চেরি পিকিং

সপরিবারে গিয়েছিলাম চেরি পিকিংয়ে। আমার মেয়ের শখ চেরি পিকিংয়ে যাবে। আগে থেকে নেটে খুঁজে সুন্দর একটি চেরি বাগান বের করলাম। নিউইয়র্কের প্রসপেক্ট হিল অরচার্ড বাগানে চেরি, পিচ ও আপেল পিক করা যায়। তবে এখন শুধুই চেরির সিজন। তাদের ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান করে বিস্তারিত জেনে নিলাম। প্রায় দুই শ বছরের পুরোনো বাগান। আমার বাসা থেকে দুই ঘণ্টার ড্রাইভ, ৭২ মাইল দূরে।তাদের সাইট থেকে জানলাম, বাগান ২৫ জুন বৃহস্পতি

বার প্রথম খোলা হবে। দর্শনার্থীদের জন্য বৃহস্পতি থেকে রবি—সপ্তাহে এই চার দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। চেরি তোলার জন্য কোনো ব্যাগ নেওয়া যাবে না। ২৫, ৪০ ও ৬০ ডলারে তিনটি সাইজের পলিথিনের ব্যাগ/কাগজের কার্টুন তারাই সরবরাহ করবে। কোভিডের জন্য সবাইকে মাস্ক পরে বাগানে ঢুকতে হবে।

আমার রাজশাহীর নাতনি শিরিন তার পরিবার নিয়ে যেতে খুব আগ্রহী হলো। ওর ভাশুরের পরিবার ও কলিগের পরিবার নিয়ে আরও ৩/৪ পরিবার প্রস্তুত হলো। কিন্তু ওরা রোববার ছাড়া যেতে পারছে না। বাগান খুলবে বৃহস্পতিবার, রোববার আসতে আসতে মানুষ ভালো ভালো পাকা পাকা চেরিগুলো পেড়ে ফেলবে। আমার একটা ধারণা হলো, প্রথম খোলার দিনই যদি যাই, তবে আমরা ইনট্যাক্ট বাগান পাব যে বাগান দেখে, ছবি তুলে, চেরি পেড়ে সব দিক থেকেই শান্তি পাব। সেই ভাবনা থেকেই বৃহস্পতিবার খোলার দিনে যাওয়া। গিয়ে বুঝলাম আমার পূর্বানুমান সম্পূর্ণ সঠিক ছিল।

রাজশাহীর বন্ধু চিরকুমার সোহাগকে নিয়ে তার নতুন গাড়িতে করে সকাল ৯টায় আমার বাসা থেকে রওনা দিলাম। অনলাইন ক্লাস থাকায় আমার ছেলে গেল না। আমার বউ মোরগ–পোলাও রান্না করে দুপুরে খাওয়ার জন্য সঙ্গে নিল। করোনার কারণে মানুষের মুভমেন্ট কম, তা ছাড়া ছুটির দিন না হওয়ার কারণে আরও কম। ৮ লেনের বিশাল হাইওয়েতে ৮০ মাইল বেগে গাড়ি চলছে। পাহাড়ি রাস্তার দুই পাশের ঘন সবুজ বনানীর চোখ জুড়ানো অপরূপ মনোহর দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য যে বর্ণনা করে বোঝানোর সাধ্য নেই। লাইভে এসে ফেসবুক বন্ধুদের দেখালাম। এক সময় আমার মেয়ে ধমকের সুরে বলল, আব্বু তুমি মোবাইল রেখে চোখ দিয়ে প্রকৃতির এ সৌন্দর্য দেখ।

অপরূপ সুন্দর একটি নদীর ওপর বিশাল সুন্দর একটা সেতু পার হলাম। নদীর পাড়ে খুবই সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। নদী পার হয়ে মনোরম সুন্দর একটি ছোট শহরের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরই আমরা গন্তব্যে পৌঁছালাম। বাগানের পাশে খালি জায়গায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। পার্কিংয়ের জন্য ৫ ডলার নিল। পাশেই ৩/৪টি মোবাইল টয়লেটেরও ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা টয়লেট ব্যবহার করলাম। মোবাইল টয়লেটগুলোতে সাধারণত দুর্গন্ধ হয়। এইটাতে দেখলাম মৌ মৌ ফুলের গন্ধ। তাদের মোবাইল টয়লেট সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করল।

