নিউইয়র্কে ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

একদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক, অন্যদিকে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র। করোনায় স্বজন হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে চলা বিক্ষোভে লুটপাটের শিকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
এদিকে কোভিড-১৯-এর কারণে আমেরিকা থেকে বিমানের টিকিট বাতিল করা প্রবাসীরা অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, জমছে দুশ্চিন্তার পাহাড়। এক তো করোনা ক্রান্তিলগ্নে অর্থ সংকট, জীবন-মরণ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত প্রবাসীদের অনেক পরিবার নতুন করে এই সমস্যায় বিপাকে পড়েছেন।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় অনেক বাংলাদেশি তাদের যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে ওমরাহ করার জন্যও টিকিট কিনেছিলেন। সৌদি সরকার কাবা শরিফ বন্ধ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রাখায় ওমরাহ পালন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে পড়ে। 

করোনায় নানাভাবে বিপর্যস্ত প্রবাসীরা ট্রাভেল এজেন্সিগুলো থেকে অর্থ ফেরত আনতে গিয়ে এখন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কোন কোন এজেন্সি জমাকৃত অর্থের সবটুকু ফেরত দিলেও অনেকেই অর্থ ফেরত দেওয়া নিয়ে টালবাহানা করছে। কেউ ফোন ধরছেন না। কেউ বা কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গ্রাহকদের কাছ থেকে ইচ্ছে মাফিক অর্থ কেটে রাখছেন।
অর্থ ফেরতের ব্যাপারে জানতে চাইলে জ্যাকসন হাইটসের একজন পুরোনো ট্রাভেল এজেন্সির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে জানান, ‘আমার বক্তব্যে অন্য কোন ট্রাভেল ব্যবসায়ী বিব্রত হোক তা আমার কাম্য নয়। তবে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, এয়ারলাইনস কোম্পানি কোন অর্থ না কাটলে করলে আমি আমার গ্রাহকদের থেকে সার্ভিস চার্জের নাম করে একটি পেনিও কেটে রাখব না।’
কুয়েত এয়ারওয়েজ তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে, ৩০ এপ্রিলের আগে যেসব যাত্রী এয়ারলাইনসের টিকিট কেটেছে এবং ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাদের ফ্লাইট করার কথা ছিল তাদের টিকিট রিফান্ড, ইস্যু অথবা রি-রাউটিংয়ের জন্য কোন জরিমানা দিতে হবে না।
অনেক ট্রাভেল এজেন্সি কুয়েত এয়ারওয়েজের এই বিজ্ঞপ্তিকে পাত্তা দিতে চাইছে না। ব্রঙ্কসের সাফওয়ান ট্রাভেল থেকে কুয়েত এয়ারওয়েজে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য চারটি টিকিট কেটেছিলেন বোরহান খান। তাঁর যাত্রার তারিখ ছিল আগামী ২ জুলাই। তিনি টিকিট বাতিল করতে গেলে তাকে ধারণা দেওয়া হয়েছে, প্রতি টিকিটে তার ২০০ থেকে ২৫০ ডলার কাটা যেতে পারে। কবে নাগাদ অর্থ ফেরত পাওয়া যেতে পারে, জানতে চাইলে কোন সময় সময়সীমা এখন জানানো যাবে না বলে তাকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাফওয়ান ট্রাভেলসের মালিক আবদুল খালেকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেকোনো অবস্থাতেই টিকিট বাতিল হোক না কেন আমাদের সার্ভিস ফি ৫০ ডলার এবং এয়ার বাতিলের ফি ১৫ ডলারসহ এয়ারলাইনসকে পেনাল্টি দিতে হবে। কুয়েত এয়ারওয়েজ কোন ফি কাটবে না ঘোষণা দিয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘আমি এগুলো দেখিনি। আমি নিজে জেনে তারপর এ ব্যাপারে মন্তব্য করব।’
