আমরা কবে বদলাব

প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছিল। মানুষ মঙ্গলে বসবাসের কথা ভাবছে। এমন সময় করোনাভাইরাসের থাবা যেন থমকে গেছে সবকিছু। অদৃশ্য এক শিকল আমাদের পায়ে বেড়ি দিয়েছে। আমরা স্থবির হয়ে পড়ছি। কাজ বন্ধ, মানুষের সঙ্গে মানুষের আলিঙ্গন হয় না। দূরত্বে থাকতে হচ্ছে। খালি চোখে এই দূরত্ব সামান্য হলেও আসলে তা নয়। অনেক পরিবারে উঠেছে ভাঙনের ঝড়, ভেঙেও গেছে দীর্ঘদিনের দাম্পত্য সম্পর্ক। অনেকে পাশাপাশি থেকেও মনে হচ্ছে কয়েক শ মাইল দূরে। আর পরিবারে করোনায় আক্রান্ত হলে তো কথাই নেই। যে আক্রান্ত হচ্ছে তাকে একা হয়ে যেতে হচ্ছে পরিবার থেকে। একেবারে একা। এই একাকিত্ব একজন মানুষের জন্য কতটা যন্ত্রণার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে ফিরে ফিরে দেখে তার জীবনের রঙিন সময়গুলো। ভাবনায় ভাসতে থাকে প্রিয়জনদের স্মৃতি। মানুষের এই যে একাকিত্ব, তা থেকে সহজেই অনেকে বের হতে পারে না।
পৃথিবী থেকে যারা বিদায় নিয়েছে তারা তো নিজের যন্ত্রণায় ছিল পাশাপাশি পরিবারের মানুষের নিষ্ঠুর আচরণ অন্যদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। অনেক বলছে, করোনাভাইরাস না আসলে জানাই হতো না কখনো কে কতটা আপন। এ যেন বাস্তবতার রুহ রূপ। শুধু পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে গেছে তাই নয়, অনেকর বিয়ে ও আটকে গেছে। শিল্পীদের কনসার্ট থেকে শুরু করে অভিনয় সবকিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। ফলে চেনা পরিবেশ ও অচেনা মনে হচ্ছে। দেশ ভিন্ন হতে পারে, ভাষা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু যন্ত্রণা, কষ্টের দিকগুলো প্রায় একই রকম। করোনা জাত–ধর্ম, দেশ-বিদেশ গরিব-ধনী সবার মধ্যেই থাবা বসিয়েছে। পৃথিবী জুড়ে একই আক্ষেপ। কেউ বলছে এ প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমরা যে অবিচার করছি, প্রকৃতি তাই শোধ নিচ্ছে।
কাজ পাগল মানুষেরা হয়ে উঠেছে অস্থির। করোনা মহামারি পৃথিবীর যে ক্ষতিসাধন করছে, তা পূরণ হওয়ার নয়। তবু ও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই পৃথিবীকে আমরা হয়তো আগের রূপে পাব না, কিন্তু চাইলে নতুন করে দেখতে পারি। আমাদের বাঁচতে হলে অর্থ দরকার। সে জন্য অর্থনীতির চাকাও সচল রাখতে হবে। তাই মানুষ গুটিয়ে নেই। নেমে পড়েছে কাজে অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করবে বলে।
সমস্যা হচ্ছে, মানুষের সমাগম হলেই ভাইরাস আবার আক্রমণ করছে। এক অনিশ্চিত অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সময় ও মানুষের জীবন। ভ্যাকসিন নেই, ভয় ও কাটছে না। কারণ ভ্যাকসিন ছাড়া কেউ নিরাপদ নয়। যদিও বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতা চলছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের। থেমে নেই কেউ, সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে কেউ নির্দিষ্ট করে বলছে না, কবে বাজারে আসবে ভ্যাকসিন। এটা বলা সম্ভবও নয়। সময়ের ব্যাপার, গবেষণার ব্যাপার। চাইলেই হুট করে বের করে ফেলবে, তা নয়।
করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে আমেরিকা। সেই আমেরিকা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের শেষে যেমন সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়, আমেরিকার অবস্থা হয়েছে সেরকম। সবকিছু এলোমেলো। এ এক নতুন আমেরিকা। এমন অবস্থা আগে কেউ কখনো দেখেনি। ভাইরাস যেন লুকোচুরি খেলছে। লকডাউনের ফলে একেবারে কমে গিয়েছিল। ফলে মানুষের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ফিরে এসেছিল। লকডাউন তুলে স্বাভাবিক জীবনের পথে পা ফেলছিল। কিন্তু দেখল বিপরীত চিত্র। না ভাইরাস চলে যায়নি, বিলুপ্তও হয়নি। মানুষকে আক্রমণ করার জন্য ওত পেতে ছিল, শেয়াল যেমন মুরগি ধরে সেরকম। সমাগম হলেই থাবা বসাচ্ছে ভাইরাস।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোভিড-১৯–এর জিন মিউটেশনই ভয়ের আসল কারণ। ভাইরাস টিকে থাকতে ৩৮০ বার নিজের জিন বদলে করেছে। ফলে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারে হিমশিম খাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। কোভিড-১৯ সার্স গোত্রের জীবাণু হলেও ভিন্নতা রয়েছে তার চরিত্রে। বিজ্ঞানীরা কবে ভাইরাসের লাগাম টেনে ধরতে পারবেন, তা বলা বাহুল্য।
তবে, প্রকৃতি অন্যরূপে সেজেছে সারা পৃথিবীতে। অনেক বছরের লুকিয়ে থাকা প্রাণীরা ফিরে এসেছে লোকালয়ে। চলছে তাদের স্বাধীন চলাফেরা। মানুষ দেখছে দূর থেকে। প্রাণীগুলো নির্ভয়ে চলছে। প্রকৃতি যেন তাই চাইছিল। আমরা বন্যপ্রাণী থেকে, জলজ প্রাণী সব জায়গায় নিজেদের স্বার্থে তাদের আঘাত করেছি। আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছিল চরমভাবে। এখনো যে সঠিক পথেই আছি তা নয়। মনে করা হয়েছিল, ভাইরাস আক্রমণের ফলে মানুষের মধ্যে ফিরে আসবে মনুষ্যত্ববোধ। কিন্তু দেখছি তার উল্টো চিত্র। বরং আগের থেকে আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে মানুষ। একদিন এই চমৎকার প্রকৃতি থাকবে হয়তো, কিন্তু পাশে হাত ধরার মানুষটি থাকবে না।
এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবী টিকে থাকার একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। পৃথিবীজুড়ে দেখা দিয়েছিল পরিবর্তন। কিন্তু প্রকৃতি এখন আপন মনে ডানা মেলছে। নিশ্বাস নিচ্ছে প্রাণ ভরে, সঙ্গে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। আসলে মানুষ-প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। লাখ লাখ মানুষ এর মধ্যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। পৃথিবীও যেন নতুন রূপে নিজেকে সাজাতে চাইছে। পুনর্জন্ম লাভ করেছে। আমরা চাইলে মানবিক হতে পারি আগের থেকে বেশি। করোনাভাইরাস আমাদের অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ভুলতে বসেছিলাম মমত্ববোধ, দায়িত্ববোধের কথা। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা নিজের স্বার্থের কথাই ভেবেছি। অন্যকে আঘাত করে হলেও কীভাবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাই ভেবেছি।
করোনা আমাদের আবার ঘরবন্দী করে দিয়েছে, ফিরে আসতে হয়েছে সবার মধ্যে। শহরমুখী মানুষ আবার গ্রামে ফিরছে। আমাদের যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে ব্যালান্স করতে হয়। ছুটে চলা যান্ত্রিক জীবনে হঠাৎ করেই লাগাম টেনে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছে, শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্যও বাঁচো। আমরা কি আসলেই তা উপলব্ধি করতে পেরেছি? পৃথিবীটা অল্প সময়ের ব্যবধানে এভাবে পাল্টে গেল ভাইরাসের কারণে, এরপরও কি আমরা অনুভব করতে পারছি আমাদের ক্ষুদ্রতা, আমাদের সামর্থ্য। আমাদের অনৈতিকতা!! পৃথিবী তো বদলে গেছে, আমরা কবে বদলাব, তাই ভাবছি।