ফ্রেশ হয়ে আমরা চেরি তুলার ব্যাগ নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। আমরা ৪০ ডলার দিয়ে মিডিয়াম সাইজের ব্যাগ নিলাম। আমাদের আগেই অন্তত গোটা বিশেক গাড়ি বাগানে চলে এসেছে। তারা ইতিমধ্যেই বাগানে ঢুকে গেছে। বাগান খুলেছে ৯টায় আমরা পৌঁছেছি ১১টায়। বিশাল বাগান। কাউন্টারের চায়নিজ তরুণীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সামনের গাছগুলো মিষ্টি চেরির, দক্ষিণ পাশে টক চেরির গাছও আছে।

প্রথমেই আমরা মিষ্টি চেরি গাছের সারিতে ঢুকলাম। জীবনের প্রথম চেরি দর্শনে বিমুগ্ধ হলাম। গাছে গাছে প্রচুর চেরি ধরে আছে থোকায় থোকায়। ফলের সাইজ আমাদের দেশি বরইয়ের মতো। খয়েরি রঙের চেরি সবই পাকা মনে হচ্ছে। ফল ব্যবসায়ী সোহাগ বললেন, কালো রঙেরগুলো পাকা, অন্যগুলো কাঁচা চেরি। কাল মানে গাঢ় খয়েরি। একটি ঘন খয়েরি রঙের চেরি পেড়ে মুখে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম, এটি আসলেই পাকা। অবশ্য কাঁচাগুলোও টক নয়, একটু কম মিষ্টি এবং কিছুটা ছোট। পাকাগুলো অপেক্ষাকৃত বড়, মিষ্টি এবং রসে টইটুম্বুর!

গাছ খুব বড় নয়, অনেকটা আমাদের দেশের পেয়ারা গাছের মতো। মাটি থেকেই চেরি পাড়া যায়। কিছু কিছু মগডালেরগুলো পাড়ার জন্য গাছে উঠতে হয়। মাঝে মাঝে দু–একটা কাঠের মইও আছে দেখলাম। আমি চেরি পেড়ে আমার থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের দুই পকেটে রাখছি। আমার মেয়ে ও স্ত্রী চেরির খোঁজে অনেক দূরে চলে গেছে। অনেকক্ষণ পর ওরা ব্যাগভর্তি চেরি নিয়ে ফিরে আসলে দেখলাম, ওরা সাদা চেরিও পেড়েছে। সাদা চেরি বেশি সুস্বাদু। ওদের কাছ থেকে জেনে পরে আমরাও ওইদিকে গিয়ে সাদা চেরি পাড়লাম।

চেরি পাড়া ছাড়াও আমার মূল নেশার কাজ ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাগানে নেট না থাকায় লাইভে আসতে পারলাম না।

বাগানের পূর্ব পাশে দাঁড়ালে দূরে আকাশ ছোঁয়া উঁচু পর্বতমালাসহ অতি মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। চেরি, পিচ, পার্সিমন ফলের সঙ্গে আরও কিছু ছবি তুলে আমরা বাগান থেকে বের হলাম। গাছ থেকে পাড়ার সময় প্রচুর চেরি খেয়েছি বলে বেলা ২টা বাজলেও আমাদের কারওরই খিদে লাগেনি। এদিকে বাসা থেকে আনা খাবার খাওয়ার জন্য আমার স্ত্রী তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু ক্ষুধা না থাকায় না খেয়েই দুপুর দুইটার দিকে আমরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

