নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের গুরুত্বপূর্ণ দিন আজ

ওপরের বাঁ দিক থেকে বদরুন নাহার খান, মেরি জোবাইদা, জয় চৌধুরী, ফারজানা চৌধুরী, জামিলা আকতার ও ইশতেহাক চৌধুরী
ওপরের বাঁ দিক থেকে বদরুন নাহার খান, মেরি জোবাইদা, জয় চৌধুরী, ফারজানা চৌধুরী, জামিলা আকতার ও ইশতেহাক চৌধুরী

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি জনসমাজের জন্য ২৩ জুন গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। কারণ, এদিন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচন। আমেরিকায় বাংলাদেশিদের অভিবাসনের শত বছর পেরিয়ে গেছে। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে বা ম্যানহাটনের হার্লেমে পূর্বসূরিদের পদচিহ্ন ধরে নানাভাবেই বাংলাদেশিরা নিউইয়র্কে ক্রমে লক্ষণীয় একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। দেশীয় রাজনীতির চর্চা নিয়ে বাংলাদেশিদের কোলাহল দেখা যায় নিউইয়র্কে। যদিও এসব কোলাহলে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরাই বেশি। আর এবারই প্রথমবারের মতো নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিদের আমেরিকার রাজনীতির মূলধারায় ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে।

নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় বা ঐক্য না থাকলেও এক ডজনের বেশি প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির শক্ত অবস্থান নিউইয়র্কে। এ রাজ্যে দলটির মূল চালিকা শক্তিও খুব শক্তিশালী। বাংলাদেশি প্রার্থীদের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক পার্টির মূল চালিকা শক্তির তেমন ঘনিষ্ঠতা এখনো গড়ে ওঠেনি। তেমনি ভোটার তালিকাভুক্তিসহ নির্বাচনী কৌশলে বাংলাদেশিরা কোনো নির্বাচনী এলাকায় এককভাবে নিজেদের অবস্থান দেখানোর সুযোগ পাননি। এর মধ্যেই ডজন খানেক প্রার্থীর কেউ নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন এবারের নির্বাচনে, এমন আশা অনেকেরই।

ডেমোক্র্যাটদের দুর্গ নিউইয়র্ক। গভর্নর ডেমোক্র্যাট–দলীয়, বর্তমান মেয়র ডেমোক্র্যাট–দলীয়, অন্য জনপ্রতিনিধিরাও ডেমোক্র্যাট–দলীয়। এখানে রিপাবলিকানদের ভোট খুবই কম। ফলে ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনিই আগামী ৩ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হবেন—এমন মনে করা হয়। এবারের প্রার্থী তালিকায় দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণদের প্রাধান্যই এ আশাবাদের অন্যতম কারণ।

নিউইয়র্কের কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট-১৪ থেকে এই পদে প্রার্থী হয়েছেন বদরুন নাহার খান। ডেমোক্রেটিক পার্টির তারকা কংগ্রেসওমেন আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিওর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার সাবেক সভাপতি বদরুন নাহার খান একজন সমাজকর্মী ও ডিস্ট্রিক্ট-১৪ নির্বাচনী এলাকায় আলোচিত প্রার্থী। বাংলাদেশি-আমেরিকান আর দক্ষিণ এশিয়ার ভোটারসহ সব দেশের ভোটারের কাছে তাঁর পরিচিতি রয়েছে।

নিউইয়র্ক ডিস্ট্রিক্ট-৫ আসনে প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশি-আমেরিকান সানিয়াত চৌধুরী। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৯৯৮ সাল থেকে এ আসনে নির্বাচিত হওয়া প্রার্থী কংগ্রেসম্যান গ্রেগারি মিক্সের সঙ্গে।

ডিস্ট্রিক্ট-২৪ আসনে স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান পদে লড়াইয়ে নেমেছেন মাহফুজুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশিদের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নানা কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। ডিস্ট্রিক্ট-৩৭–এ আলোচিত প্রার্থী হচ্ছেন মেরি জোবাইদা। এই প্রার্থিতার মধ্য দিয়ে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন নিউইয়র্কের পশ্চিম কুইন্স থেকে দীর্ঘদিনের প্রতিনিধিত্বকারী ক্যাথরিন নোলানকে। ৩৫ বছর ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছেন ক্যাথরিন নোলান। এমনকি গত এক দশকে তাঁকে কেউ প্রাইমারি নির্বাচনে চ্যালেঞ্জটুকুও জানায়নি। ১০ বছরে এবারই প্রথম ক্যাথরিন নোলান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। মেরি জোবাইদাকে নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা হয়েছে। তাঁর নির্বাচিত হওয়া নিয়ে অনেকেই আশাবাদী।