জ্যাকসন হাইটসের গ্লোবাল ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস থেকে কুয়েত এয়ারওয়েজের নিউইয়র্ক-জেদ্দা-নিউইয়র্কের ছয়টি টিকিট কিনেছিলেন বাংলা ট্যুরের সিইও হাবিব রহমান। এ জন্য তিনি পরিশোধ করেছিলেন ৫ হাজার ৪০০ ডলার। কিন্তু তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৭৫০ ডলার। বাকি অর্থ সার্ভিস চার্জের নামে কেটে রাখা হয়েছে। হাবিব রহমান বলেন, ‘আমাদের ট্রাভেল তারিখ ছিল ১৫ মার্চ। এর আগেই কুয়েত এয়ার ফ্লাইট বাতিল করে।’
হাবিব রহমান বলেন, গ্লোবাল ট্যুরের সিইও সামছুদ্দিন বশিরকে অর্থ ফেরতের কথা জানালে তিনি ৩ সপ্তাহের সময় নেন। এরপরও অর্থ ফেরতে টালবাহানা করলে আমি কুয়েত এয়ারওয়েজে যোগাযোগ করলে তারা জানান, ‘আমার ছয়টি টিকিটের বিপরীতে ৫ হাজার ২৮১.২৬ ডলার ১১ মার্চ তারিখে গ্লোবাল ট্যুরের অ্যাকাউন্টে ফেরত দেওয়া হয়েছে। সামছুদ্দিন বশিরকে ব্যাপারটা জানালে আমাকে পরের সপ্তাহে অর্থ ফেরত দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি তা রক্ষা করেননি। পরবর্তীতে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। দীর্ঘদিন পর গত ২৫ মার্চ চেকের মাধ্যমে মাত্র ৪ হাজার ৭৫০ ডলার ফেরত দেন।
এ ব্যাপারে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার পক্ষ থেকে গ্লোবাল ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলের সিইও শামসুদ্দিন বশিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, ‘ছয়টি টিকিটের দাম যা ছিল, তা থেকে সার্ভিস চার্জ ৭৫ ডলার করে আমরা কেটেছি। লকডাউনের মধ্যেই সব অফিস আদালত বন্ধ থাকলেও আমরা টিকিটের মূল্য ফেরত দিয়েছি। মানবিকতা ও সর্বোচ্চ পেশাদারি দিয়ে সেবা দেওয়ার পরও এমন অভিযোগ অনাকাঙ্ক্ষিত।’
টিকিট বাতিলের বিপরীতে কোন অর্থ না কেটেও সমুদয় অর্থ ফেরত পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ব্রঙ্কসের ইসলাম উদ্দীন। তিনি ৪ জুন কুয়েত এয়ারওয়েজের বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য জ্যাকসন হাইটসের ডিজিটাল ওয়ান ট্রাভেল থেকে পাচটি টিকিট কিনেছিলেন। চলতি সপ্তাহে তিনি পুরো অর্থই ফেরত পেয়েছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। তবে তিনি খুশি হয়ে নিজের থেকে ৫০ ডলার তাদের দিয়েছেন বলেও জানান।
ট্রাভেল এজেন্সি মাই ট্রিপ, ইউএস বিডি ট্রাভেল, মেঘনা ট্রাভেলস, এস্টোরিয়ার ডিজিটাল ট্রাভেল কোন ফি না কেটে গ্রাহকদের সমুদয় অর্থ গ্রাহকদের ফেরত দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গ্রাহকদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান জ্যাকসন হাইটসের পুরোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের মালিক নাজমুল হুদা। সিংহভাগ গ্রাহকই তাদের অর্থ আজও ফেরত পাননি।
নিউইয়র্কের সাংবাদ মাধ্যমের পরিচিত মুখ এবং নব্বই দশকে ‘পদ্মার ঢেউ’ নামে রেডিও অনুষ্ঠানের পরিচালক আশরাফুল ইসলামের বড় ভাই আরিফুল ইসলামের টিকিটের অর্থ নিয়ে জ্যাকসন হাইটসের ওয়ার্ল্ড এয়ার কিং ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণার কাহিনি একসময় সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল। এত দিন পর বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডে প্রবাসীরা হতাশা প্রকাশ করেন, অর্থ ফেরত পাওয়অ নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়।