পথের দুধারে অপরূপ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। গাছের ছায়ার নিচে ঘন সবুজ ঘাসের মাঠ, মেশিন দিয়ে সমান করে কাটা ঘাসের ওপর ইচ্ছে করছে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি। সোহাগকে বললাম, সুযোগ বুঝে কোথাও গাড়ি সাইড করেন। এমন সুন্দর গাছের ছায়ায় বসে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে ফেলি। ঘণ্টা খানিক পর তিনি এক ডানকিন ডোনাট দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন। এখানে গাড়িতে বসেই আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। খাবার শেষে ডানকিন থেকে কপি নিয়ে খেলাম। এখানে ডানকিনের স্টাফ সব সাদা। নিউইয়র্ক সিটিতে ৯০ ভাগ স্টাফই বাঙালি, তবে বাঙালি মালিক ১ ভাগও নাই। ডানকিনের নিট অ্যান্ড ক্লিন বাথরুমে আবারও ফ্রেশ হয়ে বাসার দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

গাড়ি এখন মনোরম সুন্দর একটি ছিমছাম শহরের মধ্য দিয়ে চলছে। গাড়ি শহর পেরিয়ে ছোট হাইওয়েতে ঢুকল। এ পথটি আমার চেনা লাগছে। গত বছর আলবেনি থেকে লেক জর্জ হয়ে আমরা এই পথেই নিউইয়র্ক ফিরেছিলাম। সোহাগ ভুল করে এ পথে এসেছেন। হঠাৎ পথের পাশে আরেকটি বাগান পেলাম। সোহাগকে গাড়ি থামাতে বললাম। তিনি বাগানের পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করলেন।

সামনে একটি ছোট ঘরে দুজন সাদা নারী ও একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, এই বাগানে স্ট্রবেরি খেতে আমরা কিছু ছবি তুলতে চাই। তারা বলল, তুলতে পার তবে পাড়িয়ে গাছ নষ্ট করো না। আরেকজন বলল, তোমরা কি কিছু স্ট্রবেরি তুলতে চাও? আমি বললাম, তুলতে পারব? তিনি বললেন হ্যাঁ, বলেই একটি প্লাস্টিকের পাত্র এগিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করলাম দাম কত। জানালেন, ৩ ডলার পাউন্ড।
প্লাস্টিকের পাত্র নিয়ে আমরা স্ট্রবেরি বাগানে ঢুকলাম। জীবনের প্রথম খেত থেকে স্ট্রবেরি পাড়লাম, খেলাম। আমার বউ পেয়ে গেল তার অতি প্রিয় এক ‘আবনা’ শাকের সন্ধান। স্ট্রবেরি খেতে প্রচুর পরিমাণে ওই শাক গাছ লকলকিয়ে আছে। সে শাক তোলা শুরু করল, কিন্তু রাখবে কই? শেষে আমার থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের দুই পকেট ভরে শাক নিলাম।
স্ট্রবেরি খেতের পাশেই ভালো জাতের আপেল বাগান। প্রচুর পরিমাণে আপেল ধরেছে, এখনো ছোট। সেপ্টেম্বরে আপেল পাকবে, কিছু ছবি নিলাম। আমার মেয়ে আবিষ্কার করল অ্যাসপারাগাস। স্ট্রবেরি খেতের পাশে অ্যাসপ্যারাগাসও চাষ করেছে ওরা। মেয়ে আবারও আবিষ্কার করল, এক পাশে ব্লু বেরি গাছ। ব্লুবেরি ধরেছে, কিছু কাঁচা, কিছু পাকা। পাকা ব্লুবেরি কিছু খেলাম। এখানে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কেটে গেল তারপর পূর্ব পাশে একসঙ্গে প্রায় এক শ বিঘা জমিতে বিশাল ভুট্টা খেতেরও কিছু ছবি নিলাম। স্ট্রবেরির মূল্য দশ ডলার পরিশোধ করে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। সোহাগ ভুল করে উল্টো পথে যাওয়াতে ভালোই হলো। স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি ও অ্যাসপ্যারাগাসের খেত দেখতে পেলাম।
বিকেলের নৈসর্গিক পরিবেশে ঘন সবুজের মাঝ দিয়ে ৮ লেনের প্রশস্ত রাস্তায় ঘণ্টায় ৯০/৯৫ মাইল বেগে (যা কিলোমিটারে ১৩০/১৪০ হবে) গাড়ি চালিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য নয়ন সার্থক করে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ৮টায় বাসায় পৌঁছলাম।