দেয়াল ঠিকই তুলে দিয়েছেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের আচরণ ও পদক্ষেপ দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রকে নিঃসঙ্গ করে ফেলেছেন। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের আচরণ ও পদক্ষেপ দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রকে নিঃসঙ্গ করে ফেলেছেন। ছবি: রয়টার্স

চলমান মহামারিতে অভ্যন্তরীণ নড়বড়ে দশা প্রকাশ পাওয়ার আগেই মিত্রদের কাছে নিজেকে অনির্ভরযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করে ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মহামারি শুরুর পর একতরফাভাবে সীমান্ত বন্ধ করে সে নিজেকে আরও এক কাঠি এগিয়ে নিয়েছে এ ক্ষেত্রে। কিন্তু ইউরোপের পক্ষ থেকে অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবে একটু বিস্ময়, একটু ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া আর কিছু করা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রকে সাড়ে তিন বছর দেখার অভিজ্ঞতা।

২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পর থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির ব্যাপক অবনমন হয়েছে। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা ট্রাম্প অভিষেক ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তকে সর্বোচ্চ সুরক্ষিত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। অভিষেকের তিন দিনের মাথায় তিনি ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ান। ১২ জাতির এই বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরপরই আসে সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেওয়া নির্বাহী আদেশটি।

পরপর নেওয়া এ দুটি পদক্ষেপই সারা বিশ্বকে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প-জমানার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানান দিয়েছিল। ফলে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাল্টাতে ইউরোপের নেতারা যখন একত্র হলেন জরুরি সম্মেলনে, তখন তাঁদের মধ্যে কথিত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বাস্তবতাই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের অবস্থানেই এটি স্পষ্ট হয়। সে সময় ইইউ কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক ইউরোপীয় নেতাদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘ওয়াশিংটনে হওয়া পরিবর্তন ইইউকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে। নতুন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ বছরের পররাষ্ট্রনীতিকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’ সে সময় একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল।

কয়েক মাস পর বেলজিয়ামে ন্যাটো সদর দপ্তরে মিত্র দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে গিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, মন্টেনিগ্রোর প্রধানমন্ত্রী দাস্কো মারকোভিচসহ অনেকের সঙ্গে ট্রাম্প যে আচরণ করেন, তাতে ওয়াশিংটনের অবস্থান নিয়ে সংশয় আরও বেড়ে যায়। ট্রাম্পের সেদিনের আচরণ ন্যাটো জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতির পরিপন্থী ছিল। ন্যাটোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের এই দোদুল্যমানতা এখনো বহাল। ফলে জোটটির অন্য নেতারা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ নিয়ে শঙ্কায় ভুগছে। তাঁরা মনে করছেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্যাপিটল হিলে এলে, তা ন্যাটো জোটের জন্য বিদায়ঘণ্টা বাজার শামিল হতে পারে। এমন শঙ্কার শক্ত ভিতও রয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে জার্মানির ঘাঁটি থেকে সাড়ে নয় হাজার সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে ন্যাটো জোটের অন্য নেতারা ভাবতেই পারেন যে তাঁদের শঙ্কা অমূলক নয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাড়তি বোঝা। তিনি মনে করেন, ন্যাটোর অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্থানে মার্কিন সেনা মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটা অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু ন্যাটো কেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিসরে একতরফা নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন তার মিত্রদের মত নেওয়ার কোনো তোয়াক্কা করেনি। গত সাড়ে তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্র বহুপক্ষীয় নীতি থেকে সরে একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকেছে। এ ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে হওয়া ছয় জাতি পরমাণু চুক্তি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণাসহ আরও নানা বিষয়ের উল্লেখ করা যায়। আর এগুলোর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক শক্তি ও নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নড়বড়ে করে দিয়েছেন।

