রক্ষণশীল সুপ্রিম কোর্ট থেকে বড় ধাক্কা খেলেন ট্রাম্প

সময়টা ভালো যাচ্ছে না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। করোনাভাইরাস নিয়ে বিপদ কমেনি, তার ওপর যুক্ত হয়েছে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী নাগরিক অসন্তোষ। উভয় প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। একের পর এক জনমত জরিপ প্রকাশিত হচ্ছে, তার প্রতিটিতে ট্রাম্প তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন।

সিএনএনের একটি জরিপে ট্রাম্পের সঙ্গে বাইডেনের ফারাক ১৪ পয়েন্ট। সে জরিপ ঠেকাতে ট্রাম্প আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তাঁর সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন হোয়াইট হাউসে তাঁর সময়ের অভিজ্ঞতার খোলামেলা বিবরণ দিয়ে যে বই লিখেছেন, সেটিও আটকানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত আসার আগেই সে বই সবার হাতে হাতে।

এসব ছাপিয়ে গোদের ওপর ফোঁড়ার মতো রয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। নিজের পছন্দমতো দুজন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাম্প। অনেকে বলেন, এটি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে রক্ষণশীল আদালত। প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসসহ মোট নয়জন বিচারপতির পাঁচজনই রক্ষণশীল, তাঁরা কার্যকরভাবে রিপাবলিকান ভাবাদর্শের সমর্থক। অথচ সেই সুপ্রিম কোর্টের পরপর দুটি সিদ্ধান্ত তাঁর প্রশাসনের বিপক্ষে গেছে।

সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি এসেছে আজ শুক্রবার। দেশের এই সর্বোচ্চ আদালত ৫-৪ ভোটে ওবামা আমলে গৃহীত ‘ডাকা’ কর্মসূচিকে বহাল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা এই কর্মসূচির অধীনে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বৈধ কাগজপত্রহীন তরুণ-তরুণীকে সাময়িক বৈধতা প্রদান করেছিলেন। এই সিদ্ধান্ত অবৈধ—এই যুক্তিতে ট্রাম্প প্রশাসন ‘ডাকা’ কর্মসূচিটি বাতিলের জন্য আবেদন করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর রায়ে বলেছেন, এই কর্মসূচি কেন বাতিল হবে, ট্রাম্প প্রশাসন তার পর্যাপ্ত যুক্তি তুলে ধরতে পারেনি। এই কর্মসূচি বাতিল হলে এত বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী, যারা অল্প বয়সে মা–বাবার সঙ্গে এ দেশে এসে রয়ে গেছে, তাদের কী হবে, সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর ট্রাম্প প্রশাসন দিতে পারেনি।

প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস আদালতের চারজন উদারনৈতিক বিচারপতির সঙ্গে যৌথভাবে এই রায় প্রদান করেন। আদালতের রায়টিও তাঁর লেখা। তিনি অবশ্য ‘ডাকা’ কর্মসূচি অবৈধ এমন রায় ঘোষণা করেননি, শুধু বলেছেন, এই কর্মসূচি বাতিলের আগে যে পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত ছিল, ট্রাম্প প্রশাসন তা করতে ব্যর্থ হয়। পরে অধিক প্রস্তুত হয়ে তারা ফের বিষয়টি উত্থাপন করতে পারবে।

মাত্র এক সপ্তাহ আগে সুপ্রিম কোর্ট আরেক সিদ্ধান্তে কর্মক্ষেত্রে সমকামী ও লিঙ্গান্তরিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে যেকোনো বৈষম্য অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। সেটিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য একটি বড় ধরনের বিপর্যয়। ৬-৩ ভোটে গৃহীত এই রায়ে আদালতের চারজন উদারনৈতিক বিচারকের সঙ্গে যুক্ত হন প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস ও ট্রাম্প কর্তৃক মনোনীত নিল গোরসাচ।

যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত অঙ্গরাজ্যে সমকামী অথবা লিঙ্গান্তরিত হওয়ার কারণে যেকোনো ব্যক্তিকে কর্মক্ষেত্র থেকে বাদ দেওয়ার আইন প্রচলিত রয়েছে। ট্রাম্প-সমর্থক হিসেবে পরিচিত ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান ভোটাররা এই বৈষম্যভিত্তিক আইনের সমর্থক। নির্বাচনের আগে ও পরে ট্রাম্প এই ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টে এমন বিচারপতির নিয়োগ দেবেন, যাঁরা তাঁদের ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। গত তিন বছর তিনি দুজন সেই রকম কট্টর রক্ষণশীল বিচারপতিকে মনোনয়নও দিয়েছেন।

এই আদালতের কাছ থেকে ট্রাম্প তাঁর জন্য রাজনৈতিকভাবে সহায়ক হয়, স্বাভাবিকভাবেই এমন রায় আশা করে থাকবেন। এ পর্যন্ত দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া জন রবার্টসের আদালত তাঁকে হতাশ করেনি। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে এই রকম দুটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভিন্ন রায় দেওয়ায় ট্রাম্প শুধু হতাশ নন, তিনি রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়েছেন। একাধিক টুইটে তিনি বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত রিপাবলিকান তথা রক্ষণশীলদের স্বার্থবিরোধী। তিনি এমন কথাও বলেছেন, চলতি সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে পছন্দ করে না। ‘আমাদের রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে, তা নিশ্চিত করতে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দিন,’ তিনি লিখেছেন।

তাঁর সে কথাকে উপহাস করে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি মন্তব্য করেছেন, সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পকে পছন্দ করেন কি না, সেটা বড় কথা নয়, তিনি শাসনতন্ত্রকে পছন্দ করেন কি না, সেটাই বড় কথা। তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করে জো বাইডেন বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত সম্ভব হয়েছে হাজার হাজার ‘ডাকা’ তরুণ-তরুণীর দৃঢ় প্রতিবাদের কারণে। বাইডেনের কথায়, ‘বিচারপতি রবার্টস ঠিকই বলেছেন, কর্মসূচিটি বাতিলের দাবি ছিল খামখেয়ালিপূর্ণ ও অযৌক্তিক।’

কোনো কোনো ভাষ্যকার মনে করেন, এই দুই রায় দেখে মনে হয়, জন রবার্টস অবশেষে ট্রাম্পের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। ট্রাম্প চাইলেও তাঁকে এই পদ থেকে সরাতে পারবেন না। ফলে, নীতিগতভাবে সম্মত না হলে ট্রাম্পকে খুশি করার কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই। এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উদারনৈতিক বিচারপতিদের ‘ওবামা বিচারপতি’ বলে উপহাস করেছিলেন। সে কথার প্রতিবাদে রবার্টস বলেছিলেন, ‘মোটেই না, আমরা কেউ ওবামার বা ট্রাম্পের বিচারপতি নই।’

তবে জন রবার্টস কতটা স্বাধীনচেতা হয়েছেন, তা বোঝা যাবে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। নির্বাচনের আগেই এই আদালতকে ট্রাম্পের আয়কর হিসাব অবমুক্ত করা ও গর্ভপাতের বৈধতা প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।