করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের দুঃসহ দিনগুলো

সব সময়ই হাসি খুশি আন্তরিক একজন মানুষ নুসরাত এলিন
সব সময়ই হাসি খুশি আন্তরিক একজন মানুষ নুসরাত এলিন

ছোটবেলা থেকেই আমার স্বভাবসুলভ অভ্যাস, কথা বলার আগে হাসি। কিন্তু আজ আমার স্বভাবসুলভ হাসি যেন হারিয়ে গেছে চারদিকে মানুষের অসুস্থতা ও মৃত্যুর মিছিল দেখে। তবে জীবনতো থেমে থাকেনি। তাই একটা সুন্দর নিয়ম করে চলি। লকডাউনে নিউইয়র্কের স্কুল অনলাইনে খোলা। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর সময় চলে যায়, সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলের কাজ ও চ্যাট করে। ঘরের কাজ, বাগানের কাজ ও একটু বেশি সময় নিয়ে নামাজ কোরআন পড়া, কিছু লেখালিখি। খাবারের তালিকায় প্রতিদিন মাত্র একটা নতুন খাবার বানাতাম, তাও আমার ছেলেদের পছন্দের। এই লকডাউনে বাচ্চারা ঘরে বন্দী তাই যতটুকু সময় সম্ভব ওদের নিয়ে ও নতুন খাবার নিয়ে আনন্দের সময় কাটাতাম। কখনো ভাবিনি এ রকম দিন পাব, দিন রাত ঘরে থাকা পরিবারের সবার সঙ্গে।

তেমনি এক শনিবার সকাল, অনলাইন স্কুল বন্ধ। আমার দুই ছেলেকে বললাম, চল বাবারা আজ একটু বাইরে ঘুরে আসি। খুব সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। গাড়িতেই বসে থাকব মাস্ক পরে ও কিছুক্ষণ শরীরে রোদ লাগিয়ে আসব। এই দুই মাসে ঘরের বাজার শেষ হলে মাঝেমধ্যে খুব মহাউদ্যমে আমার স্বামী ও আমি বের হয়েছি। কিন্তু আমার ছেলেরা কোথাও যায়নি। ওই দিন বের হওয়ার সময়ই শরীরটা খুব ম্যাজ ম্যাজ করছিল, তবে বলিনি কাউকে। মনের মধ্যে ভর করছিল এক অজানা আতঙ্ক। ভাবলাম শরীরে রোদ লাগলে ভালো লাগবে। ফেরার সময় চারজনের জন্য চারটা জায়রো বক্স নিয়ে আসি। ইফতারের পর পরই ঠান্ডা লাগে, সঙ্গে জ্বর আসে এবং প্রচণ্ড শরীরে ব্যথা। ব্যথার যন্ত্রণায় ট্রাইনানল ও আইব্রোফেন খেলাম দুটি, মনে মনে প্রচুর প্রার্থনা করে ঘুমিয়ে পড়ি।

শুরু হলো কষ্টের দিনগুলো আর জ্বর বাড়তেই থাকে, সঙ্গে অসম্ভব শরীরে ব্যথা। প্রায় ১০ মিনিট পর পর আমার স্বামী আদা, রসুন, কাঁচা হলুদ ও লং দারুচিনি জ্বাল দেওয়া পানির ভাপ এনে দিচ্ছে বিছানার পাশে। শরীর চলছে না, তাও কিছুক্ষণ পর পর গার্গল করছি। মনে হচ্ছিল, গলার মাঝে কাটাযুক্ত ও ব্যথাযুক্ত কী যেন আটকে আছে। গরম পানি ও গার্গল করলে একটু কমে, কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হয়। কী যে জীবনযুদ্ধ এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, শ্বাস কষ্টকে যেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আমার হালকা অ্যাজমা আছে। ধুলোবালিতে নাকে লাগলে সমস্যা হয়। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতাম ও অনবরত লেবু, আদা, হলুদের পানির ভাপ। যে যা বলেছে, আমার স্বামী এনে দিচ্ছে আর সব খাচ্ছিলাম। আমাকে ভালো হতেই হবে, আমার অনেক কাজ বাকি, অনেক অসমাপ্ত কাজ। আমি কখনো গরম চা বা গরম কিছু খেতে পারি না। সেই আমি অনবরত যতক্ষণ হুঁশে ছিলাম ততক্ষণ গরম-গরম সব খাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, পুরে যাচ্ছে সব ভাপে ও গরম পানিতে কিন্তু তাও করে যাচ্ছিলাম যুদ্ধ।

