হারের অভিজ্ঞতা নিয়ে সামনে এগোতে হবে

নিউইয়র্কে ডেমোক্রেটিক দলের প্রাইমারি বা প্রাথমিক বাছাই শেষ। ফলাফল নিয়ে চারদিকে চলছে জল্পনা–কল্পনা। প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। অনেকেই বলছেন, নিউইয়র্কে বছরের পর যারা ডেমোক্রেটিক পার্টির পদ দখল করে আছে, তাদের সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করা। তাদের পুরোনো ছক ভেঙে নতুনদের উঠে আসা সহজ কথা নয়। এবার বাংলাদেশিরা নির্বাচনে নেমে সে কথাই যেন বুঝতে পেরেছেন।

জ্যাকসন হাইটসকে ‘মিনি বাংলাদেশ’ বলা হয়। যেদিকে তাকাই সবই নিজেদের মানুষ। দল বেঁধে চা–শিঙারা খেতে খেতে অভিবাসীদের দেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে আনাচে–কানাচে ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে আড্ডা চলে ২৪ ঘণ্টা। সে সব আড্ডা কখনো কখনো বেশ উত্তেজনার জন্ম দেয়। রাজনৈতিক আড্ডা থেকে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। থানা-পুলিশ হয়েছে এমন খবরও আছে। 

বাঙালি বরাবরই রাজনৈতিক সচেতন। সে গল্প পুরোনো। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছি। শিকদার সাহেব এসেছেন ১৫ বছর। জানতে চেয়েছিলাম, এবারের বাঙালিদের নির্বাচন নিয়ে। তিনি বললেন, শুনেছেন কজন বাংলাদেশি প্রার্থী হয়েছেন, তবে কাউকে চেনেন না। অভিযোগের সুরে বললেন, কেউ না চিনলে কীভাবে মানুষ ভোট দেবে। জামিল সাহেবের বাড়ি রংপুর। তিনি জানান, বাংলাদেশর মানুষ হয়ে আমরা তাদের চিনি না। তাহলে অন্য কমিউনিটির মানুষ কীভাবে তাদের ভোট দেবে। তার কথার সঙ্গে অনেকেই গলা মেলান। বলেন, কমিউনিটির জন্য কাজ না করে তারা সহজ পথে জিততে চেয়েছিলেন।

কেউ কেউ বলেন, তাদের নির্বাচনী তহবিলই সংগ্রহে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আবার এও শোনা যায়, এসব প্রার্থীর বাপ–দাদা বাংলাদেশে কোন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, সেসবও প্রভাব ফেলেছে এখানে। কোন মতেই যেন তারা আমেরিকার রাজনীতিতে আসতে পারছেন না। ঘুরে ফিরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং কোন কোন প্রার্থীর পরিবারের জামায়াত সম্পৃক্ততা নিয়েও আলোচনা চলে আসে। অবাক হই, এ দেশে এসেও রক্ষা নেই। বাঙালির নির্বাচন মানেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি না হয় জামায়াত।

বলা হয়, বাংলাদেশিদের শারীরিক উপস্থিতি হাডসন, ইস্ট রিভারের পারে থাকলেও প্রতিটি আত্মা থাকে দেশে। আমিও যেখানেই থাকি না কেন, সব সময়ই বাড়ির পুকুর পার দেখতে পাই। মনে মনে বাড়িতে থাকি। কথা বলছিলাম এ দেশের রাজনীতি নিয়ে। অল্প সময় কথা বলেই তাদের আগ্রহ দেখা গেল দেশের রাজনীতি নিয়ে। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, আমি আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি। কে শুনে কার কথা। তার চেয়ে বড় কথা, আমিও নিজেকে একজন রাজনৈতিক সচেতন মানুষ মনে করি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই শহরের প্রতি, এই শহরের মানুষের প্রতি আমার আলাদা ভালো লাগা কাজ করে। তাই তারা যাই বলেন, সবই লিখতে মন চায়। রাজনীতির গল্প করতে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

