ভয়াবহ মহামারিতে বিস্ফোরিত আন্দোলন

বাংলাদেশি-আমেরিকান রেজওয়ান রহমান। ছবি: রেজওয়ান রহমানের সৌজন্যে
বাংলাদেশি-আমেরিকান রেজওয়ান রহমান। ছবি: রেজওয়ান রহমানের সৌজন্যে

বাংলাদেশি-আমেরিকান রেজওয়ান রহমান ব্রুকলিনে থাকেন। পেশায় একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্বাস্থ্যবিদ। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে তিনি অংশ নিয়েছেন, প্রতিবাদ সংগঠিত করতেও সহযোগিতা করছেন। যেকোনো সময় সহিংসতার শিকার হতে পারেন এবং গ্রেপ্তারের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরদিন থেকেই তিনি এই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন।

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর আমেরিকাজুড়ে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন, সহিংসতা-লুটপাট, এর লক্ষ্য বা কারণ এবং সফলতার নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে কথা হয় রেজওয়ানের।

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে কেন জড়িত আছেন, কেন বা কীভাবে অনুপ্রাণিত হলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রেজোয়ান বলেন, ‘অন্যদের মতো কোভিড-১৯ মহামারির ভয়ানক মৃত্যুর পাশাপাশি সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে আমিও উদ্বেগ ও উত্তেজনায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এই সংকট মোকাবিলায় অদক্ষ নেতাদের প্রতি আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলাম এবং এখনো আছি। সে সময় জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যুর ভিডিওটি দেখে আমি আরও বেশি ক্ষোভ ও কষ্ট অনুভব করলাম। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ দ্বারা এমন ঘটনার চিত্র ভিডিওতে আগেও দেখেছি, যা ভাইরাল হওয়ার পরও তারা পার পেয়ে গেছে। কিন্তু ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর প্রথম সপ্তাহের প্রতিবাদে যখন দেখলাম শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে নাগরিকদের ওপর ব্যাপকভাবে পুলিশের সহিংসতা, সাংবাদিকদের অপমানিত করা, মারধর করা, গুলি করা এবং গ্রেপ্তার করা, তখন আমি হতবাকই হইনি, ক্ষুব্ধও হয়েছি।’

রেজওয়ান বলেন, ‘এসবই আমাকে দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দেশ চীন, বাংলাদেশ বা লাতিন আমেরিকার দৃশ্যগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে বিক্ষোভের শুরুতে পুলিশ প্রশাসন বুঝতে পেরেছিল, তাদের ক্ষমতার জন্য কঠিন একটি হুমকি আসছে এবং তারা সেটা দমাতে নির্বিচারে সহিংসতাসহ প্রয়োজনীয় যেকোনো পদক্ষেপ নিতে চাইছিল। তারা সক্রিয়ভাবে আমেরিকানদের অধিকারকে আক্রমণ করছিল। এটিই মূলত আমাকে ভাবনায় ফেলেছিল যে আমাকে প্রতিবাদে যোগ দিতেই হবে। সারা দেশের মানুষ যদি তখন প্রতিবাদে রাস্তায় না নামত, তাহলে পুলিশ অধিকার হরণে সফল হয়ে যেত।’

শুধু একটি রাজ্য নয়, পুরো আমেরিকাজুড়ে চলছে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে রেজওয়ান বলেন, ‘এই সমস্যা আজকে নতুন নয় কিংবা একটি ঘটনার জের ধরে নয়। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গরাই নির্যাতিত হচ্ছে বেশি। শুধু আজ নয়, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্রতিনিয়ত পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে এবং পদ্ধতিগত বর্ণবাদের ওপর আলোকপাত করছে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের ক্রিয়াকলাপগুলো পুলিশদের কার্যক্রমে সামান্য হলেও উন্নতি সাধন করেছে। দেশজুড়ে এখন আমেরিকানরা একমত যে পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গদের টার্গেট করে। মানুষ এখন প্রকৃত পুলিশ সংস্কার এবং পুলিশ জবাবদিহি চায়। এই আন্দোলন আমাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারির মধ্যে বিস্ফোরিত হওয়া একটি আন্দোলন।’

রেজওয়ান আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারিতে মানুষ গৃহবন্দী কয়েক মাস ধরে। এ সময়ে লোকজনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এবং সরকারি অক্ষমতা থেকে ইতিমধ্যেই কমপক্ষে ১ লাখ ৪২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অর্থনীতির ধস, স্বাস্থ্য ও বেকারত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা, সবকিছু মিলিয়ে জনগণ হতাশাগ্রস্ত এবং উত্তেজিত ছিল। তাদের কিছু করার ছিল না। লোকজন সে সময় গণমাধ্যমের দিকে মনোযোগ দিচ্ছিল বেশি। এরই মধ্যে জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনা। সেটাই তাদের আরও বেশি উত্তেজিত করে তোলে, যা বিক্ষোভে পরিণত হয়। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর আগেও আমেরিকান জনগোষ্ঠী উত্তেজিত ছিল। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের কারণে এখন পুলিশের বর্বরতা, পুলিশিংয়ে বর্ণবাদ এবং জবাবদিহির অভাব নিয়ে যে বিস্তৃত পরিমাণে সন্দেহ রয়েছে, তা নিয়ে এখন সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই।’

