ভালোবাসা নেব, দেব আকাশ সমান

পরিচিত বা অপরিচিত কাউকে আপনি চট করে জিজ্ঞেস করতে পারবেন না, আপনি কি গাড়ি ব্যবহার করেন? জিজ্ঞেস করা অভদ্রতা। তাই বুঝি অন্য আলাপ করতে করতে আমাদের সাহিত্য অঙ্গনের অনেক নামীদামি লেখক, গবেষক কিংবা আন্তর্জাতিক মানের সংগঠকেরা জিজ্ঞেস করেন, পার্কিংয়ের জায়গা কি কাছাকাছি কোথাও পেলেন? উত্তরে বলতাম, আমার গাড়ি যেখানে–সেখানে পার্ক করা যায় না। সে নিয়ম মতো, তার জন্য নির্দিষ্ট করা স্থানে চলে যায়। এতে অবশ্য অসুবিধা হয় না গাড়ির চালকের। একজন সহকারী আছে। তিনি চালককে সাহায্য করেন।
প্রশ্নকর্তার অবাক চোখের পলক পড়ার আগেই বলি, গাড়ির চাকা বেশি, তাই যেখানে–সেখানে পার্কিং করা যায় না। চাকার সংখ্যা জানতে চাওয়ার আগে বলতাম, চাকার সংখ্যা মাত্র ১৮ জোড়া। তখন আর কারও অসুবিধে হতো না, আমি কোনো গাড়ির কথা বলছি। আমি বলছি পাতাল রেলের কথা। বেশির ভাগ সময় পাতাল রেলেই চড়তাম। স্বাধীনতা নিয়ে যত্রতত্র চলাচলের জন্য নিউইয়র্কের সাবওয়ে তথা পাতাল রেলের জুড়ি নেই। অথচ আজ প্রায় দুমাসের বেশি সময় একটি বারের জন্যও চড়া হয়নি ১৮ জোড়া চাকার গাড়ি। পাতাল রেলে চড়েই লিখেছি পত্রিকার নিয়মিত কলাম। ভাবের গান আর অখাদ্যসম কবিতা নামক কয়েক লাইন মাথা ব্যথা।
কবিতার আসর নেই নিউইয়র্কের সাহিত্য অঙ্গনে। পত্রিকা অফিসের বৃহস্পতিবার দিনের মধ্য ভাগে শুরু আড্ডার সা রে গা মা খাতার পাতা আর খোলা হয় না। শোনা হয় না ষাট দশকের সিলেটের কৃতীমান কিছু আধুনিক মানুষের না–জানা গল্প। মাহতাব ভাইয়ের গল্প বলার স্টাইল ছিল অভিনব। মজার একটি গল্প বলে বলতেন, আমার গল্পের চেয়ে রুপুর গল্পটি আরও বেশি মজার। রুপু বলুক, আমরা শুনি। তিনি জানতেন, আমার বলার ইচ্ছের ব্যারোমিটার তখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে অপেক্ষমাণ। কি দারুণ বোধশক্তি সম্পন্ন অন্যের প্রতি স্নেহশীল আচরণ!