এত কাহিনি বলার কারণ হল, ২৩ জুন নিউইয়র্কে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি হয়ে গেল। কিছু তরুণ প্রার্থী নির্বাচনে নাম লিখিয়েছেন। আমেরিকায় বাংলাদেশিদের অভিবাসনের শত বছর পেরিয়ে গেছে। বহু জাতি-গোষ্ঠীর দেশ আমেরিকায় নিজেদের কোনো অস্তিত্ব এখনো প্রকাশ করতে পারেনি বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষ। নিউইয়র্কে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে বাংলাদেশিদের পরাজয়ের আশঙ্কা ভোটের আগেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। আপাতদৃষ্টিতে তার কারণ কোভিড–১৯ মনে হয়েছে। কিন্তু আসল কারণ তা নয়। অনেকেই মনে করছেন, দেশের রাজনীতি নিয়ে সারা বছর নানা কোলাহলে লিপ্ত থাকলেও একজন স্বদেশি প্রার্থীর জন্যও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অভিবাসীরা।

পরাজয়কে একেবারে নির্বাচনী পরাজয় বলতে চান না অনেকেই। কথা বলেছিলাম বাঙালি পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, যারা নির্বাচন দাঁড়িয়েছেন তাদের সবাই এই প্রজন্মের। আমেরিকার নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি অভিবাসীদের অংশগ্রহণের আগ্রহটাই একটা প্লাস পয়েন্ট। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে এরা জিতে আসবে। এবার হয়নি, তবে ভবিষ্যতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রার্থীদের অনভিজ্ঞতার আলোকে দেখতে চান। তিনি বলেন, এদের কেউই তৈরি না হয়ে নির্বাচন করতে নেমেছে, যা অনেকটা দেশীয় রাজনীতির মত মনে হয়েছে তাঁর কাছে।

সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ অনেকটা আশাবাদী। তিনি জানান, আমাদের আমেরিকায় থাকতে হলে এমন খাপছাড়া থাকলে চলবে না। তিনি নতুন প্রজন্মকে আরও সম্পৃক্ত হয়ে আমেরিকার রাজনীতিতে কাজ করার আহ্বান জানান। হেরে গেলে সমস্যা নেই, তবে জমে গেলে সমস্যা।

মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ডেমোক্রেটিক পার্টি যেমন প্রাইমারি নির্বাচন করে তাদের প্রার্থী নির্বাচন করে, আমাদেরও তেমনি আগে নিজেদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে। এবারের যারা নির্বাচন করেছেন, তাদের সাধুবাদ জানাই। তবে ভবিষ্যতে মূলধারার রাজনীতি থেকে ভালো কিছু পেতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হলে চলবে না। আমাদের কমিউনিটিকে আগে থেকেই সংযুক্ত করতে হবে এবং কমিউনিটির মানুষের ও তাদের হয়ে কাজ করার আগ্রহ রাখতে হবে।

লেখক, কমিউনিটির অ্যাকটিভিস্ট ও কুইন্স লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার আবদুল্লাহ জাহিদ বলেন, এবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নতুন প্রজন্ম আমেরিকার মূলধারার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এটাই আমাদের অনেক বড় পাওয়া। এদের দেখে ভবিষ্যতে আরও অনেকেই আগ্রহী হবে। তবে, এটা সত্য দেশের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হলেও বাঙালি নিজেদের মানুষকে ভোট দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

কথা বলেছি, কলামিস্ট লেখক অধ্যাপক আশরাফ আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, যারা নির্বাচন করেছেন সবাই নতুন। শুধু বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে হালকা–পাতলা যোগসূত্র থেকেই এরা এবার প্রথম নির্বাচন করেছে। তাই তেমন একটা সাড়া পায়নি। তবে ভবিষ্যতে আমেরিকার মূলধারার নির্বাচনে ভালো সাড়া পেতে হলে এসব প্রার্থীর সব কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করা লাগবে। তবেই কিছু একটা আশা করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু এলাকায় পাকিস্তানি মানুষের বেশি বসবাস আছে। সেখানে নিজেকে আমেরিকান মনে করে নির্বাচনে প্রার্থী হতে হবে।

