আমেরিকার স্বাধীনতা

আবদুস শহীদপৃথিবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে পঞ্চদশ শতাব্দীর আমেরিকা আবিষ্কারের ঘটনা একটি। বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি আমেরিকা শাসন করেছে। তারপর নানা চড়াই–উতরাইয়ের পর পুরো আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থায়ী শাসনভার লাভ করে। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাত থেকে আমেরিকা ১৭৮৩ সালে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। আমেরিকা আবিষ্কার ও ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে আমেরিকার দীর্ঘ সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে রয়েছে এক দীর্ঘ পথচলা।
প্রচলিত তথ্য মতে ১৪৯৩ সালের ১৫ মার্চ কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেন। তবে তিনি এই মহাদেশকে ভারত বলে মনে করে ভুল করেন এবং স্থানীয় অধিবাসীদের ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় বলে মনে করেন। তবে কলম্বাস যে সর্বপ্রথম এ মহাদেশ আবিষ্কার করেছিলেন তা কিন্তু নয়। কারণ ভাইকিংরা কলম্বাসের অনেক আগেই এই মহাদেশে যাতায়াত করেছে বলে জানা যায়। তবে কলম্বাসের হাত ধরেই আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদীদের বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় দেশগুলো বাণিজ্যিক স্বার্থে পৃথিবীর আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াত। এরা জলপথকেই বেছে নিয়েছিল ভ্রমণের প্রধান মাধ্যম হিসেবে। এ ক্ষেত্রে পর্তুগিজ নাবিকদের আধিপত্য ছিল অসামান্য। এরপরে ভাস্কো দা গামার নেতৃত্বে আবিষ্কার হতে থাকে আফ্রিকার দেশগুলো। অবশ্য তিনি ভারতীয় উপমহাদেশও আবিষ্কার করেন।
শতাব্দীর শেষের দিকে পর্তুগিজরা আর সমুদ্র জয়ে তেমন দক্ষতা দেখাতে পারছিল না। এর পরেই এগিয়ে যায় মুসলিমদের থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া স্পেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্র যাত্রায় অন্তর্ভুক্তি ঘটে ইংল্যান্ডের। ইংল্যান্ড মূলত প্রাথমিকভাবে জমি দখলে না গিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাল বুনতে সচেষ্ট ছিল। যেমনটি করে ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সরাসরি ক্ষমতা হাতে না নিয়ে পুরো অর্থনীতি ধীরে ধীরে গ্রাস করে ক্ষমতা দখল করা।
অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর ১৬০৭ সালে ব্রিটেন জেমসটাউনে সর্ব প্রথম কলোনি স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ব্রিটিশরা স্থানীয় অধিবাসীদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে, তারা হিস্পানিকদের মত স্থানীয়দের শোষণ করবে না বরং তারা ব্যবসা–বাণিজ্য ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করে অধিবাসীদের কল্যাণ সাধন করবে।
আমেরিকায় ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় আরও কিছু দিক ছিল। দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ ছিল স্প্যানিশদের হাতে। ব্রিটিশরা চাচ্ছিল, এসব দেশ থেকে স্প্যানিশদের হটিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে। তাই বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। পাশের দেশ কানাডাও তখন ছিল স্প্যানিশদের দখলে। যা পরবর্তীতে ব্রিটিশরা দখল করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় পর্যন্ত ডোমিনেট করতে সক্ষম হয়। এদিকে ব্রিটিশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত লোকেরা নতুন বিশ্ব বলে খ্যাত আমেরিকায় মাইগ্রেট হতে শুরু করে। মূলত আজকের আমেরিকান যারা তাদের একটি বড় অংশই ব্রিটেন থেকে স্থানান্তরিত।
এখন যদিও ৫০টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত, আগে কিন্তু এমনটি ছিল না। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করতে তেরোটি অঙ্গরাজ্য এক হয়ে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এগুলো ছিল ভার্জিনিয়া, ম্যাসাচুসেটস, মেরিল্যান্ড, রোড আইল্যান্ড, কানেকটিকাট, ডেলাওয়্যার, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলিনা, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, সাউথ ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া ও জর্জিয়া। এর প্রতীকী স্বরূপ আমেরিকার পতাকায় ৫০টি নীল স্টারের সঙ্গে লাল রঙের তেরোটি স্ট্রাইপ দেওয়া আছে।
এই তেরোটি অঙ্গরাজ্য ব্রিটিশ উপনিবেশ হলেও ঔপনিবেশিকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্বশাসনাধিকার ভোগ করত। ইংরেজরা এদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র তার অগণতান্ত্রিক নির্দেশনায় একটি শাসন ব্যবস্থা তৈরি করে যা আমেরিকানদের হেয় করে। ঐতিহাসিকদের মতে, ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার দূরত্ব ও ঔপনিবেশিকবাদের উন্মেষ আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল।
এ ছাড়া প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে অন্যান্য যুদ্ধের ব্যয়বহুল ঋণভার আমেরিকার উপনিবেশের ওপর বিভিন্ন বাণিজ্যিক কর আরোপ করে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। যার ফলে আমেরিকানরা ব্রিটিশ নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে দীর্ঘ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
১৭৭৪ সালে ফিলাডেলফিয়ায় এক সম্মেলনে ঔপনিবেশিক তেরোটি রাজ্যের মধ্যে জর্জিয়া বাদে বারোটা রাজ্য একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের নিজেদের দাবি ও অধিকার আদায়ের আবেদন করেন। কিন্তু আবেদন ফলপ্রসূ না হওয়ায় ১৭৭৫ সালে তেরোটি উপনিবেশ মিলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। জর্জ ওয়াশিংটনকে করা হয় প্রধান সেনাপতি এবং ওই বছরই ল্যাকজিন্টনে আমেরিকানরা ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এবং খুব সহজেই ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়।
১৭৭৬ সালে জর্জ ওয়াশিংটন বিরাট বাহিনী নিয়ে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং অতি সহজেই বোস্টন থেকে ব্রিটিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণ ভাবে তাড়িয়ে ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জয়যাত্রা অবাধ বাণিজ্য ও পুঁজিবাদের বিকাশ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি তথা শোষণ অবিচারের মূলোৎপাটনই ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলস্বরূপ।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমেই এই প্রথম কোন উপনিবেশ তাদের প্রভু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জয়লাভ করে। মূলত এখান থেকেই ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের ক্ষয় শুরু হয়।