সিলেটে নারী শিক্ষার অগ্রদূত হোসনে আরা আহমদ

সিলেটের নারী শিক্ষার অগ্রদূত অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
সিলেটের নারী শিক্ষার অগ্রদূত অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমদ। ছবি: সংগৃহীত

সিলেটের নারী শিক্ষার অগ্রদূত অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমদ। জীবনের দীর্ঘ সময় কেবল নারীদের শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব, সম্মান ও সমাজে মাথা উঁচু দাঁড়ানোর জন্য নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তিনি। রাষ্ট্র-ক্ষমতা কিংবা কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ তাঁকে স্পর্শ করেনি। তাঁর স্বামী ডা. শামসুদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। সেই শোককে তিনি শক্তিতে পরিণত করেছিলেন তাঁর আদর্শকে সমুন্নত রাখতে।

ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে একটি নবজাগরণ প্রচলিত সমাজের রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী জাতির ওপর অযৌক্তিক কঠোর বিধান চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ আন্দোলনের জন্ম দেয়। সিলেটের নারী সমাজও এই নারী জাগরনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এই প্রভাবকে যথাযথ ভাবে বিশ্লেষন করতে গেলে যাদের অবদান স্বীকার করতে হয়, যাদের নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন অধ্যক্ষ হোসনে আরা আহমদ।

হোসনে আরা আহমদের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি। তিনি স্কুলে পড়াকালীন বাবা আইনজীবী আবদুল ওয়াহাব চৌধুরীর মৃত্যু হয়। শিক্ষা অনুরাগী মা মুহিবুন্নেসা চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় প্রথমে মিশনারি স্কুল তারপর সেই সময়ে ক্লাসের একমাত্র মুসলিম নারী হিসেবে কৃতিত্বের সঙ্গে সিলেট সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। পরে সিলেট সরকারি মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে নারীদের শিক্ষাগত মান বাড়ানোর অভিপ্রায়ে তিনি ব্রিটিশ আমলে সুদূর কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। তিনিই প্রথম সিলেটের মুসলিম নারী যিনি মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় এই স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। ১৯৪৬ সালে ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় এবং কলকাতার দাঙ্গার জন্য ক্লাস শেষ হলেও পরীক্ষা বন্ধ থাকে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৫০ সালে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকার সময়ে সিলেটের সরকারি মহিলা কলেজ পাকিস্তান সরকার বন্ধ করে দেয়। সিলেটের শিক্ষানুরাগী মানুষ এটা মেনে নিতে পারেননি। বেসরকারি ভাবে কলেজ শুরু করার তৎপরতা শুরু হয়। তখনকার নারী নেত্রী জোবেদা রহিমের আহ্বানে হোসনে আরা আহমদ সংসার-স্বামী সব কিছু ঢাকায় ফেলে সিলেটে চলে আসেন। তাঁর কোলে তখন এক কন্যা ও এক শিশু পুত্র। স্বামী ডা. শামসুদ্দীন আহমদের উদার মানসিকতার জন্যই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

১৯৫০ সালে সিলেট মহিলা কলেজের প্রথমে অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন হোসনে আরা আহমদ। সেই থেকে সিলেট মহিলা কলেজের প্রতিটি সুখ-দুঃখের ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। শহরে নারী সমাজের উন্নয়নের সঙ্গে তিনি অধ্যক্ষে গুরু দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৬২ সালে কলেজের জন্য বর্তমানের বাড়ি ও শহরের মাঝে চার একর বা ১২ বিঘা জায়গা প্রথমবারের মতো কলেজের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে ক্রয় করা হয় তাঁরই তত্ত্বাবধানে। ১৯৬৩ সালে ছাত্রী নিবাসসহ কলেজটি তার নিজস্ব স্থানে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৪ সালে কলেজটিতে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয় এবং ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগের জন্য দুই তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৭০ সালে ছাত্রী নিবাসের প্রথম তলা নির্মিত হয়; এতে করে সিলেট ছাড়াও অন্যান্য জেলার অভিভাবকেরা নিজের মেয়েদের রাজনীতি মুক্ত পরিবেশে হোস্টেলে রেখে পড়াশোনা করানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হোসনে আরা আহমদ জাতীয় শিক্ষা পরিবেশ কমিটিতে বেসরকারি কলেজগুলোর প্রতিনিধি সদস্য মনোনীত হন। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একই প্রক্রিয়ায় রাখার জন্য আপসহীন সংগ্রাম করে যান তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি মুক্ত করে রাখার জন্য তিনি দৃঢ় ভূমিকা রাখেন। তাঁর সময়েই মহিলা কলেজ ফিরে পায় তার জীবনের চেতনা।

অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় বেগম হোসনে আরা আহমদ ১৯৬২ সালে আমেরিকা সরকারের সোস্যালিস্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকার ১১টি স্টেটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। একই বছর টোকিও এবং হংকংয়ে তিনি শিক্ষা সফরে যোগ দেন। নারী শিক্ষার অবদানের জন্য সেই সময় সরকার তাঁকে 'টমগায়ে কায়েদে আজম' খেতাব প্রদান করে।

সিলেট মহিলা কলেজ ছাড়াও তিনি সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তাঁর সময় ও মেধা ব্যয় করেছেন নিরলসভাবে। আম্বরখানা গার্লস হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, আম্বরখানা শিশুস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী, সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের যুবাকল্যাণ কেন্দ্রের সভানেত্রী, ব্লুবার্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যসহ তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সম্মানিত সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি ছিলেন জাতীয় মহিলা সংস্থার সভানেত্রী, ফেডারেশন অব ইউনিভার্সিটি উইমেন্সের সিলেট শাখার সভানেত্রী, জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ সমিতি, টিবি অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট এডুকেশন ট্রাস্টের একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। তিনি ওভারসিজ সেন্টারের পরিচালনা কমিটির একজন ট্রাস্টিও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী সমাজের পূণর্বাসনের জন্য নারী পূণর্বাসন জাতীয় কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ইউনেসকো আয়োজিত শিক্ষা সেমিনারে যোগ দেন হোসনে আরা আহমদ। মালেয়েশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থাও তিনি পরিদর্শন করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দল থেকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও রাজনীতির মোহ তাঁকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা ছাড়া নারী জাতির এগোনোর আর কোনো বিকল্প নেই। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ নতুন ভাবে সরকারিকরণের আওতায় আসে সিলেট মহিলা কলেজ। আর ১৯৮২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হোসনে আরা আহমদ অবসর গ্রহণ করেন।
দেশ ও দেশের মানুষের জন্য এই মহিয়সী নারী শুধু তাঁর নিজের সময় ও মেধা দান করেননি, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে হারিয়েছেন একান্ত আপনজনকে। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাদের হাতে কয়েকজন সহযোগীসহ নিহত হয়েছেন ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। ডা. শামসুদ্দীন আহমদ যে মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন তার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে হোসনে আরা আহমদের কর্মস্থল সিলেট মহিলা কলেজটি। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি একবার বলেছেন 'আমার জীবনের যে চরম দূর্ঘটনা ঘটেছিল সেদিন, ঠিক পরের দিন থেকে আমি আমার কর্মস্থলে যোগ দিয়েছি। এই কবরকে সামনে রেখে প্রথম দিন আমার বুকের ভেতর যে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, তার থেকে শক্তি সঞ্চয় করেই পথ চলেছি আমি। আমার তো হারাবার কিছু নেই।'

২০১৮ সালের ১৬ জুলাই ৯১ বছর বয়সে নিউইয়র্কে ছেলে-মেয়ের বাসায় হোসনে আরা আহমদের মৃত্যু হয়।