মধ্যে নিজের এবং অন্যের জন্য তাদের হৃদয়ে ঘৃণা ও নিরাপত্তাহীনতায় বেড়ে উঠতে শেখাচ্ছি, তখন কীভাবে আমরা সমাজ থেকে তা দূর করে উন্নতি আশা করতে পারি? আমাদের ভাবনাই কি যথেষ্ট নয়?
কোনো শিশুর জন্মের মুহূর্ত থেকেই বাঙালিরা প্রথম কথাটি বলবে, ‘বাহ সে / সে এত সাদা!’ যেন এটি কোনো সিদ্ধি বা প্রশংসা! রং কালো হলে শিশুর প্রতি ঘৃণা করুণা কথাতেই ঝরে পড়ে। আমাদের জন্মের মুহূর্ত থেকেই, আমাদের নিজস্ব সম্প্রদায় ইতিমধ্যে আমাদের ত্বকের রঙের ওপর ভিত্তি করে কতটা উপযুক্ত তা নিয়ে আমাদের বিচার করেছে।
আমার প্রিয় সাথিরা হালকা ত্বক বাঙালি, আপনার ত্বকের রঙের কারণে আপনাকে স্মার্ট, শিক্ষিত, সুন্দর এবং উন্নত হিসেবে দেখা হয়। এটি কোনো প্রশংসা নয়। আপনি যখন দেখেন, আপনার প্রতিদিনের জীবনে নৈমিত্তিক বর্ণবাদী মন্তব্য করা হচ্ছে, তখন আপনাকে উঠে দাঁড়াতে হবে এবং লোকদের তাদের অজ্ঞতা সম্পর্কে শিক্ষিত করতে হবে। হালকা ত্বক হিসেবে, আপনার নিজস্ব সত্তার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং আপনার লোকদের রক্ষা করতে এবং ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
আমার সাথির কালো ত্বকের বাঙালিদের আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনার গায়ের রং, আপনার মেলানিন লজ্জার কিছু নয়। আপনার বা আপনার ত্বকে কোনো ভুল নেই, বরং আমাদের অজ্ঞ সমাজে এমন কিছু ভুল রয়েছে, যা আপনার সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো আচরণ করে। জেনে রাখুন , আপনি সুন্দর এবং আপনাকে যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, সেভাবেই মন থেকে আলিঙ্গন করা উচিত। আপনি কে সে সম্পর্কে গর্বিত হোন এবং আসুন আমরা সকলে এই সমস্যা সম্পর্কে লোকদের শিক্ষিত করে তুলি।

অনুবাদ : সেলিনা আক্তার