করোনার সঙ্গে বাঁচার অভ্যাস গড়ে তুলি

করোনা মহামারির আগে পরিবার নিয়ে লেখকের ঘুরে বেড়ানো
করোনা মহামারির আগে পরিবার নিয়ে লেখকের ঘুরে বেড়ানো

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের তাণ্ডব, মৃত্যুর হারের ঊর্ধ্বগতি, নিম্নগতি, স্বজন হারানোর আহাজারি, গৃহবন্দী জীবনে পারিবারিক নির্যাতন, আপনার, আমার মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি, নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আশা, সর্বোপরি সব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি—এসবই হলো গত কয়েক মাসের মূল আলোচনার বিষয়বস্তু। কিন্তু অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক শোনালেও ‘এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্সের’ একজন শিক্ষক হিসেবে আমাকে বলতেই হচ্ছে, এই ভাইরাসটি সহজে যাওয়ার নয়।

তবে কি প্রোটিন টাইপের ছোট্ট একটি নন-লিভিং মাইক্রো অর্গানিজম আমাদের জীবন থামিয়ে দেবে? নিশ্চয়ই না। যুগে যুগে বিভিন্ন ভাইরাসের মোকাবিলায় মানব জাতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেভাবে এবারও ঘুরে দাঁড়াবে। মানবজাতির মতো এত প্রজ্ঞা সম্পন্ন আর কোনো প্রজাতি নেই। আমরাই পারব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কখন, কীভাবে? জীবন না জীবিকা? কোনটি আগে?

অবশ্যই জীবনের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয় জীবিকা। জীবিকার প্রয়োজনে জীবন নয়। তবে এ অবস্থা বছরের পর বছর চলতে থাকলে জীবিকা হারানো মানুষের বেঁচে থাকাও নিঃসন্দেহে দুরূহ হয়ে পড়বে। এখন আমাদের এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মেনে নেওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ইংরেজিতে একটি খুব সুন্দর টার্ম ব্যবহার করা হচ্ছে, ‘লিভিং উইথ নিউ নরমাল’ অর্থাৎ নতুন স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে বসবাস। আরেকটু গুছিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, পাল্টে যাওয়া জীবনের সঙ্গে অভিযোজন।

কেমন হবে আমাদের নতুন স্বাভাবিক জীবন? কেমন হওয়া উচিত? এ ক্ষেত্রে আমাদের কৌশলী হতে হবে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে। খুব শর্ট টার্মে হলেও অন্তত দুবছরের পরিকল্পনা করে ফেলা ভালো।
প্রথমত: পার্সোনাল সেফটি বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। করোনাকালীন এই সময়ে আমাদের বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমরা কীভাবে মাস্ক পরব, হ্যান্ড গ্লাভ্স ব্যবহার করব, কতক্ষণ ধরে হাত ধুবো, কীভাবে ফলমূল, শাক–সবজি জীবাণুমুক্ত করব, কীভাবে জুতা পরিষ্কার করব ইত্যাদি। এমনকি এখন আমরা এটাও জানি, জীবাণুটি কোন সারফেসে কতক্ষণ বেঁচে থাকবে আর বাতাসে কত দূর বিচরণ করবে! সুতরাং এই অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করেই আমাদের পার্সোনাল সেফটি নিশ্চিত করে জীবিকার প্রয়োজনেই বলুন অথবা জীবনের প্রয়োজনেই বলুন, ঘর থেকে তো বেরোতেই হবে। যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।

দ্বিতীয়ত: মাথায় রাখতে হবে, যে ধরনের চাকরির বাজার মাত্র দুই মাস আগেও ছিল সে সব চাকরি নাও থাকতে পারে। তাই নিজেকে ডিজিটাল পৃথিবীতে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত করুন। অধিকাংশ কাজই এখন অনলাইনে হবে। বড় বড় টেকনোলজিক্যাল কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। যেহেতু আপনার হাতের মোবাইল ফোনটিতে এই ভাইরাস অনেকক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে, সেহেতু বিখ্যাত ফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘অ্যাপল’ তাদের ফোনের সিকিউরিটি সিস্টেম ‘ফেইস আইডি’র বদলে অন্য কোন নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। কারণ আপনি যদি ভাইরাসটির ক্যারিয়ার হন, তাহলে মুখের কাছে ফোনটি এনে আপনি যখন ফোনটি খুলবেন তখনই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। আবার ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এখন অনলাইনে অফিশিয়াল মিটিং করার জন্য অ্যাপ তৈরি করে বাজারজাতকরণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরও বসে থাকলে চলবে না। যে যে অবস্থানে আছেন, সেই অবস্থানে থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করুন। যেমন ধরুন, আপনি যদি একজন সচেতন মা হন, তাহলে আপনার সন্তানকে নিয়ে করা পূর্ব পরিকল্পনাগুলো পাল্টে ফেলুন। আপনার ছেলেকে বিশেষায়িত হাইস্কুলের কোচিং করাতে চান? অনলাইনে ভর্তি করুণ। আপনার মেয়েকে দূরে ভালো কোনো স্কুল বা কলেজে পাঠাতে চান? কাছেই কোথাও তার থাকার ব্যবস্থা করুন, যাতে প্রতিদিন যাতায়াত করতে গিয়ে সে অসুস্থ না হয়ে পড়ে। আপনার বিশেষ সন্তানের হোম হেলথ এইডকে পুনরায় কাজে আসতে বলতে চান? তাকে পিপিই পরে আসতে বলুন, কোম্পানিকে জানান আপনার চাহিদার কথা। আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে যেতে মন চাইছে? তাদের পার্কে, লেকের ধারে, সমুদ্রের ধারে অথবা কোনো একটা খোলা জায়গায় মাস্ক পরে আসতে বলুন। জায়গা থাকলে বাসার ব্যাকইয়ার্ডে একটু দূরে দূরে চেয়ার পেতে দিয়ে বসান ভালোবাসার মানুষগুলোকে। প্রতিবেশী ভাবির সঙ্গে খাবার আদান-প্রদান করতে চান? আগে যেমন আলুর চপটি তেলে ভেজেই পাঠিয়ে দিতেন, এখন না ভেজেই পাঠিয়ে দিন, তাদেরই ভেজে নিতে বলুন। কেউ খাবার দিলে সঙ্গে সঙ্গে না খেয়ে কয়েক ঘণ্টা পরে, ভালোমতো গরম করে তবেই খান।