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রোমাঞ্চকর সাহসিকতার গল্প শুনতাম সুব্রত দার কাছ থেকে। চলতো দেশ নিয়ে নানা নিয়ম আর অনিয়মের অনেক ঘটনার পক্ষপাতহীন আলোচনা। সমাজে ঘটে যাওয়া অবাক করা কিছু ঘটনার অন্তরালে সমাজের দায়িত্ববানদের চোখ বুঝে থাকার কারণ জানতে চেয়ে হতাশ করার পাশাপাশি কখনো আমাদের রাগান্বিত করেছে। এত সবের পরও দেশ নিয়ে ভাবনা প্রায় বারবার ফিরে আসত। অফিস সহকারী সানজিদা উর্মীর মিষ্টি একটি জ্যান্ত পুতুল আসত দুপুরে লাঞ্চের ফাঁকে, মাকে দেখতে। পুতুলটা ঘুরতো কোলে কোলে।
মা তখন ব্যস্ত চারটে প্লেটে সম্পাদকের জন্য আনা খাবার সমান করে ভাগ করে দিতে। আমিষ–নিরামিষে সিলেটী স্বাদের তৃপ্তির ঢেকুর তোলা সুবাস। ফয়সল ভাইয়ের কাব্য নির্বাচন ভাবনা নিয়ে খণ্ড খণ্ড মন্তব্যে উপস্থিত কারও আগ্রহে কখনো কমতে দেখিনি। বরং খোলামেলা সাহিত্য আলোচনায় চিন্তার খোরাক থাকত প্রায়শ। বেলা তিনটার পর পত্রিকার সাপ্তাহিক সব আয়োজনের চূড়ান্ত সমাপ্তি নিয়ে সর্বশেষ আলোচনার ইতি টানা। পত্রিকা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে প্রেসের পথে। এবার শুরু কল–কাকলিদের আগমন পর্ব। ছোট্ট রুমে স্বল্প জায়গায় বড় পরিসরের আনাগোনা। তেলে ভাজা স্নেহের ছোঁয়ায় আর ভালোবাসার পরশে সম্পাদকের টেবিলে জমে, সবই স্বাদে আর বর্ণনে অনন্য ও অতুলনীয়।
পরের পর্ব শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা আর সবার মিলিত আওয়াজ। দিনের আলো কমে আসে, কিন্তু রুমে আন্তরিকতা আর ভালোবাসার উষ্ণতার কোনো হেরফের হয় না। আর সেই স্বর্গীয় অনুভব নিয়ে সব কলম যোদ্ধারা বাড়ি ফিরে আর তৈরি হয় পরের সংখ্যায় উৎকৃষ্ট অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে।
আর এখন কিনা আবদ্ধ ও অবরুদ্ধ জীবনে সব আনন্দ আর আড্ডার গল্প ভাগ হয়ে আছে নগরের নানা জিপকোডে। পাতাল রেলে চড়ে বাসনার পানসি নৌকায় চড়ে হাওর পাড়ি দেওয়ার সেই সুখ থেকে বঞ্চিত গুনে গুনে ৬২ দিন যাবৎ। গানের লাইন আসে পরের লাইন হারিয়ে যায় করোনার হালনাগাত সংবাদে। ফোন আসে স্বজন আর ক্ষণিকের পরিচয়ে ভালোবাসায় জড়ানো মানুষের। সবার আশঙ্কা ষাটোর্ধ্ব মানুষটির ফুসফুসে কি এখনো বোনদের ভালোবাসার সুবাতাস বইছে? না কোনো অণুজীব বাসা বাঁধল। অভয় দিয়ে বলে, বেঁচে আছি বলেই প্রতিটি দিন–রাত আজ আমেরিকার ফোর্থ জুলাই। সুখের আতশবাজি প্রতি সন্ধ্যায় আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলি, বিধাতা ধন্যবাদ আপনাকে সংখ্যায় যোগ করেনি।
দেশ থেকে সবাই বলে, তোমরা তো দুধের নহরে স্নান করো। তাহলে হঠাৎ করে একযোগে এত শ্বাস যন্ত্রের স্বল্পতা কেন। উত্তরে বলি, বামন হয়ে চাঁদ সওদাগরের খবর কেমনে জানি বলো। সে অনেক পুরোনো সওদাগর। ধার–দেনা করে বলে, আমার সব শেষ। বাড়ির সামনে লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়ে বলে, আমি কারও দেনা পরিশোধে অক্ষম। বলেই পাশ কেটে চলে যায় আরেক ধান্দায়। আমরা সেই রাজার অধীনে আছি। সে কলম নাড়ে, আমাদের নামে ডলার জমা হয়। তার বদনাম কীভাবে করি। তাই তো বলি, দিন আসুক, সবার গল্প শুনব। ভালোবাসা নেব আর ভালোবাসা দেব। জয়তু ভালোবাসা।