জীবনের ওপর মৃত্যুর ছায়া

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ক‍্যাপ্টেন রেজা
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ক‍্যাপ্টেন রেজা

আত্মীয় বা রক্তের সম্পর্কের বাইরেও মানুষে মানুষে সম্পর্ক পৃথিবীকে মমত্বের বন্ধনে বেঁধেছে, পৃথিবীর আলো, বাতাসকে পরিশুদ্ধ করেছে, মানুষকে মানুষের বন্ধু করেছে, মানবতাবাদী করেছে। কবি, সংগঠক নীলুফার রেজা পারভিজ, ক‍্যাপ্টেন রেজাউল হক রেজা ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক, নিউইয়র্কে আমার পরিমণ্ডলকে সৌহার্দ্যপূর্ণ, দীর্ঘতর ও মমত্বময় করেছে। ২০০৯ সালে নিউইয়র্কে বসবাসের শুরুতেই কবি, সংগঠক নীলুফার রেজা পারভিজ ও ক‍্যাপ্টেন রেজাউল হকের সঙ্গে পরিচয়। নীলুফার আপা তখন সাহিত্য সংগঠন গাঙচিলের পরিচালক। সাহিত্যচর্চাপ্রিয় মানুষ আমি, গাঙচিলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। নবাগত আমাকে সজীব রাখতে রেজা ভাই, নীলুফার আপা সব সময় আমার খোঁজখবর রাখতেন। তাঁদের বাসা ব্রুকলিন থেকে তখনকার আমার বাসা জ‍্যামাইকা হিলসাইড থেকে কত দিন বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানে তাঁরা আমাকে নিয়ে গেছেন এবং বাসায় পৌঁছেও দিয়েছেন তার হিসাব নেই। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, রেজা ভাইয়ের মতো মানুষ আমাকে বোন বলতেন ও শ্রদ্ধা করতেন।
প্রতি বছর সামারে তাঁদের বাড়িতে পরিচিতজনদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন। প্রতিবারই আমন্ত্রণ করেন, যেতে পারি না বলে লজ্জিত হই। গত বছর মোশাররফ ভাই, আতিক ভাই, শিউলী ভাবিদের সঙ্গে তাঁদের ব্রুকলিনের বাসায় আন্তরিক পরিবেশে কাটানো সময়ের স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তখন রেজা ভাই বলেছিলেন, এই সামারে তাঁদের পুকনোর রিসোর্টে আমাদের সাহিত্য একাডেমির সবাইকে এক রাতের জন্য নিয়ে যাবেন। আহা, আমাদের সেই প্ল্যান অপূর্ণ রেখে রেজা ভাইকে আল্লাহ অন্য জগতে নিয়ে গেলেন।
গাঙচিল বন্ধ হওয়ার পর আমার আমন্ত্রণে তাঁরা সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে জড়িত হন। আবার আমরা প্রতি মাসে রেজা ভাই ও নীলুফার আপাদের সঙ্গে একসঙ্গে সাহিত্যচর্চা করি, উপভোগ করি, উদ্‌যাপন করি। রেজা ভাই নিজে লিখতেন না, কিন্তু স্ত্রীর সাহিত্যচর্চাকে সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন। নিউইয়র্কের প্রখ্যাত কবি শহীদ কাদরীর অতি প ্রিয়ভাজন ছিলেন এই দম্পতি। একটি কবিতা সন্ধ্যার নিয়মিত অতিথি ছিলেন এই দুজন। নীলুফার আপা প্রায়ই সেখানে কবিতা পড়তেন, রেজা ভাই চিত্র ধারণ করতেন। সাহিত্য একাডেমিতে এসে রেজা ভাই চুপচাপ বসতেন, নীলুফার আপাসহ সবার লেখা মনযোগ দিয়ে শুনতেন, কিন্তু অনুরোধে করে দুই/এক দিন ব্যথিত তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিতেন না।
আমিসহ কেউ কোনো দিন, কোন অনুষ্ঠানে রেজা ভাই ছাড়া নীলুফার আপাকে দেখিনি অথবা নীলুফার আপা ছাড়া রেজা ভাইয়ের উপস্থিতি কারও কল্পনায় ছিল না। রেজা ভাই যা অপছন্দ করতেন নীলুফার আপা সেদিকে ফিরেও তাকাতেন না। যেখানেই যেতেন মানিকজোড়ের মতো তাঁরা পাশাপাশি বসতেন। অতি ভদ্র, বিনয়ী, জ্ঞানী, পরিমিত, সুশৃঙ্খল জীবনাচারী রেজা ভাই সবার শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয়ভাজন মানুষ ছিলেন। প্রেমময় স্বামীর মতো দায়িত্বশীল পিতা ও বন্ধুবৎসল মানুষ ক‍্যাপ্টেন রেজার মুখে সারাক্ষণ লেপ্টে থাকত মৃদু হাসি। পাঁকের ভেতর দুর্বিপাকে থেকেও তিনি রাজহাঁসের মতো সফেদ ছিলেন। আমার দেখা কিছু সংখ্যক ভালো মানুষের মধ্যে রেজা ভাই ছিলেন অন্যতম।