করোনার সময় সুরক্ষা নিয়ে পরিবারসহ বাসার বাইরে লেখক
করোনার সময় সুরক্ষা নিয়ে পরিবারসহ বাসার বাইরে লেখক

আমরা ‘ভাতে মাছে বাঙালি’ সেটা ঠিক আছে। মাছই খান অথবা মাংসই খান, ভাতের পরিমাণ কমিয়ে মাছ-মাংস, শাক-সবজির পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। শরীরে রোগ, ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করুন। লকডাউনের সময়ে করোনা মোকাবিলায় নিজেকে প্রস্তুত করুণ। প্যানিক হবেন না। মনের জোর বজায় রাখুন। উদ্বিগ্ন হওয়া ভালো, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অস্থিরতা কাম্য নয়। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারে সতর্ক হোন। পকেটে সব সময় ডিজইনফেক্ট ওয়াইপ্স রাখুন। বদ্ধ জায়গা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। এলিভেটরের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। আর এলিভেটরে যদি উঠতেই হয়, তবে গাদাগাদি না করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটু ফাঁকা হলে তবেই উঠুন। আরও ভালো হয় যদি ডিজইনফেক্ট স্প্রে করতে পারেন।

অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ কমিয়ে দিন। আপনি দেশে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন? আপনি যে ভাইরাসটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন না, তার গ্যারান্টি কি আপনি দিতে পারেন? থার্টি ফার্স্ট নাইটে নাচানাচি অথবা পয়লা বৈশাখে গান সবই হোক ভার্চুয়াল। রেস্টুরেন্টে খেতে না গিয়ে খাবার অর্ডার করুন অথবা কিনে নিয়ে এসে বাসায় বসে খান। গ্রোসারিতে গিয়ে লাঊটি কচি কিনা, তা দেখার জন্য নখ দিয়ে খোঁচাখুচি করতে যাবেন না। অন্যদের জীবন রক্ষার কথা ভাবুন। কয়েক বছর নাই বা খেলেন কচি লাউ। আপনার নিজের জীবন বাঁচান এবং অন্যকেও বেঁচে থাকতে সাহায্য করুণ।

এই পরিস্থিতিটি আসলে যেমন সাময়িক তেমনি অনিশ্চিতও বটে। আপনার কোনো কিছুতেই মন বসাতে না পারা, কিছু ভালো না লাগার অনুভূতিটিও খুবই স্বাভাবিক। এই সময়টিকে কাজে লাগিয়ে আসুন না, আমরা একটু পেছনে ফিরে দেখি। কী হতে চেয়েছিলেন আপনি জীবনে? লেখালেখি করার শখ ছিল? ছবি আঁকতেন ছেলেবেলায়? ভালো গান গাইতেন? আবার একটু একটু করে শুরু করুন! নাইবা হলেন টিভি স্টার, আপনার গান যদি আপনার কাছের কয়জন মানুষ শোনে। আপনার লেখা যদি পরবর্তী জেনারেশনের দু–পাঁচজনেও পড়ে তাই বা কম কি?

এই মুহূর্তে হয়তো অনেক কিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু আবার অন্যদিকে চিন্তা করলে দেখা যাবে, কিছু জিনিসতো অবশ্যই আপনার হাতের আওতার মধ্যেই আছে। কী কী বিষয় আপনার নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোর দিকে ফোকাস করুণ। একটা রুটিন সেট করুণ এবং সেই অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন, দেখবেন হতাশা কমে যাবে। যদি ধর্মে বিশ্বাসী না হন, তবে সরাসরি মেডিটেশনের সাহায্য নিন। আর যদি বিশ্বাসী হন, তবে ধর্মীয় আচারগুলো নিয়ম করে পালন করতে পারেন। এতে মেডিটেশনের কাজ দেবে। অস্থিরতাও অনেকখানি কমে আসবে। কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গানের কলি মনে আছে? ‘জীবন যখন শুকিয়ে যায়, করুণা ধারায় এসো।’
নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য ‘নতুন আমি’–কে তৈরি করুন। জীবন আপনাকে যেখানে এনে ফেলেছে সেখানেই প্রস্ফুটিত হওয়ার চেষ্টা করুন। নিজেকে সাহায্য করুন, সেই সঙ্গে অন্যের প্রতিও আপনার আবেগঘন ভালোবাসার হাতটি বাড়িয়ে দিন। এভাবেই শুরু হোক আমাদের সহযোগিতা এবং সহমর্মিতাপূর্ণ ‘নতুন স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে বসবাস’।