ডিস্ট্রিক্ট-৩৪ আসনে এবার আলোচনায় আরেক তরুণ প্রার্থী জয় চৌধুরী। নির্বাচনী এলাকা কুইন্সে জয় চৌধুরীর পক্ষে ব্যাপক প্রচার চলছে। জয় চৌধুরী শক্ত একজন প্রার্থীর বিপক্ষে লড়ছেন।

ডিস্ট্রিক্ট-৩৬ আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন জোহরান খান। নিজ নির্বাচনী এলাকায় পরিচিত মুখ জোহরানের পক্ষে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট-৫৪ আসনে অ্যাসেম্বলিম্যান প্রার্থী হয়েছেন নাফিস আই চৌধুরী। তাঁর পক্ষে সমর্থন দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। আলোচিত প্রার্থী হয়ে উঠেছেন তরুণ প্রার্থী নাফিস।

ডেমোক্রেটিক পার্টির কাঠামোতে অনেকটাই তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ পদ ডিস্ট্রিক্ট লিডার। এ পদে নারী-পুরুষ ভাগ করা আছে। জ্যামাইকার নির্বাচনী জেলা ২৪-বি থেকে ডিস্ট্রিক্ট লিডার ও নারী ডিস্ট্রিক্ট লিডার প্রার্থী ইশতেহাক চৌধুরী ও ফারজানা চৌধুরী। প্রযুক্তিবিদ ইশতেহাক চৌধুরী বলেন, হিস্পানিক ও কৃষ্ণাঙ্গ সমর্থকেরা তাঁর পক্ষে প্রচারে যোগ দিয়েছেন। নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি খুব আশাবাদী।

অ্যাসেম্বলি ডিস্ট্রিক্ট-২৪ আসন থেকে লড়ছেন মাহতাব খান। একই আসন থেকে ডিস্ট্রিক্ট লিডার (ওমেন) পদে আলোচিত প্রার্থী মৌমিতা আহমেদ। তিনি ডিস্ট্রিক্ট-২৪–এ একজন শক্ত প্রার্থী। নানা কাজের জন্য কমিউনিটিতে তাঁর রয়েছে বাড়তি পরিচিতি। অ্যাসেম্বলি ডিস্ট্রিক্ট-৮৭ থেকে লড়ছেন এন মজুমদার। তিনি কমিউনিটিতে খুবই পরিচিত। নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে।

করোনা পরিস্থিতির কারণে ১০ দিন আগে থেকেই আগাম ভোটের ব্যবস্থা করা হয়। ১৩ জুন থেকে অনেকেই আগাম ভোট দিয়েছেন। ডাকযোগেও ভোট দিয়েছেন অনেকেই। ২৩ জুন কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেবেন বাকি ভোটাররা। নির্বাচনের ফল অন্যান্যবারের মতো দ্রুতই জানা যাবে না। আগাম ভোট ও ডাকযোগে পাওয়া ভোটের ফল যোগ হয়ে কেন্দ্রের ফল পুরো পাল্টে যেতে পারে।

আমেরিকায় বাংলাদেশি জনসমাজের অন্যতম ব্যক্তিত্ব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমাদের দাবির জন্য আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পথ তৈরি করতে হবে।’ নিজ নিজ প্রার্থীর জন্য ভোটকেন্দ্রে যাওয়া এবং অন্যদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করার আহ্বান জানান তিনি।

রাজনীতিতে অনাগ্রহী আমেরিকানদের কাছে নির্বাচন নিয়ে আমাদের চেনা উত্তেজনার কোনোটাই থাকে না। দিনের অধিকাংশ সময়ই ভোটকেন্দ্র ফাঁকা থাকে। খুব ভালো অংশগ্রহণ হলে ভোট গ্রহণের হার ৩০ শতাংশ অতিক্রম করে। এবারে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচন হচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে নিউইয়র্ক নগরীর প্রায় ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি। মাত্র তিন মাসে হাজারো মানুষের মৃত্যুর স্মৃতি নিয়ে এ রাজ্যের মানুষের কাছে রাজনীতির অনেক অচেনা দিক উন্মোচিত হয়েছে।

করোনায় নগরীর অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মৃত্যু হয়েছে বেশি। আক্রান্তও বেশি হয়েছে এসব প্রান্তিক লোকজন। জীবনমানের ব্যাপক তারতম্যকেই দায়ী করা হচ্ছে এসবের জন্য। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে নাগরিক আন্দোলনের ঢেউ। পুলিশ সংস্কার হচ্ছে। নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এর মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার সচেতন কাজে কতসংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে বা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, এ নিয়েও বিরাজ করছে নানা সংশয়। বাংলাদেশিরা নিউইয়র্কের নির্বাচনে এখনো মুখ্য কোনো শক্তি না হলেও এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা শক্ত ভীত চলে আসবে। কোনো একজনের জয়ও স্বদেশিদের আনন্দ উল্লাসের জন্য যথেষ্ট হিসেবে ধরে নেওয়া হবে।