কথা বলেছি প্রগ্রেসিভ ফোরাম ও উদীচীর সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ হারুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার মূলধারার নির্বাচনে ঢুকতে না পারলে আমরা সামনে এগোতে পারব না। এরা বয়সে তরুণ ও শিক্ষিত। এদের নির্বাচনমুখী হওয়াতে আমরা খুশি। আশার আলো দেখতে পাই। ভবিষ্যতে আরও গুছিয়ে ও কমিউনিটির আরও মানুষকে সংঘটিত করে যদি মূলধারার নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে, তবে অবশ্যই কিছু ভালো ফলাফল আমরা পাব।’
শোনা যায় এখানেও প্রার্থীদের দেশীয় রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে নেওয়া হয়েছে—এমন প্রসঙ্গ শুনে কথা বলতে গেলে টাইম টিভির সিইও ও বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহের বলেন, ‘আমি এমনটা শুনিনি। তবে যদি এমনটা হয়ে থাকে, তা হবে খুবই দুঃখজনক।’ তবে তিনিও আশাবাদী, আজকে যারা এখানের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চলেছেন, ভবিষ্যতে তারা আরও কিছু করবে। তার জন্য তাদের কমিউনিটির সবার সহযোগিতা করতে হবে।

নিউইয়র্কে এবারের প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে আগে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন মেরী জোবাইদা। ডিস্ট্রিক্ট ৩৭-এ আলোচিত প্রার্থী ছিলেন। তাঁর এলাকায় বাঙালি ভোটার ছিল মাত্র ১ শতাংশ। তারপরও তিনি ২ হাজার ৭০০–এর বেশি ভোট পেয়েছেন। তিনি বলেন, অনেক প্রার্থী যথেষ্ট এগিয়ে আছেন। পোস্টাল ভোট গণনা শেষ হলে হয়তো কোন একটা চমক দেখাও যেতে পারে। অনেক কিছু জানার ছিল, এ জানাকে এগিয়ে নিয়ে আগামী দিনের রাজনীতিতে নিজেদের সাফল্য দেখবেন বলে আশা করছেন তিনি।

বাংলাদেশিদের আমেরিকার মূলধারার রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কথা হয় টিবিএন টেলিভিশনের কর্ণধার আহমুদুল বার ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে এসে নির্বাচন করছে, এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। তাদের না জেতার পেছনে কারণ অনেক। প্রথমত, আমাদের প্রার্থীদের ফান্ডিংয়ের অভাব ছিল। যার কারণে তারা মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে পারেনি। প্রচারই বর্তমান যুগে খুব জরুরি। মিডিয়া সম্পৃক্ততা না থাকায়, এরা কেউ মানুষের কাছে পরিচিতি পায়নি। ফান্ড না থাকায় অভিজ্ঞ নির্বাচনী ক্যাম্পেইন ম্যানেজার তারা নিয়োগ করতে পারেনি। বাংলাদেশি প্রার্থীদের ফান্ডিং করতে পারে, এমন ব্যবসায়ীও এ দেশে কম।’

তবে জ্যামাইকা বলি বা জ্যাকসন হাইটস বলি, সবার একই মতামত। সবাই আশাবাদী। পর্যাপ্ত নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ না করে কোন দেশেই নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়। যারা নির্বাচন করবেন, তাদের পূর্ব প্রস্তুতি বেশি জরুরি। ভেদাভেদ ভুলে সব কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। মূলধারার রাজনীতিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলে সবাই উল্লেখ করেন।