সরকারের অবহেলায় সংকটে অভিবাসীরা

নিউইয়র্ক নগরের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানে গত চার দশক ধরে অভিবাসীদের অবদান অপরিহার্য। নিউইয়র্কের জনসংখ্যার বেশির ভাগই অভিবাসী। ছোট ছোট অর্ধেকেরও বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক অভিবাসীরা। সেন্টার ফর আরবান ফিউচারের তথ্য অনুযায়ী, গত শতকের সত্তরের দশক থেকে এখন পর্যন্ত নগরের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করেছেন এই অভিবাসীরাই। অথচ করোনা মহামারিতে নিউইয়র্কের সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে তারা। এ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর ভূমিকার অভাবকেই দায়ী করছে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থা।

নিউইয়র্ক নগরের পাঁচ বরোজুড়ে অভিবাসীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে এসব অলাভজনক সংস্থা। এসব সংস্থার প্রায় ১২ জন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা মহামারির কারণে অভিবাসী নিউইয়র্কবাসী চরম অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেওয়া সরকারের স্টিমুলাস প্রোগ্রাম বা উদ্দীপনা কর্মসূচির কোন সুবিধা অভিবাসীরা পাচ্ছেন না।

কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, মহামারির সময় লকডাউন চলাকালে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ অভিবাসী ক্লায়েন্ট চাকরি হারিয়েছে। যেমন, আফ্রিকান অভিবাসীদের সেবা দানকারী একটি সংস্থা জানায়, তাদের অভিবাসী ক্লায়েন্টদের প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রাথমিক আয়ের উৎস হারিয়েছে। কারণ, তারা বেশির ভাগই ছিলেন দিনমজুর, গৃহকর্মী এবং সেলুন কর্মী। আয়ের এই সর্বনাশা ক্ষতি পাঁচটি বরোজুড়ে অভিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দো-ক্যারিবীয়দের জন্য পরিষেবা সরবরাহকারী কুইন্সভিত্তিক ছায়া সিডিসির নির্বাহী পরিচালক অ্যানিতা সিচারান বলেছেন, ‘কার্যত আমাদের সেবা গ্রহণকারী সব লোকজনই এখন বেকার এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি।’

একাধিক সংস্থা জানিয়েছে, তাদের ৭৫ শতাংশ ক্লায়েন্টের নিজের বা তাদের সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নেই। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান পরিষেবা কমিটির ৬৫ শতাংশ অভিবাসী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি। ইতিমধ্যে, প্রায় প্রতিটি সংস্থাই অভিবাসী ক্লায়েন্টদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তার লক্ষ্যে ত্রাণ বিতরণে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সংস্থাগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না।

এ বিষয়ে লা কলমেনার নির্বাহী পরিচালক ইয়েসেনিয়া মেতা বলেছেন, খাদ্য বিতরণের দিনে প্রায় ৩০০-৪০০ লোক আসে। আর প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে সব খাবার শেষ হয়ে যায়। এ জন্য সরকারি সহায়তার বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

বেশির ভাগ অভিবাসী হয় সরকারি সহায়তা পাওয়ার যোগ্য নয় বা যোগ্যতা অর্জন করলেও বেনিফিট অ্যাকসেসের জন্য লড়াই করছে। এর কারণ, বেশির ভাগ অভিবাসীর ইন্টারনেট ব‍্যবহার সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই বা যথাযথ কাগজপত্রের অভাব রয়েছে। ইন্টারনেট বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান না থাকায় বেশির ভাগ অভিবাসীই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার (যা এখন সম্পূর্ণ অনলাইনে করা হচ্ছে) জন্য এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন। যেমন খাবার সহায়তা বা এসএনএপি ও বেকারত্ব ভাতা সুবিধা ইত্যাদি। ফলে তাদের জীবন দিন দিন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে।

অন‍্যদিকে স্বাস্থ্যসেবাকে অভিবাসীদের কাছে আরও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে ব্রুকলিনভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান একাডেমি অফ মেডিকেল অ্যান্ড পাবলিক হেলথ সার্ভিসের (এএমপিএইচএস) সোম ইয়ুক ইউ বলেন, ‘আমাদের অনেক অনথিভুক্ত পরিবার বেকারত্ব বিমা বা কোন ধরনের সরকারি উদ্দীপক বিল পেতে সক্ষম হচ্ছেন না। যা সেই পরিবারগুলোর জন্য একটি দুঃস্বপ্ন।

কোভিড-১৯-এ অভিবাসীদের আর একটি সমস্যা হচ্ছে বাড়ি ভাড়া। অভিবাসী ভাড়াটিয়ারা ইতিমধ্যে উচ্ছেদের হুমকির মুখে পড়েছেন এবং উচ্ছেদের স্থগিতাদেশ (বর্তমানে ২০ আগস্ট) শেষ হওয়ার পরে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা করছেন অভিবাসী নেতারা।

নানাভাবে সমস্যায় পড়া অভিবাসী পরিবারগুলোর সন্তানেরাও ঘরে বসে সফলভাবে পড়ালেখা শেখার ক্ষেত্রে একাধিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ইংরেজি ভাষায় যথাযথ জ্ঞানের অভাবে শিক্ষাগত পর্যবেক্ষণ সরবরাহ করা অভিভাবকদের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জের বিষয় হচ্ছে। প্রযুক্তি বা উচ্চগতির ইন্টারনেটের অপর্যাপ্ত অ্যাকসেস শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাাঁড়িয়েছে। সংকুচিত অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে উপচে পড়া ভিড় অনেক পরিবারকে উৎপাদনশীল শিক্ষার পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

অভিবাসীদের করোনা মহামারিতে এ সব নানা সমস্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষের অনেক কিছুই করার ছিল। যেমন অভিবাসী এবং অভিবাসী-মালিকানাধীন ছোট ব্যবসায়ের জন্য জরুরি নগদ সহায়তা তহবিল তৈরি করা। অভিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবাগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা।

বিশেষত সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা এবং ছোট ক্লিনিকগুলোর পাশাপাশি টেলিহেলথ প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থাকে সহায়তা করা। কিন্তু তারা সে সবকিছুই করেননি। অভিবাসীদের ভবিষ্যতে যেন অন্য কোন কঠিন অবস্থার সম্মুখীন না হতে হয়, সে বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহায়তা খুবই জরুরি।