দেশের স্বজনদের পাশে থাকুন

করোনা মহামারিতে মাকে হারানো ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে লেখক
করোনা মহামারিতে মাকে হারানো ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে লেখক

নিউইয়র্কে করোনা পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। অন্তত অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাওয়ার আশা আছে। কিন্তু আমার প্রিয় জন্মভূমিতে চিকিৎসা যেমন অপ্রতুল, এমনকি পরীক্ষা করার ব্যবস্থাও নেই। নিউইয়র্কে আমি না যত কাছের মানুষকে হারিয়েছি, তার চেয়ে বেশি হারাতে হয়েছে বাংলাদেশের আমার পরিবারের মানুষদের। এবার রোজার মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় চলে গেছেন আমার ভাবি। আমার ভাই চলে গিয়েছিলেন আগে। এবার দুজনের মৃত্যু এতিম করে দিল আমার তিন ভাগনেকে। পরিবার–পরিজনের এই দুঃসময়ে ঈদ করা হয়নি আমার। বেদনা ভরা মন নিয়ে কাটছে এখনকার দিনগুলো।
এখনো মনে পড়ে ভাইয়ের কণ্ঠ। ‘তোদের ওখানে খুব ঠান্ডা? স্নো কি অনেক বেশি পড়ে? তোরা বুঝি বাসাতেও গরম কাপড় পরে থাকিস?’ সেই ছোট বেলায় বাবাকে হারানোর পর থেকে ভাইয়ার কাছেই বড় হয়েছি। অভাব–অনটন আমাদের ভাই কিংবা বোন—কেউ কেমন একটা বুঝতে দেয়নি, সবাই মিলেই মাকে সাহায্য করতো। বেশ ভালোই কেটেছে শৈশব। ভাইয়ের মতে বিয়ে হয়েছে। তারপর দিয়েছি বিদেশ পাড়ি। বেশ কিছুদিন পর আবার ভাইয়ার ফোন, কিন্তু এবার ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, কয় রুমের বাসা আমার? আর জানতে চাইলেন চাকরি কি পাওয়া যায়? নাকি কাজের অভাবে মানুষ হতাশায় ফেরত চলে যায়? আমাকে আর বেশি ভাবার সময় না দিয়েই বললেন, শোন আমরা আসছি সামনের মাসে তোর ওখানে। তোর জন্য কি আনতে হবে বল? এবার ভাইয়া এসে এক বছর থাকলেন। ওনার ছোট ছেলে আসিফের জন্ম হলো এ দেশে। ১২ বছর পর দেশে গিয়ে ভাইয়ার ওখানেই উঠি। ভাইয়া খুশিতে আমাদের বাবা–মায়ের সব কাছের স্বজনদের দাওয়াত করেন। আমাদের পুরো পরিবারের জন্য কাপড়–চোপড় কিনে দেন। বাবুর্চি দিয়ে রান্না করান। আমেরিকায় তখন আমরা দুই বোন এক দোকানে কাজ করতাম। সেদিন ছিল শনিবার। বোনের ফোন আসলে সে একটু দুরে গিয়ে কথা বলতে থাকে। আমার কানে হঠাৎ আওয়াজ আসে, আপা চিৎকার দিয়ে বলছে, দেশে কিছুক্ষণ আগে ভাইয়া স্ট্রোক করে মারা গেছেন। পৃথিবীটা যেন হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল আমার কাছে। এই কঠিন সত্যিটাকে মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের ছিল। দেখতে দেখতে সাতটি বছর পার হয়ে গেল।
২০১৯