জুম ভিডিওতে প্রাইভেট ফিজিশিয়ান ডাক্তার যখন আমাকে কোভিড–১৯–এর রোগী বললেন, তখন শত কষ্টের মধ্যেও হাসলাম। কারণ প্রতিদিন সকাল–বিকেল কালোজিরা, মধু, লেবু আদার রস, কাঁচা হলুদ, জিরার পানি, দুটো করে কমলা, সবজি, চিকেন সুপ ও আরও কত কী—সবাই মিলে খাচ্ছিলাম। এদিকে আমার স্বামী নজরুল কবির তো রীতিমতো এই ভাইরাস নিয়ে দিন রাত গবেষণা করছে। নিজের জ্ঞান ও ডাক্তার বোন, ভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে প্রতিদিন ফেসবুকে লিখছে এবং আমাদেরও সাবধান করছে। মাঝে মাঝে আমার ছেলেরা ও আমি খুব বিরক্ত হতাম সারাক্ষণ এই ভাইরাসের কথা শুনতে শুনতে। এত কিছু করে এবং সাবধানে থেকেও রক্ষা হয়নি। তবু ডাক্তারের কথা মেনে নিলাম হাসিমুখে। মনে মনে ভাবলাম, আল্লাহ যা করেন, সব ভালোর জন্য করেন। হয়তো এই রমজান মাসে আমাকে বিছানায় ফেলে রাখা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে। আমি কখনো বিশ্রাম নিই না, এক কাজের পর আরেক কাজ করি। আমার সার্জারির দুদিন পরেও গাড়ি চালিয়ে কাজে চলে গেছি। সেই মানুষ অসহ্য ব্যথা ও জ্বর নিয়ে কাতরাচ্ছি বিছানায়। কী যে ভয়ংকর কষ্ট, তা বোঝানো যাবে না। টানা ২০ দিন জ্বর, শরীর ব্যথা, গলা ও বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ছিল। দুরাত মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় অসহ্য কষ্টে। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। এরপর থেকে রাতে একা রুমে ঘুমাতে ভয় লাগত। কিন্তু উপায় নেই। কোভিড–১৯ রোগীকে সবার থেকে আলাদা থাকতে হবে। ঘরের সবার ভালোর জন্য ও আমাদের পোষা বিড়ালের জন্য আলাদা এক রুমে দরজা আটকে রাখতাম। জ্বর আসতেই আমার থাকা, খাওয়ার বাসন এবং বাথরুমের ব্যবস্থা আলাদা করে ফেলি।

রাতে একা রুমে কষ্ট আর যন্ত্রণায় মনে হতো কবরে শুয়ে আছি। আর এভাবেই হয়তো কবরে মৃতদের সওয়াল–জওয়াব হয়। ভাবতে থাকতাম, জীবনে কী কী ভুল করেছি, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে চাইতে চোখে ঘুম আসত আর পাশে মোবাইলে বাঁচতে থাকত সুরা ইয়াসিন শরিফ। কষ্টকর ২০ দিন এভাবেই কেটেছে, যা দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে সারা জীবন। আমার অসুখের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাকিদের কোভিড–১৯ টেস্ট হয়। আমাদের বিড়ালের জন্য চিন্তা বেশি হচ্ছিল, অবুঝ প্রাণী কষ্ট পেলে বলতেও পারবে না। ছোট ছেলের পজিটিভ ধরা পড়ে, তবে ওর কোনো অসুবিধাই ছিল না। তারপরও ওর নিজের রুম থেকে বের হওয়া বারণ ছিল। কারণ ওর ছোঁয়াতে আরেকজন সংক্রমিত হবে। একটা সংসারে মা অসুস্থ হলে যে কী দুর্দশা হয়, তা আমাদের সবার জানা। আমার স্বামী ও বড় ছেলে অনেক কষ্ট করেছে। নজরুল এখনো করছে আমার সেবায়। ভাগ্যিস, আমার বড় ছেলে শখ করে মাঝে মাঝে রান্না করে, তাই রক্ষা। এক মাস ধরে সে রান্না করে ও মাঝে মাঝে আমার ননাশ (ড. লুৎফা) খাবার ও বাজার পাঠান। আমার জা (ঝুনু) ও আমার বান্ধবী (টেনিস) অনেক অনেক রান্না করে দেয়। সারা জীবন ওদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব এ বিপদে সাহায্যের জন্য। কৃতজ্ঞ থাকব আমার বন্ধু রূপা, সিমু, মনিজা, আইরিন ও মাকসুদার কাছে। ওরা প্রতিদিন মেসেজে আমাকে অনুপ্রেরণা দিত।

কৃতজ্ঞ থাকব আমার বড় বোন, ভাই, দুলাভাই ও আমার সব বাল্যবন্ধুরা, অনেক পরিচিত ভাই ও বোনদের কাছে। কথা বলার শক্তি ছিল না, তাই ফোন ধরতে পারিনি কারও। কিন্তু তারপরও ভালোবাসার টানে ফোন করে গেছেন সবাই। সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ও সবার দোয়ায় সুস্থ হয়ে উঠি। এখনো অসম্ভব দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে আছে শরীর। ডাক্তার জানালেন, শরীর অনেক যুদ্ধ করে এই ভাইরাসের সঙ্গে তাই যুদ্ধ শেষে অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রায় তিন/চার মাস লাগবে বা আরও বেশি লাগতে পারে পুরোপুরি সুস্থ হতে। তবে প্রচুর স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও পানির প্রয়োজন হয়। তাই আমার অভিজ্ঞতায় আমি বলব, আপনাদের সবার শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম ভালো রাখুন। নয়তো ভাইরাস সুযোগ নিয়ে নিবে। তারপরও যদি পজিটিভ হয়, তাতে শরীরে কোনো কষ্ট বা অসুস্থতা বোধ করবেন না তেমন। আপনি শুধু ভাইরাস বহনকারী হয়ে থাকবেন।
আমার স্বামী যে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করে, তা আমার অসুস্থতার সময় কাজে আসে শতভাগ। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে আবার কোভিড–১৯ টেস্ট করি, যখন আমার নেগেটিভ আসে, তখন কী আনন্দ! আমি যেন আমার হারানো হাসি ফিরে পেলাম। প্রথমেই মনে হলো, এখন থেকে আমি ঘরের সবকিছু স্পর্শ করতে পারব। আমাদের বিড়াল সোনাকে আদর করতে পারব। আমি বন্দী এক রুমের জীবন থেকে মুক্ত।