এবার মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে

কোভিড-১৯ ইতিমধ্যেই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রচুর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক প্রভাব বলা যায়, অর্থনৈতিক মন্দাকে একটি স্থায়ী সময়কালে আঁটকে দিয়েছে যা ইতিহাসের পূর্বকালীন অর্থনৈতিক মন্দাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই নাগরিকদের ব্যক্তিগত আয়, কর, মুনাফা ও মূল্যমানের ব্যাপক পতন ঘটেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে।
বেড়েছে বেকারত্বের হার। যদিও বর্তমানে নিউইয়র্ক শহরে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ কমেছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অন্য রাজ্যগুলোতে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, যা অর্থনীতির ধসকে টেনে নিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। এখানে অতীতের অর্থনৈতিক মন্দা ও বর্তমান মন্দার সূত্রপাতেও রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য।
কোভিড-১৯-এর দ্রুত সংক্রমণ রোধে আমেরিকার নিউইয়র্ক নগরে করা হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন, বন্ধ করা হয়েছিল নন-এসেনশিয়াল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ছোটখাটো সব কর্মক্ষেত্রগুলো। এতে করে বেকারত্বের হার দ্রুত বাড়তে দেখা গেছে এ বছরের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে। গত মে মাসে আমেরিকায় বেকারত্বের হার ছিল ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। জুনে বেকারত্ব হার কমে ২ দশমিক ২ পয়েন্ট নেমেছিল। গত মাস থেকে বিভিন্ন কর্মসংস্থানগুলো খুলতে থাকায় প্রায় ৪৮ লাখ নাগরিকের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ায় বেকারত্বের হার কিছুটা কমেছে। যদিও অনেক অর্থনীতিবিদের আশঙ্কা ছিল, ১৯৩০ সালের মহামন্দায় বেকারত্বের হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বর্তমান বেকারত্বের হার। কিন্তু দেখা গেছে, এই মাসে বেকারত্বের হার কমে ১১ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে কর্মক্ষেত্রে ফিরেও স্বস্তিতে নেই মানুষ। আর যারা কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারছেন না, কত দিন জীবিকা নির্বাহে বেকার ভাতা পাবেন তারা, তা নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়।
আমেরিকায় বর্তমান অর্থনৈতিক চরম মন্দার কারণে দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, এনওয়াইপিডি, এফডিএনওয়াই এবং বিভিন্ন অর্থবহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছু বাজেট কাটছাঁট করা হয়েছে। এ কারণে অনেকেই চাকরিক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যারা এই মহামারিকালে বিগত কয়েক মাস বেকারত্বে থাকার পর কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছেন, তাদের কারও কারও আগের ‘নির্দিষ্ট ওয়ার্কিং আওয়ার’ কাটছাঁট করা হয়েছে বিধায় তারা আর্থিকভাবে বিপাকে পড়েছেন। আবার অনেকেই বাজেট কাটছাঁটের কারণে এখনো পর্যন্ত কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশনা পাননি। দুশ্চিন্তায় আছেন ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
এদিকে যারা বেকার ভাতায় আছেন, সিটি থেকে লেবার ডিপার্টমেন্টের আওতায় তারা পাচ্ছেন প্রতি সপ্তাহে একটি চেক, যা তাদের নিয়মিত বেতনের অর্ধেক। বাড়তি ফেডারেল গভর্নমেন্ট থেকে ১৬ সপ্তাহের জন্য বরাদ্দ করা প্রতি সপ্তাহের ৬০০ ডলার চেকটির কার্যকারিতাও এ মাসেই শেষ হওয়ার কথা। তাই বেকারত্বে থাকা মানুষগুলো বিগত কয়েক মাস ধরে আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও তাদের পরবর্তী দিনগুলোতে কীভাবে আর্থিক সংকট মোকাবিলা করবেন, তা নিয়ে আছেন ভীষণ দুশ্চিন্তায়। এই দুশ্চিন্তা অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তরায়।
অর্থনৈতিক মন্দার মূল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, শেয়ার বাজারে ধস, বাড়ির মূল্য হ্রাস, গ্রাহকের স্বল্প আস্থা, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, শিল্প কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি হ্রাস ও হ্রাস বিনিয়োগ। তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিটা অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান উপকরণ হলেও বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে আগের অর্থনৈতিক সংকটের বেশ পার্থক্য আছে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। যেমন, ১৯৩০–এর দশকের মহামন্দার কারণ ছিল স্টক বাজারে দরপতন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত স্থায়ী মন্দায় মর্টগেজ ইন্ডাস্ট্রিতে ধস নামার কারণ ছিল আর্থিক বাজার, তেলের দাম এবং অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট খাতের নানা ইস্যু।
১৯৮১ সালের জুলাই থেকে ১৯৮২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চলমান তথাকথিত রিগ্যান মন্দার অন্যতম কারণ ছিল ফেডারেল রিজার্ভের মুদ্রানীতি, যা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়িয়েছিল। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত প্রায় দশ বছর অবধি ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশনটি’ ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরে শেয়ারবাজার ধসের ফলে ঘটেছিল। তবু এই মন্দায় ১৯৩০–এর দশকের আগ পর্যন্ত আমেরিকার ব্যাংকগুলোতে কোনো ধস নামেনি। কিন্তু এবারের কোভিড-১৯ মন্দাকালে আমেরিকার জনস্বাস্থ্য রক্ষায় খুব দ্রুত ব্যাংক অর্থনীতি বন্ধ করে দিয়েছে। কাজেই, বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণ জিডিপি হ্রাস নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের সংকটের কারণে হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অনেক অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করছেন, আজকের এই অর্থনৈতিক মন্দা আমেরিকায় দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং একটা সময়ের পর হ্রাস পেলেও আবার উঁকি দেবে। অর্থনীতিবিদরা আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভাবলেও কোভিড-১৯–এর কারণে শুরু হওয়া এই অর্থনৈতিক মন্দা ও পূর্ববর্তী মন্দার কারণগুোলোর মধ্যে পার্থক্যের ফলে তাদের জন্যও ফলাফল নির্ধারণ করা অনেকটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওড্রো উইলসন স্কুল অফ পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ডিন সিসিলিয়া রাউস বলেন, এটি কোনো সাধারণ অর্থনৈতিক সংকট নয়। এটি একটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যা আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আগের মন্দার সঙ্গে এই মন্দার ব্যাপক গরমিল রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি নিত্যদিনের জীবনকে প্রভাবিত করছে এবং আমেরিকা যতক্ষণ পর্যন্ত এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি অর্থনীতির বিশাল ক্ষতি করতে থাকবে।
এই মুহূর্তে আমেরিকার অর্থনৈতিক ধস প্রতিরোধে সরকারের জরুরি পদক্ষেপের পাশাপাশি সচেতন নাগরিক হিসাবে সবারই কিছু সতর্কতামূলক দায়দায়িত্ব রয়েছে, যা পালন করা অতীব জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।