মানে গত বছর সবাইকে দেখতে মনটা অস্থির হলে এক মাসের জন্য বাংলাদেশে গিয়ে ঘুরে আসি। মেজ বোন হঠাৎ বললেন, ভাইয়ার ছোট ছেলে আসিফকে আমার সঙ্গে নিয়ে আসতে। যেহেতু ওর জন্ম এখানে। তাই কোনো সমস্যা হয় না। এখন আসিফের বয়স ১৯ বছর। ও টিনএজ পার হতে চলছে। আমার কোনো ছেলে নেই। কিন্তু ওর জন্য তার কোনো অভাব অনুভব করি না। আমার মেয়েদের সঙ্গে ও খুব সুন্দরভাবে মিশে গেছে। হঠাৎ করোনা মহামারি শুরু হলে আমরা খুব আতঙ্কে ছিলাম। সারাক্ষণ মনে হতো, মৃত্যু যেন পাশে ঘুর ঘুর করছে। ভাবি প্রায়ই ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, আমরা সবাই কেমন আছি? নিজের প্রতি কিছুটা অবহেলা করতেন। শরীরের প্রতি অতটা মনোযোগ দিতেন না। হয়তো ভাবতেন, তাঁর কিছুই হবে না। কত যে দোয়া-দরুদ পড়ার জন্য আমাদের পাঠাতেন। হঠাৎ একদিন ভাবি বললেন, শরীরে খুব ব্যথা বোধ করছেন। তোমরা আমার জন্য চিন্তা করো না। গরম পানি খাচ্ছি, ঠিক হয়ে যাবে। এর মধ্যে মা দিবস এল। আসিফকে মনে করিয়ে দিলাম, কাল যেন ও মাকে কল করে, মা দিবসে মায়ের সঙ্গে ও যেন কথা বলে। ওই রাতে হঠাৎ আসিফ ফোন হাতে আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জানাল মায়ের মৃত্যুর খবর। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলি, এ আল্লাহর কেমন বিচার। অল্প বয়সের এই তিন ছেলের হঠাৎ এতিম হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। যখন মেজ ছেলের সঙ্গে কথা হলো, কাঁদতে কাঁদতে বলল, ফুপি আমরা দুই ভাই আম্মুর মুখে মুখ দিয়ে অনেকবার চেষ্টা করেছি অক্সিজেন দিতে। আমরা মাকে বাঁচাতে করোনার কথাও ভাবিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীতে আম্মু আমাদের একেবারে এতিম করে চলে গেলেন।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারানো ভাইয়ের ছেলে আসিফ এখন আমারই সন্তান। লকডাউন তুলে নেওয়ার পরে একদিন ব্যাকইয়ার্ডে বারবিকিউ করলাম। দেখলাম, অনেক দিন পরে আসিফের মুখে হাসি। বিদেশে এই প্রথম ও খুব আনন্দে মেতে ছিল। নিজেই করছিল আমার সঙ্গে সব কাজ। ওই দিন ফাদারস্ ডে ছিল, আমার মেয়েরা বাবার জন্য কত গিফট কিনেছে, সঙ্গে শুভেচ্ছা কার্ড। রাতে যখন শুতে আসি, দেখি আমার বালিশের ওপর একটি ছোট্ট কার্ড, খুলে পড়তে গিয়ে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি।
–ফুপু তুমি আমাকে আব্বুর চেয়েও বেশি ভালোবাস, তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিশ্বস্ত মানুষ। আমি অনেক লাকি যে আমার আশ্রয় তোমার কাছে হয়েছে।—‘হ্যাপি ফাদারস্ ডে ফুপু’।
মনে হলো বাবার হাতের চাবির ছড়া ভাইয়ার কাছে ছিল, আজ সেই ছড়াটা আমার হাতে। আমার ভাইয়ের ছেলের মতো অনেকে এবার করোনায় পরিবারের সবচেয়ে আপনজনকে হারিয়েছে। আমরা যারা আমেরিকায় থাকি, তাদের উচিত দেশে প্রিয় স্বজনদের পাশে দাঁড়ানো। যেকোনো ভালো কাজ পরিবার থেকে শুরু করা উচিত। সবার জন্য ভালোবাসা।