আন্দোলনের ভিডিও চিত্রগুলোয় দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে অনেক শ্বেতাঙ্গও এতে অংশ নিচ্ছেন। এই সংহতির কারণ কী—এই প্রশ্নের জবাবে রেজওয়ান বলেন, ‘দেখুন, এই আন্দোলন আগেকার আন্দোলনের চেয়ে আলাদা। বহু প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই প্রতিবাদে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী শ্বেতাঙ্গ। পুলিশের এই সমস্যা কেবল কালো সম্প্রদায়ের সমস্যা নয়; অনেক প্রান্তিক এলাকায় আমেরিকান সম্প্রদায়ও এই দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ প্রশাসনের শিকার। এ কারণেই তাঁরা সংহতি প্রকাশ করেছেন এবং কেবল পদ্ধতিগত বর্ণবাদ এবং বর্ণবাদী পুলিশিং জাগ্রত হওয়ার কারণে নয়, তাঁরা নিজেও একই পুলিশ সিস্টেমের দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হওয়ার কারণেই অংশ নিয়েছেন।’

বর্তমানে আমেরিকার একদিকে করোনাকালীন বিপর্যয়, অন্যদিকে বর্ণবৈষম্য আন্দোলন, এই দুটি অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে বা ফেলতে পারে বলে মনে করছেন—এ প্রশ্নের জবাবে তরুণ পেশাজীবী রেজওয়ান বলেন, ‘আমাদের সরকার এবং বেশির ভাগ নেতা এই ভয়াবহ সংকটের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এবং সংকট মোকাবিলায় তাঁদের পদক্ষেপ ও প্রতিক্রিয়া উপযুক্ত ছিল না। যার ফলে আজ কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের বেঁচে থাকাই কঠিন নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অর্থনৈতিক দারিদ্র্য দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং বিশাল সংকটের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে। যেমনটি আমরা এখন মোকাবিলা করছি। আজকের নেতারা আমাদের জীবন এবং ভবিষ্যতের জীবনকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নয়, জর্জ ফ্লয়েড হত্যার আগ থেকেই আমি এ ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম।’

আন্দোলনে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে রেজওয়ান বলেন, ‘আমি সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছি। আমি এনওয়াইসি ডিএসএর (ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা) সঙ্গে প্রতিবাদ সংগঠিত করতেও সহায়তা করেছি। আমি সত্যিকার অর্থে জনগণের পক্ষে কাজ করবে—এমন নির্বাচিত কর্মকর্তাদের সহায়তার জন্য কিছু নির্বাচনী কাজও করছি।’

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্রতিবাদের ফলে কোনো পরিবর্তন ঘটছে বা ঘটবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে রেজওয়ান বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই এবং কারও কাছেই এর কোনো সঠিক উত্তর থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। তবে এই আন্দোলন ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। আমাদের সচেতনতার কারণে এই মুহূর্তে পুলিশ এবং বর্ণবাদ সম্পর্কে জনগণের মতামতের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক আমেরিকান এখন পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ককে আগের চেয়ে আলাদাভাবে দেখেন। নিউইয়র্কে সম্প্রতি একটি আইন বাতিল হয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিটি সেফটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স প্রিভেনশন নামে একটি নতুন বিভাগ তৈরির জন্য মিনিয়াপোলিস সিটি কাউন্সিল তাদের পুলিশ বিভাগটি ভেঙে ফেলার কাজ করছে। সিয়াটল সিটি কাউন্সিলের ভেটো-প্রুফ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রয়েছে, যাঁরা প্রকাশ্যে তাঁদের পুলিশ বিভাগের বাজেট ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পুলিশ অফিসারদের অপরাধের বিরুদ্ধে এখন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সারা দেশের শিক্ষকেরা পুলিশ অফিসারদের স্কুল থেকে অপসারণের দাবি করছেন। পুলিশ বাজেট থেকে অর্থ-অনুদানযুক্ত আবাসন, মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মশক্তি উন্নয়ন এবং সমাজসেবা বিভাগগুলোয় অর্থায়ন করার প্রস্তাব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর আগে এই পরিবর্তন ভাবা যায়নি।’

আমেরিকান সোসাইটি জাতিগত সমস্যাটি নিয়ে কীভাবে কাজ করছেন বলে আপনি মনে করছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে রেজওয়ান রহমান বলেন, ‘আমেরিকান সমাজ সব সময়ই সিস্টেমিক বর্ণবাদ এবং বর্ণগত সমস্যাগুলোর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করে আসছে। দেশজুড়ে ভাড়া স্থগিতের সঙ্গে আসন্ন উচ্ছেদের সংকট আমাদের ওপরে পড়ছে। লাখো মানুষকে উচ্ছেদ করা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং এতে কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনোর লোকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ নিয়ে সরকারের সামান্য সাড়া পাওয়া গেছে।’

আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটি এই জাতিগত সমস্যাগুলো কীভাবে দেখছে—এই প্রশ্নের জবাবে রেজওয়ান বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটি বিএলএম এবং সিস্টেমিক বর্ণবাদের ভিত্তিতে বিভক্ত। নির্ভর করে ব্যক্তিটি পুরোনো প্রজন্মের না তরুণ প্রজন্মের, তার ওপর। এই মুহূর্তে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে পুরোনো প্রজন্মের আলোচনা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে আমাদের কমিউনিটিকে বুঝতে হবে যে আমরা যদিও শ্বেতাঙ্গ মানুষ দ্বারা বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার, কিন্তু আমরা কৃষ্ণাঙ্গদের মতো একই স্তরের অত্যাচার ও অবিচারের মুখোমুখি কখনো হইনি।’