৩০ এপ্রিল সাহিত্য একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন যখন হৃদয় বিদারক খবরটা বললেন, আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। ইন্না লিল্লাহি আমার মুখে এল না। খোঁজ করতে শুরু করলাম। কিন্তু যা রটে, তা দেখলাম সত্যি হয়ে গেল। করোনা মহামারির কারণে আমাদের দিনগুলো তখন আতঙ্কগ্রস্ত, মৃত্যুময়।
প্রতি বছর রেজা ভাই নীলুফার আপা ফেব্রুয়ারিতে দেশে যেতেন। এবারও আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেশে গেছেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে আমাকে দেশ থেকে ফোন দিয়ে সাবধানে থাকতে বললেন। আমি বলেছিলাম, চার্টার্ড ফ্লাইটে চলে আসতে। জবাবে তাঁরা বলেছিলেন, তাঁরা নিরাপদ আছেন, তাঁদের জন্য চিন্তা না করতে।
২৯ এপ্রিল (৫ রমজান) ‘বাগিচা মহলে’ রাত হলো, রেজা ভাই-নীলুফার আপা রাতের খাওয়ার পর টিভিতে খবর দেখছিলেন। হঠাৎ করেই তাঁদের সাজানো ‘বাগিচা মহলে’ বিবেকহীন, হিংস্র, মৃত্যু হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল এবং চিলের মতো ছোঁ মেরে নীলুফার আপার সামনে থেকে নিয়ে গেল নীলুফার আপার জীবন, নিউইয়র্কবাসীর প্রিয় ও ভালোবাসার মানুষ বীর সেনানী ক‍্যাপ্টেন রেজাকে।
ভালো মানুষ-প্রাণাধিক সাথি হারানো শোকে কেঁদে উঠল পৃথিবী। অতি সজ্জন, সুঠাম দেহের অধিকারী রেজা ভাই মরে অমর হলেন, আর বেঁচে থেকেও সব হারানো ব্যথায় নীলুফার আপা অর্ধমৃত হয়ে গেলেন।
অশ্বারোহী তুমি তো জানো
দিনটি কত অসুন্দর ছিল।
জন্মের ক্ষণ থেকেই আমরা শরীরের প্রতিটি কোষে মৃত্যুকে বহন করে চলছি। মানুষের জীবন সব সময় পরিবর্তনের মধ্যে থাকে, কিন্তু জন্মের পর থেকে যা পরিবর্তন হয় না, সঙ্গ ছাড়ে না তার নাম মৃত্যু। সেই অর্থে আমরা মৃত্যুকেই যাপন করছি জীবনভর। ইদানীং রোগাক্রান্ত পৃথিবীতে মৃত্যুর গল্পই বেশি। জগৎ প্রান্তর জুড়ে চলছে মৃত্যুর উৎসব। যদিও মৃত্যুর মুচলেকায় সই করেই প্রতিটা মানুষের পৃথিবীর পাসপোর্ট-ভিসা নিতে হয়।
শুনেছি মৃত্যু ফ্ল্যাটে একবারই আসে, কিন্তু তার
এত চিহ্ন দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকে চারপাশে
আমার খাঁচার শান্ত ময়নাও ভয় পায় রাতে
অর্কিড কাঁপতে থাকে ঘামে ভিজে খরগোশ ঢোকে
এনভেলাপের মতো ডাকবাক্সে, সকলের বুকে
কতক্ষণ রাখা যায় কুক্কুটির মতো?-রোজ দেখি
এখানে কিছুটা নখ, কিছু রক্ত বাগানের ঘাসে
তার মানে এসেছিল, খাদ্য শেষ তাই চলে গেছে।
(কবি সিকদার আমিনুল হক)
জীবনের প্রতিটি সমর-সন্তরণে রেজা ভাই একজন সৎ, নির্ভীক, প্রগতিশীল, সংস্কারমুক্ত, সজ্জন, স্বজন, বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ, উদার প্রকৃত বন্ধুর মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষ।
স্বদেশ, স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, এই শান্তশিষ্ট মানুষটার গভীরে কি প্রকটভাবে দীপ‍্যমান ছিল, তা তাঁর কাছের মানুষ ও আপনজনরা ছাড়া তেমন কাউকে জানানোর সুযোগ তিনি দিতেন না। জ্ঞানভান্ডার তার পরিপূর্ণ ছিল কিন্তু জানাতেন, বলতেন অতি অল্প।
১৯৭১ এর উন্মাতাল অগ্নিঝরা দিনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয় উপহার দেওয়া সেনানীর জন্য পুরো জীবনটাই একটি সুগঠিত কবিতা একটি উপন্যাস। সফল জীবনের জন্য আর বেশি কিছুর প্রয়োজন নাই প্রিয় রেজা ভাই।
কায়মনোবাক্যে আমার প্রিয় রেজা ভাইয়ের মাগফিরাত কামনা করছি।