প্রেসিডেন্সি বাঁচাতে আমেরিকাকে ভাগ করতেও রাজি ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট পদে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে মরিয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের প্রেসিডেন্সি বাঁচাতে এমনকি তিনি আমেরিকাকেও ভাগ করতে রাজি। জাতিগত দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন ট্রাম্প। নিজের এই অবস্থান আড়াল করার কোনো চেষ্টাও এমনকি তাঁর মধ্যে নেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন কনফেডারেট পতাকা সমুন্নত রাখতে জেরবার। অথচ এই পতাকাকে অনেক আমেরিকানই দেখেন দাসত্বের প্রতীক হিসেবে। তিনি সেই সব জেনারেলদের ভাস্কর্য রক্ষায় পাহারাদারের ভূমিকায় নেমেছেন, যারা এমনকি আমেরিকার বিরুদ্ধেই একসময় অস্ত্র ধরেছিলেন। তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল  অ্যাসোসিয়েশন ফর স্টক কার অটো রেসিংয়ের (নাসকার) এক কৃষ্ণাঙ্গ চালককে আক্রমণ করতেও এমনকি পিছপা হচ্ছেন না। তাঁর কথার ছুরি থেকে বাঁচতে পারছে না ওয়াশিংটনের রেডস্কিন ফুটবল দল, যারা বর্ণবাদী গন্ধ থাকায় নিজেদের দলের নামটি বদলানোর কথা ভাবছে বলে জানিয়েছিল।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আমেরিকার অর্থনীতি বিরাট সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক এ সংকটের মধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। কারণ, সাধারণত এ মাত্রার যেকোনো মন্দার দায় মানুষ বিদ্যমান প্রেসিডেন্টের ওপর দিতে অভ্যস্ত। এবারও তেমনটা হতে পারে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জনমত জরিপে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমছে বলে তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আর এটিই ভয় পাইয়ে দিয়েছে তাঁকে। ফলে বিভাজনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত ট্রাম্প চূড়ান্ত মেরুকরণের রাজনীতিটিই করতে চাইছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প গেলবারের মতোই এবারও আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের ওপর বাজি ধরছেন। তবে এবারের মাত্রাটি গতবারের চেয়ে ভয়াবহ। তিনি দেখাতে চাইছেন, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতি বহুজাতিক ও বর্ণবাদবিরোধী ঢেউয়ে জলাঞ্জলি যাওয়ার পথে। গত সপ্তাহটি ছিল আমেরিকার সাধারণ মানুষের জন্য একটি অরাজনৈতিক উৎসবের সময়। আর তা হলো আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু তিনি এই উপলক্ষটিকেও বিভাজন তৈরিতে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মার্ক্সবাদী, উগ্রপন্থী, নৈরাজ্যবাদী ও বামপন্থীরা এখন আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থার দখল নিতে চাইছে।

এটা সত্য যে, গত সপ্তাহান্তে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা হয়েছে। ছয়টি শিশু মারা গেছে। কিন্তু আমেরিকা দখল হয়ে যাচ্ছে বলে ট্রাম্প যা প্রচার করতে চাইছেন, তার চেয়ে বড় মিথ্যা আর নেই। আর এই মিথ্যা তিনি বলছেন শুধু নির্বাচনে জিততে। যদিও অধিকাংশ বিশ্লেষক এমনকি রিপাবলিকান অনেক নেতাই মনে করছেন, ট্রাম্পের এমন বক্তব্য রক্ষণশীল অংশটিকে উজ্জীবিত করতে পারলেও তা নিরপেক্ষ ভোটারদের দলে ভেড়াতে পারবে না। বরং এমন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মধ্যপন্থী রিপাবলিকানদের দূরে ঠেলে দিচ্ছেন।

জটিল সমীকরণ পেরিয়ে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত জিততে পারবেন কিনা, তার চেয়েও এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাঁর জয়ী হওয়ার এই চেষ্টা। তিনি যেনতেনভাবে নির্বাচনে জয়ী হতে গিয়ে আমেরিকাকে যে জাতিগত বিভাজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, তা কাটিয়ে ওঠা অনেক কঠিন হবে। আগামী নির্বাচনে যিনিই হোয়াইট হাউসে আসুন না কেন, তাঁর পক্ষে আমেরিকাকে আবার ঐক্যবদ্ধ করাটা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে।

করোনাভাইরাসের এই মহাদুর্যোগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা যেকোনোভাবে চাইছে সংকট থেকে মানুষের নজর ফেরাতে। তারা কোনোভাবেই দুর্যোগ মোকাবিলা বা অর্থনৈতিক সংকট জটিল আকার ধারণ করা রোধে প্রশাসনের ব্যর্থতাকে সামনে আনতে চাইছে না। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই দৃষ্টি ফেরাতে গিয়ে তারা শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য বর্ণের যেমন, তেমনি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে চাইছে।

এমন নয় যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কিছু বলছে না। বরং বলছে, বেশ ভালোভাবেই বলছে। বরাবরের মতোই তারা নিজেদের সাফল্য প্রচার করছে, যা মহামারির মতো পরিস্থিতিতে সংকটকে আরও জটিল আকার ধারণ করার ফুরসত দিচ্ছে। ৬ জুলাই হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কেলিগ ম্যাকেন্যানি যেমন বলেছেন, ‘আমার মনে হয় সারা বিশ্ব কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে আছে।’

এটা সত্য, আমেরিকা অবশ্যই এই মহাদুর্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে তা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার বিচারে, যা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে এবং আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। হোয়াইট হাউস বারবার করে বলছে, আমেরিকায় মৃত্যুহার ফ্রান্স ও ইতালির চেয়ে কম। এর মাধ্যমে তারা লাখো মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাটিকে আড়াল করতে চাইছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহে ভাইরাসের সংক্রমণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। এই সত্যটি ট্রাম্প প্রশাসন মূলত লুকাতে চাইছে অনেকটা জোরপূর্বক অর্থনীতি চালু করার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কারণে। যখন সংক্রমণ কমছিল, তখন তাড়াহুড়া করে অর্থনীতি চালু করা হলো। এর পেছনেও ছিল আগামী নির্বাচনে জয়ের সমীকরণ। শত নিষেধ সত্ত্বেও নেওয়া ওই সিদ্ধান্ত এখন বুমেরাং হয়েছে, এ কথা তাই কোনোভাবেই তারা স্বীকার করতে চাইছে না।

আবার অর্থনীতির যে সংকট, তাকে আড়াল করতে বরাবরের মতোই অভিবাসনের প্রসঙ্গ টানা হচ্ছে। আইসের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ফেলা হয়েছে বহিষ্কারের ঝুঁকিতে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকে। আর এই করতে গিয়ে বর্ণবাদের অভিযোগ রয়েছে এমন নেতা ও প্রতীকগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছে প্রশাসন। আর এসবের মাধ্যমে ভয়াবহ মাত্রায় বিভাজন ছড়িয়ে পড়ছে পুরো আমেরিকায়।