রোগী হয়ে গৃহবন্দী

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আজ দুই সপ্তাহ হতে চলল আমার ঘর আলাদা। আমার সঙ্গনিরোধপর্ব চলছে। কিছুদিন আগে এমনই এক দুপুরে উইলিয়ামব্রিজ রোডের এসে মেট্রো আর্জেন্ট কেয়ার থেকে একটি ফোন কল পেলাম। আমার নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, ফোন নম্বর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর কলদাতা নারীকণ্ঠ বলল, ‘আমি দুঃখিত, কিন্তু তোমাকে আমার জানাতে হচ্ছে যে তুমি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত।’

ত্বরিত গতিতে মেরুদণ্ডের ওপর-নিচ বরাবর একটা বিদ্যুতের শিহরণ বয়ে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ফোনের ওই পাশে ভদ্রমহিলা কথা বলেই চলেছেন। আমি তাঁর আধা আধা কথা শুনতে পারছি, আর কিছু কানে ঢুকছে না। সবশেষে বললেন, ‘তোমার কোনো সমস্যা হলে ফোন করে জানিয়ো, তবে অবস্থা জটিল না হলে হাসপাতালে এসো না। হাসপাতালগুলোতে 

করোনা রোগীর উপচে পড়া ভিড়। আমরা সামাল দিতে পারছি না।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘তোমার টেস্টের কপি ই-মেইলে পাঠিয়ে দিলাম। তুমি অফিসে জানিয়ে দুই সপ্তাহের জন্য আইসোলেশনে থাকো।’

স্ত্রীকে বললাম, আমার করোনা টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। ও বলল, ‘সবকিছু নিয়ে মজা কোরো না।’ ওকে আমার ই-মেইল খুলে রিপোর্ট দেখাতে হলো। বেচারার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।

শুরু হলো আলাদা ঘরে আমার একাকী জীবন। আমার সবকিছু আলাদা। থালা, কাপ, তোয়ালে, টয়লেট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, চিরুনি—সব। এমনকি আমার জন্য আলাদা এক বাক্স হ্যান্ড গ্লাভস আর মাস্কও এনে রাখা হলো। সঙ্গে থার্মোমিটার, প্রেশার মাপার মেশিন, পালস অক্সিমিটার।

স্ত্রী ১৪৪ ধারা জারি করে জানিয়ে দিল, ‘তুমি এই ছোট রুমেই থাকবে। আর যা কিছু লাগে, আমাকে বলবে। আমি আমার হাসপাতাল থেকে ছুটি নিচ্ছি। তবে তোমাকে হাসপাতালে পাঠাব না।’ আমার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। হাসপাতালগুলোর অবস্থা ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে? নিউইয়র্কে তখন প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি করোনা রোগী মারা যাচ্ছেন।

প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এই বুঝি মরে যাব। আমার আশপাশের বাঙালি কমিউনিটিতে বেশ কয়েকজন পরিচিত করোনা রোগীর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছি। বাংলাদেশে নিজের পরিবারের কাউকে খবরটা জানালাম না। নিউইয়র্কেও তেমন কাউকে বললাম না। শুধু বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে খুব পরিচিত একজন সাংবাদিক হাবিবুর রহমানকে জানিয়ে রাখলাম। যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তিনি যেন সহযোগিতা করেন। আমার পরিবারকে এখানে আর কে সাহায্যের হাত বাড়াবে?

সেই থেকে শুরু হলো আমার এক ঘরের বন্দিজীবন। করোনা হলে কী হয়, তা আর নতুন করে নাই-বা বললাম। আমি সবকিছুই একটু করে পেয়েছি। কিন্তু ধৈর্য আমি কখনোই হারাইনি। করুণাময়ের অশেষ মেহেরবানিতে আমি দুই সপ্তাহের মাথায় ৯৫ শতাংশ সুস্থ হয়ে উঠেছি। শুধু ঘ্রাণশক্তিটুকু যে চলে গিয়েছিল, সেটি আর আগের মতো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। নিশ্চয়ই সেটি ফিরে আসবে।

তবে আমার সুস্থ হয়ে ওঠার পেছনে একক কৃতিত্ব আমার স্ত্রীর। সে আমাকে সারিয়ে তুলেছে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সেবায়। সাংবাদিক হাবিব ভাই, আমার স্ত্রীর অগ্রজ রব ভাই, আমার নিজের জ্যেষ্ঠ ভাই কর্নেল মনির প্রতিদিন খোঁজ নেওয়ার ছলে আমার মনোবল চাঙা করে রেখেছেন। এই মমতা ভোলার মতো নয়।

আমি অসুস্থ হয়েছি। আমি চাই না আর কেউ এই রোগে ভুক্তভোগী হোক। অযথা আপনারা কেউ বাইরে যাবেন না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। নিজে বাঁচুন, পরিবারকেও বাঁচান।