বৈশ্বিক শক্তির সমীকরণে থাকা বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাবলয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যে অবিশ্বাসের নির্মাণ ট্রাম্প করেছেন, তা পুরো বৈশ্বিক ব্যবস্থাটিকেই হুমকির মুখে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, হালের করোনাভাইরাস ও এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা—এসবের কোনো কিছুতেই যুক্তরাষ্ট্র আজ নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থানটিতে নেই। এখনো দৃশ্যত সে সামনেই আছে। কিন্তু এ–ও সত্য যে তার এই নেতৃত্বে এখন আর কেউ আশ্বস্ত হতে পারছে না। ফলে ওয়াশিংটনের পরীক্ষিত মিত্র ইউরোপ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন, ঠিক তেমনি চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে চায়। অনুমান করা যায় না, এমন মিত্রের চেয়ে নিজেদের ওপর আস্থা রাখাটাকেই তারা এখন গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।

ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র কতটা অননুমেয় হয়ে পড়েছে, তার একটা উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীত থেকেই দেওয়া যায়। গত জানুয়ারিতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনের প্রশংসা করেন এবং বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক এর আগে এতটা ভালো আর কখনোই ছিল না।’ কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই এপ্রিলে গিয়ে এই ট্রাম্পই চীনের ‘শাস্তি’ দাবি করে বসলেন। কারণ, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতা এবং বিশ্বের কাছ থেকে এমন একটি ভাইরাসের বিষয়ে তথ্য না দেওয়া। তিনি এমনকি নতুন এ করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ আখ্যা দিতেও পিছপা হননি। আর গত মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় চীনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার চাপ প্রয়োগ করলে, তা ঠেকিয়ে দেয় ইউরোপ।

এ পরিস্থিতিতে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ড এক টুইটার পোস্টে লিখেছেন, ‘এটা অনেকটা পোস্ট-আমেরিকান বিশ্ব দেখার মতো একটা বিষয়। একদিকে রয়েছে সুস্পষ্ট কৌশলগত অবস্থান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ও ইতিবাচক চীন। অন্যদিকে রয়েছে ইইউ, যারা সহযোগিতামূলক বৈশ্বিক কাঠামো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র কোভিড-১৯–এর বদলে চীনের সঙ্গে লড়াই করতেই বেশি উদ্গ্রীব।’

কোভিড-১৯ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথামালা কখনো পুরোনো হওয়ার নয়। তবুও এই আলোচনায় তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। মুশকিল হচ্ছে কোভিড-১৯ ট্রাম্পের একমাত্র সমস্যা নয়। তাঁর ঘরেই বর্ণবাদের মতো বিষ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর এই ওঠার পেছনে তাঁর অবদান নেহাত কম নয়। রয়েছে পেছন দরজা দিয়ে কাজ সারার নতুন নতুন গাথা। সর্বশেষ সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের ভাষ্য বিবেচনায় নিলে, ‘চিরশত্রু’ চীনের কাছেই ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য সহায়তা চেয়েছিলেন। এই একটি বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ধসিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কারণ, তাঁর প্রথম মেয়াদটি ‘রুশ হস্তক্ষেপের’ গাথা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

সব মিলিয়ে এই বৈশ্বিক মহামারিকালে ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে অনেক বেশি একা হয়ে পড়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিতে না পারাই তাঁকে নিঃসঙ্গ করে ফেলেছে। পরীক্ষিত মিত্রদের খারিজ করতে করতে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, যা তাঁকেই ঘিরে ফেলেছে চারদিক থেকে। ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে ট্রাম্পের মুখে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটি শোনা গেছে, তা হলো ‘সীমান্ত দেয়াল’। এই দেয়াল তিনি মেক্সিকো সীমান্তে তুলতে চেয়েছিলেন, অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের স্রোত ঠেকাতে। না, সে দেয়াল তিনি তুলতে পারেননি। তবে নিজের নানা পদক্ষেপ, কথা ও আচরণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চারদিকেই এক অদৃশ্য দেয়াল তিনি সফলভাবে তুলে দিতে পেরেছেন।